১৯৭২ সালের আজকের দিনেই শুরু হয় ঋত্বিক ঘটকের কালজয়ী চলচ্চিত্র ‘তিতাস একটি নদীর নাম’–এর শুটিং। ছবির প্রযোজক হাবিবুর রহমান খান জানালেন, অভিনয়শিল্পীদের মধ্যে প্রবীর মিত্র, আবুল হায়াত ও ফখরুল হাসান বৈরাগীই শুধু বেঁচে আছেন। ৫০ বছর উপলক্ষে ছবিটি নির্মাণের নেপথ্যের গল্প শোনালেন মনজুর কাদেরকে
প্রথম দিনের শুটিং
‘তিতাস একটি নদীর নাম’ চলচ্চিত্রের প্রথম দিনের শুটিং লোকেশন ছিল সাভারে বংশী নদী। কবরী ও রোজী সামাদ সেদিন শুটিংয়ে অংশ নেন। সাভারে এক দিন শুটিংয়ের পর চলে যাই তিতাস নদী এলাকায়। পুরো ইউনিট নিয়ে একটা লঞ্চে করে তিতাস নদীতে যাই। তিতাসের গৌকর্ণঘাটে সেট বানিয়ে শুটিং করেছি। ঢাকার এফডিসি, আরিচাঘাটসহ আরও বিভিন্ন জায়গায় শুটিং করেছি। শুটিং শেষ করতে সব মিলিয়ে লেগেছিল ৮ কি ৯ মাস। এতটা সময় লেগেছিল, কারণ আমরা সময়টাকে ধরতে চেয়েছি।
কী ভেবে ‘তিতাস একটি নদীর নাম’
প্রযোজক হিসেবে আমার জীবনের প্রথম সিনেমা। বয়স তখন ২৭। বিয়ে করেছি ঠিক দুই বছর আগে। এই বয়সে না বুঝেই ওই ধরনের একটা গল্প বাছাই করেছিলাম। স্বপ্ন ছিল, ঋত্বিক ঘটককে দিয়ে ছবি বানাব। তিতাস একটি নদীর নাম শুরুতে পরিকল্পনায়ও ছিল না। ঋত্বিকদার সঙ্গে কথাবার্তা হলে তিনিই বললেন, ‘তিতাস করব।’ আমি বললাম, আপনি যা–ই করেন না–করেন, আমি আপনাকে দিয়ে ছবি বানাতে চাই। সমস্যা নেই। তিতাসই হোক।
মানিক বাবু না, ঋত্বিক ঘটককে পেলে ছবি করব
তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ ১৯৭২ সালের মার্চ কিংবা এপ্রিলে। আমাদের একটা অনুষ্ঠানে ওই বছরের ফেব্রুয়ারিতে সত্যজিৎ রায় ঢাকায় এসেছিলেন। সেই অনুষ্ঠানের আমি কোষাধক্ষ্য ছিলাম। একুশে ফেব্রুয়ারির অনুষ্ঠান, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী সাংস্কৃতিক সংস্থার ব্যানারে। এই অনুষ্ঠানে সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে বরুণ বকসী নামের একজন লোক এসেছিলেন। পরিচয়ের একটা পর্যায়ে তিনি আমাকে বললেন, মানিক বাবুকে (সত্যজিৎ রায়ের ডাকনাম) নিয়ে ছবি করার ইচ্ছা আছে? বললাম, ছবি তো করার ইচ্ছা আছে, কিন্তু মানিক বাবু না, ঋত্বিক ঘটককে পেলে ছবি করব। ফোন নম্বর দেওয়া–নেওয়া হলো। এরপর কলকাতায় ফিরে মার্চের মাঝামাঝি বা শেষ দিকে আমার বাসায় ফোন করলেন। স্পষ্ট মনে আছে, বলেছিলেন, ‘পাইছি ঋত্বিক বাবুকে। চলে আসো।’ কয়েক দিনের মধ্যে টিকিট কাটলাম। এয়ার ইন্ডিয়ার বিমানে ১২০ টাকা দিয়ে টিকিট কেটে দিলাম দৌড়। এয়ারপোর্ট থেকে নেমেই গেলাম বকসীর বাড়িতে। পার্ক সার্কাসের ৬বি বেনিয়াপুকুর লেনের সেই বাড়িতে আগে থেকেই বসে ছিলেন ঋত্বিক ঘটক। তখন তিনি একটু অসুস্থও ছিলেন। ট্রিটমেন্টও করা হয়েছিল এই বাড়িতে রেখেই। আমার সঙ্গে ওই বাড়িতেই প্রথম কথা হলো। আমাকে দেখে হাসলেন, আমিও হাসলাম। সবচেয়ে মজার বিষয়, আমি তখনো তাঁর কোনো ছবি দেখিনি।
‘সুবর্ণরেখা’ দেখে অভিভূত
কলকাতার জ্যোতি সিনেমা হলে একটা মিনিয়েচার হল ছিল। আগেকার দিনে কলকাতার অনেকগুলো সিনেমা হলে মিনিয়েচার ছিল। মিনিয়েচারে সেন্সরে জমা পড়া ছবিগুলোর প্রজেকশন হতো। ওদের সেন্সর বোর্ড ছিল কিন্তু ওখানে প্রজেকশন সিস্টেম ছিল না। প্রথম দেখার পরদিন ঋত্বিক বাবুর সঙ্গে সেখানে গিয়ে দেখলাম সুবর্ণরেখা। অভিভূত হয়ে গেলাম। বললাম, একটা মানুষ এই রকম একটা সিনেমা কীভাবে বানাতে পারে! বাইরে এসে সশ্রদ্ধ প্রণাম করলাম ঋত্বিক বাবুকে। তিনিই বললেন, তিতাস বানাবেন। উপন্যাসের কপিরাইট ছিল ট্রাস্টি বোর্ডের কাছে। সেই বোর্ডে আবার সত্যজিৎ বাবুও ছিলেন। তিনিও বলছিলেন, ‘ঋত্বিক তিতাস নিয়ে ছবি করলে ভালো করবে।’ পাঁচ হাজার টাকায় কপিরাইট নিলাম।
যেভাবে অভিনয়শিল্পী চূড়ান্ত হয়
মে মাসে ঢাকায় এলেন ঋত্বিক ঘটক। বললাম, এই চরিত্রে ওই অভিনয়শিল্পী, ওই চরিত্রে ওই অভিনয়শিল্পীকে দেখতে পারেন। তিনি সবাইকে দেখলেন। কবরী, রোজী সামাদ, প্রবীর মিত্র, গোলাম মুস্তাফা, রওশন জামিল, আবুল হায়াতকে তিনি চূড়ান্ত করলেন।
অবশেষে মুক্তি
ছবিটি মুক্তি পায় ১৯৭৩ সালের ২৭ জুলাই। প্রথমে ঢাকার চারটি, চট্টগ্রামের দুটিসহ মোট ছয়টি হলে। কিন্তু পরের সপ্তাহে নেমে যেতে থাকে। ছবিটা চলেনি।
বাজেট কত
বাজেট নিয়ে ছবিটির কাজ শুরু করিনি। কিন্তু শেষ হয়েছে যখন, তখন দেখলাম খরচ হয়েছে ৮ লাখ ২২ কি ২৫ হাজার টাকা। তখনকার দিনে ঢাকার গুলশানে ৪০ হাজার টাকায় এক বিঘা জমি কেনা যেত। তখন বাংলাদেশে ছবি হতো এক লাখ সোয়া লাখ টাকায়। হল থেকে দ্রুত নেমে যাওয়ায় টাকা ওঠেনি। তবে রাশিয়াসহ তবে কয়েকটি উৎসবে আমন্ত্রণ পেয়েছিল ছবিটি। রাশিয়াতেও খুব একটা সুবিধা করতে পারেনি ছবিটি। এই ছবি এখন কান ফেস্টিভ্যালের ওয়ার্ল্ড ক্ল্যাসিক সেকশনে আছে, এর চেয়ে বড় পুরস্কার আর কী হয়। টাকার জন্য ছবিটি বানাইনি। ঋত্বিক ঘটককে ভালোবেসে বানিয়েছি। বাবার সাপোর্ট সেভাবে না থাকলেও মায়ের পুরো সাপোর্ট ছিল। স্ত্রীর সাপোর্ট না থেকে উপায় ছিল না। (হাসি)