কণ্ঠশীলনের অনুষ্ঠানে বরাবরই এমন কিছু থাকে, যা তাদের অন্যদের কাছ থেকে আলাদা করে। নরেন বিশ্বাস পদক প্রদান অনুষ্ঠানেও যখন আনন্দ-আড্ডা চলছিল, তখন টেলিফোনে সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম ও ভিডিও সাক্ষাৎকারে বিপ্লব বালার কথা শুনতে পেরে দর্শকেরাও আগ্রহী হয়ে উঠলেন অনুষ্ঠানটি নিয়ে। নরেন বিশ্বাস ও জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়কে নিয়ে তাঁরা দুজন বললেন অনেক কথা। সে কথার রেশ নিয়েই আবার সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব মুস্তাফা মনোয়ার যোগ করলেন আরও কিছু।
এ রকমই অনাবিল এক আনন্দের দিন ছিল গতকাল শনিবার। বাকশিল্পাচার্য নরেন বিশ্বাসের জন্মদিন ছিল সেদিন। তাঁর নামে যে নরেন বিশ্বাস পদক, সে পদক এবার পেলেন আবৃত্তিশিল্পী জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়। শিল্পকলা একাডেমির আবৃত্তি, নৃত্য ও সংগীত মিলনায়তনে গতকাল সন্ধ্যায় বসেছিল এ উৎসবের আসর।
কণ্ঠশীলনের সভাপতি সনজীদা খাতুন অসুস্থ ছিলেন বলে আসতে পারেননি অনুষ্ঠানে। তাই কণ্ঠশীলনের সহসভাপতি ফওজিয়া মান্নানের সভাপতিত্বে পদক প্রদান অনুষ্ঠান শুরু হয়। অনুষ্ঠানের আড্ডাপর্বে পদকপ্রাপ্ত জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায় ছাড়াও উপস্থিত ছিলেন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব মুস্তাফা মনোয়ার, বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক হাবীবুল্লাহ সিরাজী, আবৃত্তিশিল্পী রূপা চক্রবর্তী।
অনুষ্ঠানের শুরুতে নরেন বিশ্বাস ও জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়কে নিয়ে দুটি তথ্যচিত্র দেখানো হয়। অতিথিরা মঞ্চে এলে কণ্ঠশীলনের সদস্য মাসুমা জাহান পদকপ্রাপ্ত শিল্পীকে নিয়ে শংসাবচন পাঠ করেন। এরপর কণ্ঠশীলনের সাধারণ সম্পাদক জাহীদ রেজা নূর স্বাগত বক্তব্য দেন।
আড্ডাপর্বটি ছিল অত্যন্ত আকর্ষণীয়। মুস্তাফা মনোয়ার শুরু করেন আলাপচারিতা। তিনি রবীন্দ্রনাথ থেকে উদাহরণ টেনে আনেন। ভাষা ও মায়ের ভাষা নিয়ে কথা বলেন। রবীন্দ্রনাথের ‘ভুলস্বর্গ’ থেকে উদাহরণ টানেন। মুস্তাফা মনোয়ার বলেন, ‘অকাজ দিয়েই আসলে মহৎ সৃষ্টি সম্ভব। জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায় যে শিক্ষক বা প্রশিক্ষক নন, বরং কথা বলেই মনের ভেতর ঢুকে যেতে পারেন, সে কথা স্মরণ করিয়ে দেন।’
হাবীবুল্লাহ সিরাজী আবৃত্তিশিল্পী জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়ের প্রশংসা করে বলেন, ‘রবীন্দ্র-পরবর্তী যুগেও বাংলা ভাষা নিয়ে যে কাজগুলো হচ্ছে, তাতে জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায় একজন সক্রিয় অংশগ্রহণকারী।’ তিনি বলেন, ‘রবীন্দ্রনাথকে বাদ দিয়ে হয় না। মাইকেলকে বাদ দিয়ে হয় না। তবে রবীন্দ্রনাথকে শীর্ষে রেখে আমরা বাংলাদেশেও সাহিত্যে নবচর্চা করতে চাইছি। সেটি জোরদার হবে যাঁদের দিয়ে, সেই ধারক ও বাহকদের মধ্যে জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায় অন্যতম।’
রূপা চক্রবর্তী বলেন, ‘জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায় আসলে আবৃত্তিসম্রাট। তিনি আমাদের ভেতর থেকে নাড়িয়ে দিলেন। আবৃত্তি যে একটি চর্চার ব্যাপার, সেটা বুঝিয়েছেন জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়।’
অনুভূতি জানাতে গিয়ে জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘প্রশিক্ষক হতে চাইনি। প্রশিক্ষণে গড়পড়তা পারফর্মার হওয়া যায়। শিল্পী হতে হলে একটি স্তর অতিক্রম করে যেতে হয়। সেটা সকলে পারে না। আমি তো গলা দিয়ে ছবি আঁকি। সেটা আমি আঙুলে নিলে কেন আমি শিল্পী হতে পারব না? আমার কাজ বিভ্রম তৈরি করা, মায়া তৈরি করা। আমরা যখন গান শুনি, তখন অন্য জগতে চলে যাই।’
বলে যান জয়ন্ত, ‘আবৃত্তিকারদের বলি, সুরের ওপর গলাটি রাখতে হয়। এ ব্যাপারে নিয়ন্ত্রণ থাকতে হবে।’ পদক প্রাপ্তির প্রসঙ্গে তিনি বলেন, কণ্ঠশীলনের এই পদক নিতে প্রথমে আমি রাজি হইনি, কেননা পদকের প্রতি আমার কোনো মোহ নেই। কোনো কালে ছিল না। কিন্তু যখন একদল তরুণ এসে এই পদকের প্রস্তাব দিল আমাকে, তখন তাদের চোখে যে ভালোবাসা দেখেছি, সেই ভালোবাসা দেখে আমি সানন্দে গ্রহণ করেছি।’
আলোচনা পর্বের পর ছিল জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়ের রচনা থেকে তৈরি করা কণ্ঠশীলন প্রযোজনা। জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায় তাঁর ‘আমি তুমি সে’ নামে যে বই লিখেছেন এবং ফেসবুকে যে স্ট্যাটাস দিয়েছেন, সেগুলোরই একটি সংকলন এই প্রযোজনা। ‘শিল্পযুদ্ধে আমি তো কর্ণ’ নামে প্রযোজনাটির নির্দেশনা দেন রইস উদ্দীন আহমেদ। অংশ নেন জহিরুল হক খান, প্রদীপ কুমার আগারওয়ালা, ইসরাত জাহান, মৌসুমী রায় চৌধুরী, মায়মুনা মিলি, শিল্পী রায় ও মাসুদ হোসেন।
এরপর আবৃত্তি অঙ্গনের বিশিষ্ট শিল্পীরা করেন একক আবৃত্তি। আবৃত্তিশিল্পীরা হলেন ডালিয়া আহমেদ, বেলায়েত হোসেন, মাসকুরে সাত্তার কল্লোল, মাহমুদা আখতার, আবু নাসের মানিক, মাসুম আজিজুল বাশার, ইভা মণ্ডল ও এনায়েত কাজল।
অনুষ্ঠান শেষ হয় জাতীয় সংগীতের মধ্য দিয়ে। এরপর জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়কে মঞ্চে নিয়ে আসা হয় এবং তাঁর সঙ্গে সবাই ছবি তোলেন।
বাকশিল্পাচার্য নরেন বিশ্বাস ১৯৪৫ সালের ১৬ নভেম্বর গোপালগঞ্জে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৭৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে যোগ দেন। আমৃত্যু সেখানেই তিনি অধ্যাপনা করেছেন। আবৃত্তি সংগঠন কণ্ঠশীলনের শুরু থেকেই তিনি যুক্ত ছিলেন। আমৃত্যু আবর্তনে উচ্চারণের ক্লাস নিয়েছেন। আবৃত্তি চর্চাকেন্দ্র, থিয়েটার স্কুল, শব্দরূপ, গণমাধ্যম ইনস্টিটিউটসহ অসংখ্য প্রতিষ্ঠানে উচ্চারণের ক্লাস নিয়ে তিনি বাংলা ভাষা ও উচ্চারণের বিকাশে রেখেছেন অবদান। তাঁকে স্মরণ করে ১৯৯৯ সাল থেকে কণ্ঠশীলন চালু করেছে নরেন বিশ্বাস পদক। প্রথমবার এ পদক পেয়েছিলেন নাজিম মাহমুদ (মরণোত্তর)। পরের বছর ২০০০-এ পেয়েছিলেন গোলাম মুস্তফা। বিভিন্ন সময়ে নরেন বিশ্বাস পদক পেয়েছেন নিখিল সেন, আশরাফুল আলম, সনজীদা খাতুন, শামসুর রাহমান, নিরঞ্জন অধিকারী, ভাস্বর বন্দ্যোপাধ্যায়, খান সারওয়ার মুরশিদ, সৈয়দ হাসান ইমাম, আসাদুজ্জামান নূর, খালেদ খান যুবরাজ, নাসির উদ্দীন ইউসুফ, ফেরদৌসী মজুমদার, আলী যাকের, বিপ্লব বালার মতো গুণী ব্যক্তিত্বরা। এ বছর কণ্ঠশীলনের নরেন বিশ্বাস পদক পেলেন আবৃত্তি ও অভিনয়শিল্পী জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়।
জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায় জন্মেছেন ১৯৪৬ সালের ২৮ জুলাই। সাতক্ষীরার ঈশ্বরীপুরে তাঁর জন্ম। পড়াশোনা ঈশ্বরীপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়, নকীপুর এইচসি হাই ইংলিশ স্কুল, কলকাতার আনন্দমোহন কলেজ ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে পড়াশোনা করেন। ছাত্রজীবনে বামপন্থী সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে বিশ্ববিদ্যালয়ে বাদ দিয়ে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। কলকাতায় ছিলেন যখন, তখন সংগীত, নাটক, আবৃত্তিতে আগ্রহী হয়ে কাজী সব্যসাচীর সংগঠন ‘অগ্নিবীণা’র সদস্য হন। সাহচর্য পান নাট্যপুরোহিত শম্ভু মিত্রের। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সাল থেকেই তাঁর আবৃত্তিচর্চা চলতে থাকে। নিজেকে আবৃত্তিশিল্পী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন। ১৯৭৫ সালে প্রথম দর্শনীর বিনিময়ে সম্মেলক আবৃত্তির সূচনা করেন। ১৯৭৭ সালে প্রথম দর্শনীর বিনিময়ে একক আবৃত্তির অনুষ্ঠান করেন। এরপর দেশে ও বিদেশে আবৃত্তি করেছেন অজস্রবার। শিক্ষক হয়ে তরুণদের আবৃত্তির কাছে টেনে নিয়েছেন। কণ্ঠ দিয়েছেন অনেক প্রামাণ্যচিত্রে। আবৃত্তির পাশাপাশি অভিনয়েও রেখেছেন পারদর্শিতার চিহ্ন। বেতার, মঞ্চ, টেলিভিশন ও চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন। বাংলাদেশের ভিন্নধারার অধিকাংশ চলচ্চিত্রেই অভিনয় করেছেন।