শেষের পথে ২০১৯ সাল। নাট্যাঙ্গনের নানা কাজের হিসাব–নিকাশ, নাট্যজনদের অভিজ্ঞতা ও নাট্যকর্মীদের বক্তব্যে বছরটি উঠে এল নতুন নাটক ও উৎসবের বছর হিসেবে। নাট্যাঙ্গনে বৈচিত্র্য যেমন ছিল, তেমন ছিল নতুনত্ব।
উৎসব থেকে পাওয়া
উৎসব নাট্যাঙ্গনের প্রাণ। কিন্তু এবারের কয়েকটি উৎসব নিয়ে এসেছে ভিন্ন মাত্রা। বটতলার রঙ্গমেলা, নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ের নতুনের উৎসব, প্রাঙ্গণেমোরের দুই বাংলার নাট্যমেলার নাম বলা যায়। প্রথমবারের মতো সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় আয়োজিত হয়েছে আন্তর্জাতিক নাট্যোৎসব। তাতে রতন থিয়ামের নির্দেশনায় ম্যাকবেথ মঞ্চায়িত হয়। ঢাকায় প্রযোজনাটি বেশ প্রশংসিত হয়। নাট্যজন রামেন্দু মজুমদার বলেন, ‘উল্লেখযোগ্য দুটো উৎসবের কথা বলব। একটি হচ্ছে, নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ের নতুনের উৎসব, অন্যটি বটতলার রঙ্গমেলা। এ দুটো খুব অর্থবহ উৎসব ছিল।’
নতুন নাটক
বছরটিকে নতুন নাটকের বছর বললে ভুল হবে না। বছরজুড়ে প্রায় ৪০টি নতুন নাটক এসেছে ঢাকার মঞ্চে। এর মধ্যে কিছু নাটক নিয়ে বাড়তি রোমাঞ্চও দেখা গেছে। সৈয়দ জামিল আহমেদের নির্দেশনায় কথাসাহিত্যিক শহীদুল জহিরের উপন্যাস জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতার মঞ্চভ্রমণ ছিল উল্লেখ করার মতো। কামালুদ্দিন নীলুর নির্দেশনায় স্তালিন নিয়েও চলেছে আলোচনা–তর্ক–বিতর্ক। আলোচনায় ছিল হ্যাপি ডেজ, লেট মি আউট, রাত ভরে বৃষ্টি, কালো জলের কাব্য, আকাশে ফুইটেছে ফুল, পুলসিরাত, আষাঢ়স্য প্রথম দিবসে, ও মন পাহিয়াসহ বেশ কিছু নাটক। নাট্যজন মামুনুর রশীদ বলেন, ‘এ বছর খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি বছর। কারণ, অনেক নতুন নাটক নেমেছে। পুরোনোদের পাশাপাশি তরুণ নাটকের দল নতুন নাটক করেছে। এখন দেখার বিষয় নাটকের মান। মানসম্মত নাটকের দিকে খেয়াল দিতে হবে। পাশাপাশি গুরুত্ব দিতে হবে নাটক দিয়ে কতটা দর্শকের কাছাকাছি পৌঁছানো গেল।’
মাইলফলক পেরিয়ে যেসব নাটক
২০০তম প্রদর্শনী হলো মেরাজ ফকিরের মা, পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায় ও লাল জমিন নাটকের। শততম রজনী পার করল নিত্য পুরাণ। নীলাখ্যান নাটকের ৫০, হেলেন কেলার নাটকের ২৫, সিক্রেট অব হিস্ট্রি নাটকের ২৫তম প্রদর্শনীসহ বেশ কিছু নাটক বিভিন্ন মাইলফলক পার করে। এ ছাড়া রাজধানীর মঞ্চে হয়ে গেল ব্যতিক্রমী এক উৎসব। ‘শত রজনীর নাট্যমেলা’ নামে ওই উৎসবে সার্কাস সার্কাস, কমলা সুন্দরী, জ্ঞান বৃক্ষের ফল ও দুই হুজুরের গপ্পো–এর মতো শত রজনী পেরোনো নাটকের প্রদর্শনী হয়।
মঞ্চে ফেরা
কালো জলের কাব্য নাটক দিয়ে ফের মঞ্চে দেখা গেল অভিনয়শিল্পী আসাদুজ্জামান নূরকে। প্রায় এক বছর বিরতি দিয়ে রাঢ়াঙ নাটক দিয়ে মঞ্চে দেখা গেল তমালিকা কর্মকারকে। ইনডেমনিটি নাটক নির্দেশনার মধ্য দিয়ে মঞ্চে ফিরলেন আজিজুল হাকিম। নতুন করে মঞ্চে আসে আরণ্যক নাট্যদলের নাটক ময়ূর সিংহাসন। নাট্যকার মাসুম রেজার কাছে বছরটিকে নাটকের বছর হিসেবে মনে হয়েছে। তিনি বলেন, ‘মঞ্চে এ বছরকে খুবই সফল বছর মনে করি। অনেক নতুন নাটক এসেছে। বেশির ভাগই মানসম্পন্ন। দর্শকও বাড়ছে। জমে উঠেছে নাটকপাড়া। মৌলিক নাটকও এসেছে বেশ কিছু। নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ের উৎসবটির কথা উল্লেখ করার মতো।’
আরও যা ছিল আলোচনায়
বুদ্ধদেব বসুর সাহিত্য নিয়ে তিনটি নাটক অনুদ্ধারণীয়, রাত ভরে বৃষ্টি ও আমরা তিনজন মঞ্চে এসেছে। মঞ্চে এসেছে দুই কিংবদন্তি কবি কালিদাস ও শেখ সাদি। থিয়েটার আর্ট ইউনিট থেকে মোহাম্মদ বারীর নেতৃত্বে একটি দল বেরিয়ে নতুন দল করেছে অনুস্বার নামে। এ ছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের থিয়েটার অ্যান্ড পারফরম্যান্স স্টাডিজ বিভাগ ইউরোপীয় তিন ধ্রুপদি নাট্যকার আন্তন চেখভ, অগাস্ট স্ট্রিন্ডবার্গ ও হেনরিক ইবসেনের নাটক নিয়ে তৈরি হয়েছে মঞ্চ প্রযোজনা অপরেরা। অভিনয়শিল্পী মামুনুর রশীদ, ফেরদৌসী মজুমদার, সারা যাকের ও শিমূল ইউসুফের মঞ্চাভিনয়ের অভিজ্ঞতা শেয়ার ছিল বছরের অসাধারণ পাওয়া। ঢাকার মঞ্চে অভিনয় করেন ভারতের পশ্চিমবঙ্গের জনপ্রিয় সংগীতশিল্পী অঞ্জন দত্ত। এ ছাড়া নতুন মঞ্চ হিসেবে যোগ হয় দনিয়া পাঠাগারের দনিয়া স্টুডিও থিয়েটার। দনিয়া পাঠাগারের সভাপতি মো. শাহনেওয়াজ বলেন, ‘২২ ফেব্রুয়ারি একটা আন্তর্জাতিক একক নাট্যোৎসবের মাধ্যমে যাত্রা শুরু করে মঞ্চটি। এরপর ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত ৪৭টি অনুষ্ঠান হয় এখানে। এর মধ্যে নাট্যোৎসব, চলচ্চিত্র উৎসবসহ বিভিন্ন নাটকের দল নাটক পরিবেশন করে। এ ছাড়া নাটক নিয়ে আন্তর্জাতিক একটি সেমিনারও আয়োজন করেছিলাম।’
সবকিছু মিলে বছরটি ইতিবাচকই বললেন নাট্যাঙ্গনের মানুষেরা। কিন্তু নাট্যকর্মীদের অর্থনৈতিক ব্যাপারটি এখনো ঠিক আগের মতোই রয়ে গেছে। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় দলগুলোকে যে প্রণোদনা দেয়, তাতে খুব একটা কাজ হয় না বলে মনে করেন রামেন্দু মজুমদার। তিনি বলেন, ‘আমরা প্রথম থেকেই সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়কে বলে আসছি, এই নাট্যদলগুলোকে ৩০ থেকে ৪০ হাজার টাকা অনুদান দিয়ে কোনো লাভ নেই। নতুন নাটক করার জন্য প্রযোজনাভিত্তিক টাকা দেওয়া হোক। এ বছর ২৫টি দলকে দেওয়া হলো। পরের বছর আবার ২৫টি। যেরকম নাগরিক নাট্য সম্প্রদায় দিয়েছে।’