করোনাকালে সিনেমাশিল্পে একটা বড় ধাক্কা গেছে। সেই ধাক্কা কাটতে না কাটতেই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ঘিরে আরেকবার বিপাকে পড়েছে এই শিল্প। গত শুক্রবার কোনো নতুন সিনেমা মুক্তি পায়নি। এখন হলে পুরোনো কয়েকটি সিনেমা প্রদর্শিত হলেও সেভাবে দর্শকের উপস্থিতি নেই।
শুটিং নেই, নতুন ছবিও নেই
গত কয়েক সপ্তাহ দেশে কোনো নতুন সিনেমা মুক্তি পায়নি। দর্শকের শঙ্কা এখনো কাটেনি। চলচ্চিত্রসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা মনে করেন, হলে দর্শকের উপস্থিতি বাড়তে আরও সময় লাগতে পারে। ২৩ আগস্ট ‘অমানুষ হলো মানুষ’ ছবিটি মুক্তির কথা আছে। তবে ছবিটির মুক্তি পিছিয়ে যেতে পারে জানালেন পরিচালক মনতাজুর রহমান আকবর। তিনি বলেন, ‘অনেক হল ভাঙচুর হয়েছে। আতঙ্কে অনেক হল বন্ধ হয়ে গেছে। দর্শকও তো নেই। সরকার পরিবর্তন হলেও দেশের মধ্যে আতঙ্ক তো এখনো কাটেনি। ২৩ আগস্ট আমার ছবি মুক্তি দেব কি না, এখনো বলতে পারছি না।’
এ ব্যাপারে চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতির সাধারণ সম্পাদক শাহিন সুমন বলেন, ‘আমার জানামতে, কোনো সিনেমার শুটিং চলছে না। এমনিতেই অনেক দিন ধরে সিনেমার সংখ্যাও কম। শুটিং শুরু হতে আরও সময় লাগতে পারে। এ ছাড়া নতুন সিনেমার শুটিংয়ে জন্য যারা এর মধ্যে শিডিউল তৈরি করেছিল, তারাও পিছিয়েছে। আমরা গত মঙ্গলবার পরিচালক সমিতি এসব নিয়ে মিটিং করেছি।’
বন্ধ বেশির ভাগ হল
২৫ জুলাইয়ের পরও নতুন-পুরোনো সিনেমা মিলিয়ে শ খানেক হল চালু ছিল। কিন্তু এক সপ্তাহ ধরে চিত্র পাল্টে গেছে। গতকাল রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, বেশির ভাগ সিনেমা হল বন্ধ। পুরান ঢাকার আজাদ সিনেমা হলে মোস্তফা কামাল রাজ পরিচালিত ওমর সিনেমাটি নতুন করে আবার মুক্তি দেওয়া হয়েছে। তবে দর্শকের উপস্থিতি নেই বললেই চলে। চলচ্চিত্র প্রদর্শক সমিতির হিসাবমতে, ২৫টি হল খোলা আছে। তবে সব হলেই চরম দর্শকখরা। ঈদে মুক্তিপ্রাপ্ত আলোচিত ছবি তুফান গত মাসের শেষেও দেশের সব মাল্টিপ্লেক্সসহ প্রায় ৭০টি একক হলে চলছিল। কিন্তু আগস্টের শুরু থেকে বড় ধাক্কা খেয়েছে। চলতি সপ্তাহে মাত্র আটটি একক হল ও মাল্টিপ্লেক্সে চলছে সিনেমাটি। পাশাপাশি কিছু হলে পুরোনো সিনেমা চলছে।
রায়হান রাফী পরিচালিত ‘তুফান’ ছবির প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান আলফা আই লিমিটেড সূত্রে জানা গেছে, দর্শক কম থাকলেও গত মাসের শেষে ৭০টির বেশি হলে সিনেমাটি প্রদর্শিত হয়েছে। এখন মাত্র আটটি একক হলে চলছে। মাল্টিপ্লেক্সগুলোতে চললেও স্টার সিনেপ্লেক্সের ঢাকা ও রাজশাহীর দুটি শাখায় প্রদর্শনী বন্ধ। অনেক হলে ভাঙচুর, লুটপাট হয়েছে। আবার অনেক হল ভাঙচুরের ভয়ে বন্ধ আছে। তারপরও যে কটি হলে সিনেমাটি চলছে, দর্শক নেই বললেই চলে। তাদের মতে, করোনাকালের পর এত খারাপ অবস্থায় পড়েনি সিনেমা।
হল ভাঙচুর, লুট
৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে স্থাপনা ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে সিনেমা হলও বাদ যায়নি। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে মাল্টিপ্লেক্সসহ প্রায় এক ডজন একক সিনেমা হলে হামলা, ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে। স্টার সিনেপ্লেক্স (রাজশাহী), তাজ সিনেমা (নওগাঁ), আনন্দ সিনেমা (গুরুদাসপুর, নাটোর), তুলি সিনেমা (যশোর), দর্শন সিনেমা (ভৈরব, কিশোরগঞ্জ), মুন সিনেমা (ময়মনসিংহ), গুলশান সিনেপ্লেক্স (নারায়ণগঞ্জ), সিনেস্কোপ (নারায়ণগঞ্জ), রুটস সিনে ক্লাবসহ (সিরাজগঞ্জ) বেশ কয়েকটি হলে ভাঙচুর হয়েছে।
সিরাজগঞ্জের রুটস সিনে ক্লাবটিতে সরকার পতনের রাতেই হামলা হয়। লুটপাটের পর পুরো হল গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক আতিকুর রহমান জানালেন, তাঁদের নিজেদের ছয়তলা বাড়ির নিচতলায় রুটস সিনে ক্লাবটি। তিনি দাবি করেন, বাড়ি ও সিনেপ্লেক্সটি মিলে দুই কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। আতিকুর রহমান জানান, ভাঙচুরের কারণে সিনেমা হলটি বন্ধ আছে। এ বছর আর চালু হবে না। তবে সে ধরনের পরিবেশ না পেলে হলটি আর চালু না-ও হতে পারে বলে ইঙ্গিত দিয়েছে কর্তৃপক্ষ। ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, ‘এমনিতেই এই শিল্পের দুরবস্থা। এখন আবার হলের ওপর আঘাত। দেশের অনেকগুলো হল ভাঙচুরের পর বন্ধ আছে। হল না থাকলে সিনেমাও তো থাকবে না। তাহলে এই শিল্প বাঁচবে কীভাবে?’
সাহায্য চান হলমালিকেরা
ভাঙচুরের শিকার হলমালিকেরা ঘুরে দাঁড়াতে সরকারের সাহায্য চান। রুটস সিনে ক্লাবের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আতিকুর রহমান বলেন, ‘সিনেমার জন্য তো সরকার অনুদান দেয়। বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার যদি ভাঙচুর-লুটপাট করা হলগুলোর জন্য কিছু অনুদানের ব্যবস্থা করে, তাহলে ঘুরে দাঁড়ানো সহজ হবে আমাদের জন্য। আর যদি সে ধরনের পরিস্থিতি তৈরি না করা হয়, তাহলে আমার পক্ষে এই হল মেরামত করে চালু করা আর সম্ভব হবে না।’
সিনেমা হল ভাঙচুর-লুটপাটের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছে হলমালিকদের সংগঠন চলচ্চিত্র প্রদর্শক সমিতি। এর সাধারণ সম্পাদক আওলাদ হোসেন বলেন, ‘এভাবে হল লুটপাট-ভাঙচুর করা হলে সিনেমাশিল্পের অবশিষ্ট যা আছে, তা-ও থাকবে না। আর যেন নতুন করে দেশের কোথাও এ ধরনের ঘটনা না ঘটে।’