গ্রুপ থিয়েটার দিবসে শোভাযাত্রা বের করেন শিল্পীরা
গ্রুপ থিয়েটার দিবসে শোভাযাত্রা বের করেন শিল্পীরা

‘এই ফেডারেশন আমাদের কাঙ্ক্ষিত নয়’

সত্তরের দশকে একদল স্বাপ্নিক ও মেধাবী যুবকের হাত ধরে এ দেশে মঞ্চনাটকের পথচলা শুরু। এই ধারাবাহিকতাতেই ১৯৮০ সালের ২৯ নভেম্বর প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশন। প্রথমবার সভাপতিমণ্ডলীর চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন রামেন্দু মজুমদার ও সেক্রেটারি জেনারেল নাসির উদ্দীন ইউসুফ। বর্তমানে এ সংগঠনে সারা দেশের ৩৫০টি দল যুক্ত আছে। আজ সোমবার ৪১ বছরে পদার্পণ করছে সংগঠনটি। এ উপলক্ষে আজ ফেডারেশনের ৪১ বছর পূর্তি অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। হেমন্তসন্ধ্যায় শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় নাট্যশালার মূল মিলনায়তনে হবে এ অনুষ্ঠান। আলোচনা অনুষ্ঠানের পাশাপাশি করোনাকালে প্রয়াত নাট্যজন আলী যাকের, ইনামুল হক, এস এম মহসিন, আবদুল কাদের, মান্নান হীরা, কে এস ফিরোজ, আফসার আহমেদ, তরিকুল ইসলাম বাবু ও মাহমুদ সাজ্জাদকে স্মরণ করা হবে।
অনুষ্ঠানে ‘গ্রুপ থিয়েটার চর্চার ৫০ বছর’ বিষয়ে মূল বক্তব্য রাখবেন নাট্যজন মামুনুর রশীদ। আলোচনায় অংশ নেবেন নাট্যজন রামেন্দু মজুমদার, আতাউর রহমান, নাসির উদ্দীন ইউসুফ, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব মফিদুল হক, গোলাম কুদ্দুছ প্রমুখ। স্বাগত বক্তব্য দেবেন ফেডারেশনের সেক্রেটারি জেনারেল কামাল বায়েজীদ। সভাপতিত্ব করবেন ফেডারেশনের চেয়ারম্যান লিয়াকত আলী লাকী।

প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর প্রাক্কালে প্রথম আলোর সঙ্গে আলাপকালে রামেন্দু মজুমদার বলেন, ‘একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে, যেখানে কোনো অবকাঠামো নেই, এমন একটি জায়গা থেকে আমাদের থিয়েটার শুরু। এখানে নাটক শিক্ষার প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা, ঠিকঠাক একটি মঞ্চ, এমনকি পর্যাপ্ত বিদ্যুৎ ছিল না। এর মধ্যে থেকে যাঁরা শুরু করেছিলেন, তাঁরা প্রকৃতপক্ষেই শিল্পী এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ।’

রামেন্দু মজুমদার

তবে ৪০ বছর পেরিয়ে রামেন্দু মজুমদার কিছুটা হতাশ। তাঁর মতে, ‘ফেডারেশনের যে বিষয় আমাকে সব সময় পীড়া দেয়, তা হচ্ছে ফেডারেশন তার প্রতিবাদী চরিত্র হারিয়েছে। অর্থনৈতিকভাবে সরকার বা বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির ওপর পুরোপুরি নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে।’ তিনি বলেন, ‘ফেডারেশন যে উদ্দেশ্য নিয়ে গঠিত হয়েছিল, তার বাস্তবায়নে এখন ঘাটতি দেখা যাচ্ছে। এই সংগঠনে বড় স্তরের দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়েছে। এই ফেডারেশন আমাদের কাঙ্ক্ষিত নয়।’

স্বাধীনতা–উত্তর বাংলাদেশে ১৯৭২ সালে প্রথম নাটক মঞ্চায়ন করে আরণ্যক। প্রথম মঞ্চায়নে আলী যাকের, সুভাষ দত্ত, ইনামুল হক ও মামুনুর রশীদের মতো প্রথিতযশা শিল্পীরা অংশ নিয়েছিলেন। প্রথম আলোকে নাট্যকার মামুনুর রশীদ বলেন, ‘নাটক যে একটি নিয়মিত চর্চার শিল্পমাধ্যম হতে পারে, এ বোধ তাঁদের জন্মেছিল মুক্তিযুদ্ধের সময় কলকাতায় বিভিন্ন নাট্যদলের কাজ দেখে। স্বাধীনতার পরের সময়টাতে বুকের মধ্যে চাপা আকাঙ্ক্ষা ছিল নাটক করব।’ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশন প্রসঙ্গে তাঁর মতে, ‘এত দিন ধরে প্রতিষ্ঠানটি চলছে। তবে আমার মতে, এই প্রতিষ্ঠান আরও গতিশীল হওয়া উচিত ছিল, আরও ভালোভাবে চলা উচিত।’

মামুনুর রশীদ

একাধিক সূত্রে জানা গেছে, আজ আলাদা আলাদা করে দুটি প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছিল। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও দুটি অনুষ্ঠানের কর্মসূচির ঘোষণা দেখা যায়। এর মধ্যে বেলা চারটায় শিল্পকলা একাডেমির সেমিনারকক্ষে আলোচনা অনুষ্ঠানের কথা বলা হয়েছিল। সন্ধ্যায় ছয়টায় জাতীয় নাট্যশালায় আরেকটি অনুষ্ঠানের ঘোষণা দেওয়া হয়।

তবে আজ দুপুরে গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনের বর্তমান সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক দুজনই নিশ্চিত করেন, তাঁরা সবাই মিলে একটি অনুষ্ঠানই আয়োজন করবেন। সন্ধ্যা ছয়টায় হবে সে আয়োজন। গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনের সঙ্গে সরাসরি জড়িত, এমন বেশ কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সংগঠনের মধ্যে দ্বন্দ্ব তৈরি হয়েছে। সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের মাঝেই মতানৈক্য আছে।

২০১৯ সালে গ্রুপ থিয়েটার দিবসে নন্দন মঞ্চের পরিবেশনা

তবে বর্তমানে সংগঠনের ভেতর যা–ই থাকুক না কেন, চার দশকে বাংলাদেশে মঞ্চ নাট্যচর্চায় গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনের অর্জন নেহাত কম নয়। চার দশকে নাট্য সংগঠনগুলো নিজস্ব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে উদ্যোগী হয়েছে। নতুন নতুন নাট্যদল গড়ে উঠছে তাদেরই সচেতন প্রয়াসে। আন্তর্জাতিক অঙ্গনের সঙ্গেও যোগাযোগ বেড়েছে। দিল্লির ন্যাশনাল স্কুল অব ড্রামাসহ বিশ্বের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নাট্যতত্ত্বের ওপর উচ্চতর ডিগ্রি নিয়ে দেশে ফিরে নাট্যচর্চা করে যাচ্ছেন কর্মীরা। নাটক ও নাট্যতত্ত্ব শিক্ষার বিষয় হয়ে উঠেছে দেশের বেশ কিছু পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে। ইন্টারন্যাশনাল থিয়েটার ইনস্টিটিউটের (আইটিআই) কেন্দ্রীয় সভাপতির মতো গুরুত্বপূর্ণ পদে ছয় বছর দায়িত্ব পালন করেছেন রামেন্দু মজুমদার। বিশ্বখ্যাত গ্লোব থিয়েটারে মঞ্চস্থ হয়েছে বাংলাদেশের ‘হ্যামলেট’।