হাসান আরিফ
হাসান আরিফ

হাসান আরিফ স্মরণ

ওগো পথের সাথি

আমার বিবেচনায় বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক সংগঠকদের মধ্যে হাসান আরিফ ছিল সবচেয়ে সৃষ্টিশীল। সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট বা অন্য কোনো সংগঠনের অনুষ্ঠান যখন ও পরিকল্পনা করত, তখন তার মধ্যে যে রুচি, নান্দনিক বোধ ও বিষয়ের প্রতি বিবেচনার পরিচয় পাওয়া যেত, তা ছিল তুলনারহিত।

করোনা অতিমারির আগে আমার অনুজ সাথি হাসান আরিফ পরিকল্পনা করেছিল, আমরা দুজনে মিলে একটি আবৃত্তি অনুষ্ঠান করব, যার বিষয় হবে ‘পথ’। ও বলেছিল, পথবিষয়ক নানা রচনা নিয়ে ও পাণ্ডুলিপিটি তৈরি করবে। কিন্তু অন্তর্যামী নিশ্চয়ই আমাদের অলক্ষ্যে হেসেছিলেন। তাই আমাকে পথহারা করে দিয়ে চলে গেল হাসান আরিফ।
হাসান আরিফ দীর্ঘদিন ধরেই নানা শারীরিক জটিলতায় ভুগছিল। তা সত্ত্বেও বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছে, তার কণ্ঠের জাদু দিয়ে সবাইকে মুগ্ধ করেছে। গত চার মাস হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে চিকিৎসা নিয়েছে। চিকিৎসকেরা সাধ্যমতো চেষ্টা করেছেন তাকে রোগমুক্ত করতে। কিন্তু তার যন্ত্রণাই দীর্ঘায়িত হয়েছে। অনেক আগেই মনে হয়েছিল, তার ফিরে আসার সম্ভাবনা ক্ষীণ। তবু শেষ চেষ্টা করা হয়েছিল। তিন দিন আগে যখন আরিফকে দেখতে হাসপাতালে যাই, তখন ও জ্ঞানহীন, এক পাশ ফিরে নানা যন্ত্রের সহায়তায় বেঁচে আছে। তার বোন আমাদের সঙ্গে একমত হলেন যে আশা যখন আর নেই, তখন চিকিৎসার নামে তার কষ্টকে দীর্ঘায়িত করে লাভ নেই। তার চলে যাওয়াটা যেন শান্তিতে হয়, সেটাই আমাদের প্রার্থনা ও কামনা। ধীরে ধীরে হাসান আরিফ ঘুমিয়ে পড়ল চিরকালের জন্য।

আবৃত্তিশিল্পে হাসান আরিফ একটা নিজস্ব মাত্রা যুক্ত করেছিল। কবিতার প্রতিটি শব্দকে অনুভব করে যে নাটকীয় পরিবেশ ও তৈরি করত, তা সমবেত দর্শকশ্রোতাকে সম্মোহিত করে রাখত।
বেঙ্গল শিল্পালয়ে একবার তার একটি একক আবৃত্তি অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকা ছিল আমার জন্য বিরল অভিজ্ঞতা।

আমার বিবেচনায় বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক সংগঠকদের মধ্যে হাসান আরিফ ছিল সবচেয়ে সৃষ্টিশীল। সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট বা অন্য কোনো সংগঠনের অনুষ্ঠান যখন ও পরিকল্পনা করত, তখন তার মধ্যে যে রুচি, নান্দনিক বোধ ও বিষয়ের প্রতি বিবেচনার পরিচয় পাওয়া যেত, তা ছিল তুলনারহিত। সব সময়েই নতুন কিছু করার আগ্রহ ছিল তার মধ্যে। কোনো অনুষ্ঠান শেষে আমি যখন তার পিঠে হাত রাখতাম, তখনই সে আমার মনের কথা বুঝে ফেলত। মুখ ফুটে তাকে আলাদা করে প্রশংসা করতে হতো না।

সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে শহীদ মিনারে জোটের নানা অনুষ্ঠানে ওর স্বাগত বক্তব্যে বিষয় সম্পর্কে যে স্পষ্ট ব্যাখ্যা ও দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় পাওয়া যেত, সেটাই সভার সুর বেঁধে দিত। তার উদাত্ত কণ্ঠের আহ্বানে সাড়া না দেয়ার সাধ্য কার ছিল?

আমরা যাঁরা স্বৈরাচারবিরোধী দীর্ঘ আন্দোলনে একসঙ্গে পথ চলেছি, তাঁরা নিশ্চয়ই আমার মতো একটা বেদনা অনুভব করছেন। তারুণ্যের ওপর আমার প্রচণ্ড আস্থা। আমি নিশ্চিত, আমাদের তরুণেরা সব প্রলোভনকে উপেক্ষা করে সাধারণ মানুষের কল্যাণে তাদের নিজ নিজ শিল্পচর্চা করবে।

আবৃত্তিশিল্পে হাসান আরিফ একটা নিজস্ব মাত্রা যুক্ত করেছিল। কবিতার প্রতিটি শব্দকে অনুভব করে যে নাটকীয় পরিবেশ ও তৈরি করত, তা সমবেত দর্শকশ্রোতাকে সম্মোহিত করে রাখত। বেশ কিছুদিন ধরে একটি কবিতার সঙ্গে অন্য কবিতা যুক্ত করে আরিফ পরিবেশনায় নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করত। কখনো কবিতাকে গানের মতো সুর করে গেয়েছে অথবা গানকেও যুক্ত করেছে তার আবৃত্তির সঙ্গে। বেঙ্গল শিল্পালয়ে একবার তার একটি একক আবৃত্তি অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকা ছিল আমার জন্য বিরল অভিজ্ঞতা। মানুষটি একদিকে যেমন প্রতিবাদী, অন্যদিকে দারুণ সৃষ্টিশীল। এমন মানুষ তো আজকাল আমাদের সংস্কৃতি অঙ্গনে বিরল প্রজাতিতে পরিগণিত হয়েছে। সবাই যেন প্রতিবাদহীন থেকে নিরাপদে ক্ষমতার আশীর্বাদপুষ্ট হয়ে সংস্কৃতিচর্চা করতে চাইছেন।

আমরা যাঁরা স্বৈরাচারবিরোধী দীর্ঘ আন্দোলনে একসঙ্গে পথ চলেছি, তাঁরা নিশ্চয়ই আমার মতো একটা বেদনা অনুভব করছেন। তারুণ্যের ওপর আমার প্রচণ্ড আস্থা।

রামেন্দু মজুমদার

আমি নিশ্চিত, আমাদের তরুণেরা সব প্রলোভনকে উপেক্ষা করে সাধারণ মানুষের কল্যাণে তাদের নিজ নিজ শিল্পচর্চা করবে। যে শহীদ মিনারে হাসান আরিফের কণ্ঠে বারবার জাগরণের কথা উচ্চারিত হয়েছে, আমাদের প্রিয় সেই শহীদ মিনারে হাসান আরিফ শেষবারের মতো যাবে কফিনবন্দী হয়ে। কোনো কথা বলবে না, চোখ খুলবে না। তবে, নিশ্চয়ই অযুতজনের ভালোবাসা অনুভব করতে পারবে।বন্ধু, পথের সাথি হাসান আরিফ, তোমার আনন্দময় সঙ্গ থেকে বঞ্চিত হলাম চিরকালের জন্য। এখন তুমি থাকবে আমাদের স্মৃতিতে উজ্জ্বল হয়ে। রবীন্দ্রনাথের আশ্রয় নিয়ে গাইতে চাই: ‘নয়ন ছেড়ে গেলে চলে, এলে সকল-মাঝে-তোমায় আমি হারাই যদি তুমি হারাও না যে।।’ আরিফ, যেখানে থাকো, শান্তিতে থাকো। সমুখে শান্তি পারাবার।