চল্লিশে ঢাকা পদাতিক

প্রদীপ প্রজ্বালনের মাধ্যমে ঢাকা পদাতিকের ‘৪০ বছর পূর্তি উৎসব’ উদ্বোধন করেন অতিথিরা। ছবি: সাজিদ হোসেন
প্রদীপ প্রজ্বালনের মাধ্যমে ঢাকা পদাতিকের ‘৪০ বছর পূর্তি উৎসব’ উদ্বোধন করেন অতিথিরা। ছবি: সাজিদ হোসেন

একজন মুক্তিযোদ্ধা এখনো আত্মযন্ত্রণায় ভুগছেন। কারণ, যুদ্ধাপরাধীরা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখলের পাঁয়তারা করছে। ওই মুক্তিযোদ্ধা সাধারণ মানুষকে সংগঠিত করার উদ্যোগ নেন। ব্যক্তিগত উদ্যোগে তিনি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে মাঠে নামেন। একসময় নিজের ছেলের সঙ্গে তাঁর দ্বন্দ্ব তৈরি হয়। পিতা-পুত্রের বিতর্কের ভেতর দিয়ে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বেরিয়ে আসে। এমনই ভাবনা নিয়ে তৈরি হয়েছে নাটক ‘কথা ৭১ ’।

ঢাকা পদাতিকের এই নাটকের প্রদর্শনী দিয়ে গতকাল জাতীয় নাট্যশালার পরীক্ষণ থিয়েটার মিলনায়তনে শুরু হয়েছে ‘চল্লিশ বছর পূর্তি উৎসব’। নাট্য প্রদর্শনী, আলোচনা ও সম্মাননা প্রদানের মাধ্যমে সাজানো উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে আবুল কাশেম দুলাল স্মৃতিপদক প্রদান করা হয় নাট্যজন ম. হামিদকে। গাজী জাকির হোসেন স্মৃতিপদক প্রদান করা হয় আসমা আক্তার লিজাকে। পদক পাওয়া শিল্পীদের উত্তরীয় এবং স্মারক ও সম্মাননার অর্থ তুলে দেন অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি।

উদ্বোধনী দিনে মঞ্চস্থ ‘কথা ৭১’ নাটকে আব্দুল্লাহ রানা ও সিফাত বিন আজিজ। ছবি: সাজিদ হোসেন

উৎসব উপলক্ষে পরীক্ষণ থিয়েটার মিলনায়তন লবিতে প্রদর্শিত হয় ঢাকা পদাতিকের বিভিন্ন নাটকের স্থিরচিত্র। এখানেই প্রদীপ প্রজ্বালনের মাধ্যমে উৎসব উদ্বোধন করেন অতিথিরা। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব সাংসদ আসাদুজ্জামান নূর। অতিথি হিসেবে বক্তব্য দেন সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি গোলাম কুদ্দুছ, গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনের সেক্রেটারি জেনারেল কামাল বায়েজীদ, নাট্যকার ও নির্দেশক মাসুম আজিজ, অভিনেতা নাদের চৌধুরী এবং ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ শওকত জামিল। সভাপতিত্ব করেন দলের সভাপতি মিজানুর রহমান।

সম্মাননাপ্রাপ্তির অনুভূতি প্রকাশে ম. হামিদ বলেন, ‘আমাদের এমন একটা সময় ছিল, যখন কালা-কানুনের দাপটে নাটক করার আগে পুলিশের অনুমতি নিতে হতো। সেই জায়গা থেকে স্বাধীনতার পর নিরীক্ষাধর্মী নাটক করার একটা অবিরাম চেষ্টা থেকেই থিয়েটার আজকের আদল পেয়েছে। আজকের এই সম্মান আমাকে আপ্লুত করেছে।’

অনুষ্ঠানে আবুল কাশেম দুলাল স্মৃতিপদক প্রদান করা হয় নাট্যজন ম. হামিদকে। ছবি: প্রথম আলো

আসমা আক্তার লিজা বলেন, ‘মাত্র ১৪ বছর বয়সে আমি এ জগতে এসেছি। নাটকের সঙ্গে সেই যে পথচলা শুরু হয়, তা আজও চলছে। ক্রমশ এই নাটকের ভুবনটাই আমার বৃহত্তর পরিবার হয়ে উঠেছে। যখন যে পরিস্থিতিতে থাকি, আমি জানি আমার সঙ্গে একটা বিশাল পরিবার আছে। সেই পরিবারেরে পক্ষ থেকে পুরস্কৃত হওয়ার আনন্দটাই আলাদা।’

প্রধান অতিথির বক্তব্যে নাট্যচর্চাকে ছড়িয়ে দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে সাংসদ আসাদুজ্জামান নূর বলেন, ‘বর্তমানে পুরোনো নাট্যদলের সঙ্গে নতুন নাট্যদলগুলোর মধ্যে একটা উদ্দীপনা সৃষ্টি হয়েছে। এর মধ্যে বেশ কিছু নবীন নাট্যকর্মী আশার সঞ্চার করেছে নাট্যাঙ্গনে। তাদের মাধ্যমে মঞ্চে এসেছে বেশ কিছু ভালো নাটক। আর ভালো নাটক হলে দর্শকেরও অভাব হয় না। পাশাপাশি পুরোনো দলগুলো যে ভালো করছে তারই উদাহরণ ঢাকা পদাতিকের এই উৎসব। তবে এই যানজটের শহরে শুধু শিল্পকলা একাডেমি বা বেইলি রোডের পরিবর্তে নাট্যচর্চাকে ছড়িয়ে দিতে হবে ঢাকার চারপাশে। না হলে ভালো নাটক হলেও যানজট পেরিয়ে সেই নাটকের জন্য দর্শক পাওয়া কঠিন হয়ে যায়।’ তিনি জানান, রাজধানীর আগারগাঁওয়ের মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে নাট্য প্রদর্শনীর জন্য উপযুক্ত মঞ্চ রয়েছে। সেখানে একটি সফল নাট্যোৎসবও হয়েছে। ধানমন্ডির নজরুল ইনস্টিটিউটেও নাটকের উপযোগী মঞ্চ রয়েছে। তিনি বলেন, ‘আমি সংস্কৃতিমন্ত্রী থাকাকালীন উত্তরায় একটি নাট্যকেন্দ্র নির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলাম। সেটি দ্রুত নির্মাণের পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। এভাবে নাটককে মানুষের কাছে নিয়ে যেতে হবে। পাশাপাশি পৃথিবীর অনেকই দেশেই যেমন রাতের খাবারের পর মানুষ নাটক দেখতে বের হয়, তেমনি আমাদের দেশেও পরীক্ষামূলকভাবে রাত ৮টা থেকে প্রদর্শনী করা যেতে পারে। এতে দূরের দর্শকদের জন্য নাটক দেখায় সুবিধা হবে।’

গাজী জাকির হোসেন স্মৃতিপদক প্রদান করা হয় আসমা আক্তার লিজাকে। ছবি: প্রথম আলো

উদ্বোধনী আনুষ্ঠানিকতা শেষে মঞ্চস্থ হয় ঢাকা পদাতিকের নাটক ‘কথা’ ৭১ ’। নাটকের মূল ভাবনা গোলাম মোস্তফার। লিখেছেন কুমার প্রীতীশ বল আর নির্দেশনা দিয়েছেন দেবাশীষ ঘোষ। ঢাকা পদাতিক থেকে জানানো হয়, ‘কথা ৭১’ নাটকের মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধারা বারবার ইতিহাসের সত্যের মুখোমুখি হন। মুক্তিযোদ্ধাদের এই সত্য ইতিহাস যথার্থভাবে উপস্থাপন হয়নি বলেই তরুণদের একটি অংশ আজও বিভ্রান্ত। ‘কথা ৭১’ ইতিহাসের সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করার একটি উদ্যোগ মাত্র।

নাটকে দেখা যায়, মুক্তিযুদ্ধের শুরুতেই অপারেশন সার্চলাইট নিয়ে পাকিস্তানি আর্মিরা পর্যালোচনার মাধ্যমে গণহত্যার রূপরেখা চূড়ান্ত করে। এ সময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বর্বর হামলা পরিচালনার দায়িত্ব নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নেয়। শুরু হয় গণহত্যা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলের সেই গণহত্যা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েটের) অধ্যাপক নূরুউল্লা নিজের ভিডিও ক্যামেরায় ধারণ করার মধ্যমে ১৯৭১ সালের গণহত্যার প্রামাণ্য দলিল তৈরি করেন। জগন্নাথ হলের নিহত ছাত্রদের লাশ সরায় ডোমরা। এরই মধ্যে চুন্নু ডোম এবং পরদেশি ডোম কথা বলে ঢাকা শহরের নির্মম গণহত্যা নিয়ে।

‘কথা ৭১’ নাটকের একটি দৃশ্য। ছবি: প্রথম আলো

আজ শুক্রবার উৎসবের সমাপনী দিনে সন্ধ্যা ৭টায় মঞ্চস্থ হবে পদাতিকের আরেক নাটক ‘ট্রায়াল অব সূর্যসেন’। রচনার পাশাপাশি প্রযোজনাটির নির্দেশনা দিয়েছেন মাসুম আজিজ।