আমার ধারণা ছিল সৃজনশীল মানুষদের কখনো ছুটি হয় না। তাঁদের মাথায় সব সময়ই নতুন নতুন সৃষ্টি খেলা করে। তাঁদের বিশ্রাম নেই, নেই কোনো অবসর। কিন্তু কোথায়? এই যে লম্বা ছুটি, আমরা কেউ কি নতুন কোনো সৃষ্টির কথা ভাবতে পারছি? আমাদের চিন্তা, মনন, মেধা সৃষ্টিশীল মন যেন কালো মেঘে ছেয়ে গেছে।
কখনো ভাবতে পারিনি, বিশ্বের প্রতিটি মানুষের মনে এ রকম একদিন একই আতঙ্ক, একই ভয় বিরাজ করবে। এ ক্ষেত্রে ধনী–গরিবের কোনো ভেদ নেই, শিল্পীর কোনো গ্রেড নেই। অহংকার, প্রাচুর্য, মানবিকতা, দয়া শব্দগুলো যেন মিলেমিশে এক হয়ে গেছে। আমরা সবাই এমন এক যুদ্ধে নেমেছি, যেখানে শত্রুকে দেখা যায় না। কখন কোথা থেকে শত্রু এসে আমাকে আক্রমণ করবে, আমি হয়তো বুঝতেও পারব না। মানবজাতি আজ কত অসহায়! পৃথিবী কোথায় চলে গেছে! কত অগ্রসর বিজ্ঞান, কত উন্নত প্রযুক্তি, কোথায় আজ? একটি ভাইরাস লন্ডভন্ড করে দিচ্ছে মানবজাতিকে।
এই সময়ে ভীষণ প্রয়োজন সচেতনতা ও মানবতা। এখনকার এই যুদ্ধে এই দুটো জিনিস ভীষণ প্রয়োজন। বিশেষ করে আমাদের দেশটাকে নিয়ে যখন ভাবি তখন মনে হয়, পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোতে যদি লাশের মিছিল বড় হতে থাকে, তাহলে আমাদের এই আবেগপ্রবণ জাতির কী অবস্থা হবে! আমাদের দেশের মানুষগুলো অনেক সাহসী এবং সরল। কিন্তু এখন আমাদের সাহস দেখিয়ে কোনো লাভ নেই। এখন যুদ্ধের পদ্ধতি পরিবর্তন করতে হবে। আমাদের সচেতন হতে হবে নিজের জন্য, পরিবারের জন্য ও দেশের জন্য।
করোনাভাইরাসের সংক্রমণ থেকে মানুষকে বাঁচাতে যথেষ্ট প্রচার–প্রচারণা হচ্ছে। আমরা যদি এখনো সচেতন না হই, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বা আমাদের দেশের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের দিকনির্দেশনা যদি মেনে না চলি, তাহলে এই ভাইরাসের ভয়ংকর থাবা থেকে আমাদের মুক্তি নেই।
আমাদের নেই অনেক কিছু। আমাদের স্বাস্থ্যবিমা নেই, খেটে খাওয়া মানুষের দীর্ঘদিন ঘরে বসে খাওয়ার কোনো ব্যবস্থা নেই। আর শিল্পাঙ্গনের মানুষগুলো? তাঁরা তো কোথাও হাত পাততে পারবেন না। আমরা কি তাঁদের কথা ভাবছি? শিল্প–সংস্কৃতির সঙ্গে জড়িয়ে আছেন লাখ লাখ মানুষ। তাঁদের কিছুসংখ্যক হয়তো নিজেদের আর্থিক একটি অবস্থান তৈরি করতে পেরেছে। কিন্তু বেশির ভাগ শিল্পীরই তো কাজের ওপর নির্ভর করেই সংসার চালাতে হয়। এখন কাজ নেই। পরিবার নিয়ে তাঁরা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবেন। এসব যদি আমরা না ভাবি, তাহলে এই অঙ্গনের কী হবে?
আমাদের অঙ্গনের প্রতিটি সচ্ছল শিল্পী ও সরকারের এ বিষয়টির ওপর বিশেষভাবে নজর দেওয়া প্রয়োজন। প্রতিটি সংগঠনপ্রধানের সঙ্গে কথা বলে তাঁদের অসচ্ছল শিল্পীদের তালিকা করে তাঁদের পাশে দাঁড়ানো ভীষণ প্রয়োজন। আজ সময় এসেছে একে অন্যের জন্য মানবিকতার হাত বাড়িয়ে দেওয়ার। সময় এসেছে একে অন্যের হাত শক্ত করে ধরে বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখার। আমরা যদি বেঁচে থাকার স্বপ্ন না দেখি, তাহলে ধীরে ধীরে অন্ধকারে ডুবে যাব। ঈশ্বরের কাছে আজ আমাদের সবারই চাওয়া—কী হবে গতি, বিশ্বপতি / শান্তি কোথা আছে / তোমারে দাও, আশা পুরাও / তুমি এসো কাছে।