আনন্দমেলা প্রাইভেট সিনেমা লিমিটেড, আনন্দমেলা কথাচিত্র, বন্ধন বাণী কথা চিত্র, সন্ধানী কথাচিত্র, মধুমিতা মুভিজ, আলমগীর পিকচার্স, এসএস প্রোডাকশনস, তিতাস কথাচিত্র, জননী কথাচিত্র, রাজলক্ষ্মী প্রোডাকশনস, রোজিনা ফিল্মস, স্টার মুভিজসহ ঢাকাই সিনেমায় অনেক প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছিল। ব্যবসাসফল ছবিও উপহার দিয়েছে প্রতিষ্ঠানগুলো। তবে এটা আশির দশক থেকে চলতি শতকের প্রথম দশকের চিত্র। বর্তমান বাস্তবতা ভিন্ন। খুব বেশি নামীদামি প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান নেই, পেশাদার প্রযোজকের সংখ্যাও হাতে গোনা। ব্যবসায় মন্দাসহ নানা কারণে নতুন প্রযোজকও সেভাবে আসছেন না। এলেও একটা–দুটো ছবি করে বিনিয়োগ হারিয়ে ফিরে যাচ্ছেন তাঁরা। এর কারণ হিসেবে চলচ্চিত্রসংশ্লিষ্ট কেউ কেউ কয়েকজন পরিচালক, শিল্পীদের দায়ী করছেন।
গত ঈদে মুক্তি পায় নতুন প্রযোজক রাজিব সারোয়ারের প্রথম ছবি ‘ক্যাসিনো’। প্রথমে ছবিটির বাজেট ছিল ৭০ লাখ টাকা। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ছবিটির বাজেট দাঁড়ায় ১ কোটি ১০ লাখে। মুক্তির পর প্রেক্ষাগৃহ থেকে মাত্র তিন লাখ টাকা পেয়েছেন প্রযোজক। ডিজিটাল ও টেলিভিশন থেকে আরও ২০ বা ২৫ লাখ আসতে পারে। অথচ প্রযোজককে লাভের আশা দেখিয়ে প্রযোজনায় আনা হয়েছিল। মুক্তির পর বিনিয়োগের তিন ভাগই লোকসান ছবিটির। আর কোনো ছবি করবেন না বলে জানিয়েছেন ওই প্রযোজক। এই প্রযোজকের ভাষ্য, ‘মুক্তির আগে–পরে সিনেমাসংশ্লিষ্ট অনেকেরই সহযোগিতা পাইনি। অথচ ছবি নির্মাণের আগে আমাকে অনেক স্বপ্ন দেখানো হয়েছিল। কাজটি শুরুর পরপরই বুঝতে পেরেছিলাম, এখানে আসা ঠিক হয়নি। কিছু মানুষ এখানে অসৎ। এদের কারণে ফিল্মে ভালো প্রযোজকেরা আসেন না।’
আরেক প্রযোজক নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, এক নায়কের অনুরোধে তিনি ছবি প্রযোজনায় এসেছিলেন। ৮০ লাখ টাকা বাজেটের সেই ছবির ৩০ ভাগের কিছু বেশি শুটিং করার পরপরই তাঁকে কাজ বন্ধ করতে হয়েছে। কাজ শেষ করতে হলে আরও এক কোটি টাকা লাগতে পারে। তাই ছবি আর শেষ করবেন না। ওই প্রযোজকের কথা, ‘শুটিংয়ের আগে ভারতের কলাকুশলীদের সঙ্গে মিটিং করাসহ আসা-যাওয়া মিলেই ২০ লাখের হিসাব দেখিয়েছেন পরিচালক। আমি ব্যবসায়ী মানুষ। টাকা কীভাবে কষ্ট করে আয় করতে হয়, আমি জানি। পানিতে আর টাকা ঢালব না। আমার কাছে মনে হয়েছে, এখানে কেউ কেউ নতুন প্রযোজক ধরে এনে আয়ের ধান্দা করে। আগে জানলে জীবনেও আসতাম না।’
একই অবস্থা মেহেদি হাসান নামের আরেক প্রযোজকের। ৪৫ লাখ টাকা বাজেটের ছবি ‘অমানুষ’ থেকে লাখখানেক টাকা ফেরত পেয়েছেন। ‘ইত্তেফাক’ নামে তাঁর আরেকটি ছবির শুটিং অর্ধেক শেষ হওয়ার পর চার বছর ধরে বন্ধ। তিনি বলেন, ‘যা গেছে গেছে, আর নয়। কোনো কোনো পরিচালক নতুন প্রযোজককে বোকা মনে করেন। আর নয়। জীবনেও আর সিনেমা প্রযোজনা করব না।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আরেক প্রযোজক ও পরিচালকের মন্তব্য, ‘যেসব নতুন প্রযোজক আসছেন, একটা ছবিতে লাভ হলে নিশ্চয়ই পরের ছবিতে আবার বিনিয়োগ করতেন। লাভের আশ্বাস দিয়ে, মিথ্যা গল্প শুনিয়ে প্রযোজক এনে কোনো কোনো পরিচালক নিজের আখের গুছিয়ে কোনোমতে ছবি শেষ করেন। মুক্তির সময় পরিচালকের ফোন বন্ধ রাখার অভিযোগও শুনেছি। তাহলে এই সব নতুন প্রযোজকেরা কেন আসবেন? ফিল্মের এই অবস্থার জন্য এটিও অনেকখানি দায়ী।’
নতুন প্রযোজকদের এই হতাশা সম্পর্কে মন্তব্য জানতে চাইলে প্রযোজক সমিতির সাবেক সভাপতি খোরশেদ আলম কয়েকজন পরিচালক ও শিল্পীকে দায়ী করেন। তিনি বলেন, ‘কিছু শিল্পী ও পরিচালক তাঁদের পরিচিতজনদের নানা রকম বুঝিয়ে, লোভ দেখিয়ে বিনিয়োগ করার জন্য নিয়ে আসেন। যাঁরা আসেন, তাঁরা না বুঝেই লোকসানের মুখে পড়েন। এমনও শুনেছি, কোনো কোনো পরিচালক ৪০ লাখ বিনিয়োগ করার মাধ্যমে কোটি টাকা লাভের আশ্বাস দিয়ে প্রযোজক এনেছেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ওই প্রযোজকের পুরা টাকাই লোকসান হয়েছে। পরবর্তী সময়ে ওই সব প্রযোজক আর সিনেমায় বিনিয়োগ করেননি।’
এতে করে ইন্ডাস্ট্রির বড় রকম ক্ষতি হচ্ছে বলে জানান খোরশেদ আলম, যেসব নতুন প্রযোজক একটা-দুটো ছবি করে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন, তাঁরা বাইরে গিয়ে এই সব গল্প করছেন। যাঁদের এখানে বিনিয়োগের আগ্রহ ছিল, এসব গল্প শুনে তাঁরাও এখানে আসার আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন। এতে করে নতুন প্রযোজক আসার পথ রুদ্ধ হচ্ছে।
পুরো বিষয়টিকে চলচ্চিত্রশিল্পের জন্য দুর্ভাগ্যজনক বলে মনে করেন প্রযোজক ও পরিচালক মতিন রহমান। তিনি বলেন, যাঁরা এখানে বিনিয়োগ করতে আসছেন, তাঁদেরও বুঝেশুনে আসতে হবে। আগে প্রযোজকেরা এখানে পেশাদার মন নিয়ে বুঝেশুনে কাজ করেছেন, ব্যবসাও করেছেন। এতে করে বড় বড় প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানও গড়ে উঠেছিল।