চারপাশে দর্শক। মাঝে মঞ্চ। মঞ্চের দুই পাশে বসেছেন যন্ত্রশিল্পীরা। শোনা গেল নানা বাদ্যযন্ত্রের সুর। বাঁশি, ঢোল, করতালের আওয়াজের সঙ্গে শিল্পীর উচ্চ কণ্ঠের মিলনায়তন কাঁপানো সংলাপে যেন অগ্নিস্ফুলিঙ্গ খেলে যায় দর্শক-শ্রোতাদের মনে। মুহুর্মুহু করতালি মিলনায়তনের প্রতিটি কোনায় প্রতিধ্বনিত হয় যাত্রার প্রতি দর্শকদের ভালো লাগা ও ভালোবাসার কথা। বুধবার সন্ধ্যায় শিল্পকলা একাডেমির পরীক্ষণ থিয়েটার মিলনায়তনের দৃশ্য এটি।
এই অঞ্চলের রাজনৈতিক, সামাজিক ও বহু ঐতিহাসিক ঘটনার নীরব সাক্ষী হয়ে আছে বাংলাদেশের এক নদী বুড়িগঙ্গা। নদীর বাঁকে বাঁকে রাজধানী ঢাকার বেড়ে ওঠা এবং নবাব সিরাজউদ্দৌলার আমলে অনেক বেদনাদায়ক ঘটনাও ঘটেছে এই নদীপথে। এসব নিয়ে তৈরি হয়েছে যাত্রাপালা ‘বিদ্রোহী বুড়িগঙ্গা’। বুধবার মঞ্চস্থ হলো পালাটি। জাতীয় নাট্যশালার পরীক্ষণ থিয়েটার হলে এই যাত্রাপালাটি পরিবেশন করে দেশের শীর্ষস্থানীয় যাত্রাদল দেশ অপেরা।
যাত্রাপালাটি নির্দেশনা দিয়েছেন মিলন কান্তি দে। পালা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘রক্তরাঙা পলাশীর বিয়োগান্ত পরিণতির পর ইংরেজের বিরুদ্ধে ফুঁসে উঠেছিল সন্ন্যাসী, ফকির ও তাঁতি সম্প্রদায়। বিশেষ করে মসলিন তৈরির তাঁতি। তাদের পুঞ্জীভূত ক্ষোভ–বেদনার বিস্তৃতি ঘটে বিদ্রোহে ও বিক্ষোভে। এ বিষয়গুলো কয়েকটি চরিত্রের মধ্য দিয়ে প্রকাশ করা হয়েছে “বিদ্রোহী বুড়িগঙ্গা” যাত্রাপালায়।’ তিনি আরও বলেন, ‘পালাটির প্রথম মঞ্চায়ন হয়েছিল ২০১৬ সালের ২ আগস্ট। কিছু রদবদল ও পরিমার্জনের মধ্য দিয়ে এটিকে এবার নতুনভাবে সাজানো হয়েছে। প্রথম এই পালা যখন মঞ্চস্থ হয়, তখন দর্শকের কাছ থেকে ভালো সাড়া পাওয়া গিয়েছিল। এতে প্রত্যেকেই দারুণ অভিনয়শৈলী প্রদর্শন করেছিলেন।
‘বিদ্রোহী বুড়িগঙ্গা’ পালাকার আমিনুর রহমান সুলতান বলেন, ‘পলাশীর বিয়োগান্তের ঘটনার পর ইংরেজদের বিরুদ্ধে ফুঁসে উঠেছিল সন্ন্যাসী, ফকির ও তাঁতি সম্প্রদায়। একসময় তাদের পুঞ্জীভূত ক্ষোভ ও বেদনার বিস্মৃতি ঘটে বিক্ষোভে ও বিদ্রোহে। ইতিহাসের এই বিষয় আমি চম্পা বাঈ, শুভংকর, অঞ্জলি প্রভৃতি চরিত্রের মাধ্যমে প্রতীকী ব্যঞ্জনায় ঐতিহাসিক যাত্রাপালা “বিদ্রোহী বুড়িগঙ্গা”য় তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। এই পালায় দুটি বিষয়ের অবতারণা করেছি, যা এর আগে নবাব সিরাজউদ্দৌলার ঘটনাসংক্রান্ত কোনো নাটক বা যাত্রাপালায় দেখানো হয়নি। এর একটি হচ্ছে গুপ্তচর হিসেবে ঢাকার চম্পা বাঈকে সৃষ্টি করা, আরেকটি হলো সন্ন্যাসী ও মসলিন তাঁতিদের ওপর ইংরেজ বেনিয়াদের অমানুষিক নির্যাতন।’ তিনি আরও বলেন, ‘আবুল কালাম মোহাম্মদ যাকারিয়ার “নবাব সিরাজউদ্দৌলা” ও সুপ্রকাশ রায়ের “ভারতের কৃষক বিদ্রোহ” ও “গণতান্ত্রিক সংগ্রাম” গ্রন্থগুলো যাত্রাপালা “বিদ্রোহী বুড়িগঙ্গা” রচনার ক্ষেত্রে আমাকে সমৃদ্ধ করেছে। দর্শকদের ভালো লাগলেই আমার নির্মাণ সার্থক হবে বলে মনে করি।’
বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করেছেন মিলন কান্তি দে, মঞ্জুরুল আলম, টিপু, সুদর্শন চক্রবর্তী, আলী নূর, আননূর রাশাদ, সাদ্দাম, শংকর সরকার, শাহানা ইসলাম, গোধূলি, মনিমালা, লাভলু মিয়া প্রমুখ।