একের পর এক সুখবর দিচ্ছেন তরুণ অভিনেত্রী প্রিয়াম অর্চি। গত বছর তাঁর অভিনীত ‘বলী’ সিনেমা বুসান চলচ্চিত্র উৎসবের নিউ কারেন্টস পুরস্কার জয় করে। এবার ‘নির্বাণ’ দিয়ে ৪৬তম মস্কো চলচ্চিত্র উৎসবে লালগালিচায় পা রাখলেন অভিনেত্রী। উৎসবে অর্চির নানা অভিজ্ঞতা নিয়ে লিখেছেন মনজুরুল আলম
‘নির্বাণ’ সিনেমার শুটিং শুরু হয় ২০২২ সালে। তখন করোনায় অনেকেই আক্রান্ত হয়ে মারা যাচ্ছেন। আতঙ্কিত সেই সময়ে তরুণ নির্মাতা আসিফ ইসলামের মাথায় ভর করে, ছোট টিম নিয়ে সিনেমা বানাবেন তিনি। গল্পের ওপর গুরুত্ব দিয়ে নিরীক্ষাধর্মী সিনেমার কাজ শুরু করেন। নিজের ভালো লাগা থেকেই সেই গল্পে নাম লেখান অভিনেত্রী প্রিয়াম অর্চি। গল্প শুনেই মনে ধরেছিল। সেই সিনেমা এখন আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রশংসা পাচ্ছে।
প্রিয়াম অর্চি বলেন, ‘নিজেদের পছন্দ থেকেই সিনেমা বানানো। আইডিয়া একান্ত আমাদের। সেই সিনেমা নিয়ে যখন রাশিয়ার মস্কোর মতো উৎসবে আলোচনা হয়। তারা যখন সিনেমাটিকে নিজেদেরও মনে করে, তখন মনে হয় আমরা সার্থক। বড় এই মঞ্চে সিনেমাটি সমাদৃত হচ্ছে, আমাদের ভাবনার সঙ্গে বিদেশের দর্শক, সিনেমার সমালোচকেরা কানেক্ট হচ্ছে। এটাই আমাদের বড় প্রাপ্তি। যুক্তরাজ্য থেকে রাশিয়ায় আসা সফল।’
শ্রমিক বেশে এক মাস
গাজীপুরের একটি ফ্যাক্টরিতে এক মাস ধরে কাজ করেছেন প্রিয়াম অর্চিরা। সেখানে তাঁদের পরিচয় গোপন ছিল। অন্য শ্রমিকেরাও ভেবেছিলেন, তাঁরা নতুন এই ফ্যাক্টরিতে যোগ দিয়েছেন। কিন্তু পরিচালকের কথা মতো তাঁদের এ সময় চলতে হয়েছে। কারণ, এই গল্পই পর্দায় তুলে ধরবেন। পরে যখন শুটিং হয়, তখন লোকেশনটি নতুন মনে হয়নি। চরিত্রের সঙ্গে সহজে মানিয়ে গিয়েছিলেন।
প্রিয়াম বলেন, ‘আমাদের সিনেমায় কোনো সংলাপ নেই। সিনেমাটিতে তিন কর্মীর যাপিত জীবনের চিত্র উঠে এসেছে। মনস্তাত্ত্বিক অনেক বিষয় সিনেমায় দেখানো হয়েছে। একটি ফ্যাক্টরির কর্মীদের আসা-যাওয়ার মাঝে অনেক গল্প থাকে, সেগুলো তুলে ধরা হয়েছে। যেটাকে আমরা মেডিটেশনের সঙ্গে তুলনা করেছি। মেডিটেশনে যেন শুরুতেই প্রবেশ করা কঠিন কিন্তু একবার প্রবেশ করলে পরে আর কঠিন মনে হয় না। সিনেমা দেখে দর্শকেরা সেই কথাই বলছিল। কিন্তু সিনেমাটির মন্থরগতি নিয়ে আমরা কিছুটা চিন্তিত ছিলাম। এখন মনে হচ্ছে, সেখানে আমরা উতরে গেছি।’
তিন পাতার চিত্রনাট্য
শুরুতে সিনেমার চিত্রনাট্য ছিল তিন পাতার। কিন্তু গল্পের পরিসর ছিল বড়। যে কারণে এক বছর ধরে চলে সিনেমার শুটিং। এতে তুলে ধরে হয়েছে ঋতু পরিবর্তনসহ বেশ কিছু পরিবর্তন। বেড়েছে চিত্রনাট্যের পাতা। ‘শুধু একটি আইডিয়া থেকে সিনেমার কাজ শুরু করেন পরিচালক ও লেখক। সময়ের সঙ্গে সিনেমায় অনেক কিছু যোগ হয়। শুটিংয়ের পর সিনেমাটি এডিটিং প্যানেলে তৈরি করা। সেখানে দীর্ঘ একটা সময় ধরে প্রতিটি ইমোশন নিয়ে কাজ করতে হয়েছে,’ বলেন প্রিয়াম।
‘বলেছি, আমি বাংলাদেশি’
প্রিয়ামের জন্য অন্য রকম অভিজ্ঞতা ছিল মস্কো চলচ্চিত্র উৎসবের লালগালিচায় হাঁটার পর্ব। এত বড় আয়োজনে আগে অংশ নেওয়ার অভিজ্ঞতা হয়নি। তাই শুরু থেকেই চেয়েছিলেন, বাংলাদেশের সংস্কৃতিকে তুলে ধরবেন। শাড়ি পরে প্রিয়াম ও পরিচালক লালগালিচায় হাঁটেন। কিন্তু অনেকেই প্রিয়ামকে ধরে নেন, বলিউড থেকে আসা কোনো অভিনেত্রী।
তখন তিনি গর্ব করে বলেছেন, ‘বলেছি আমি ভারতের কেউ নই, বাংলাদেশের মেয়ে।’ তিনি আরও বলেন, ‘রাশিয়ার আবহাওয়া বোঝা যায় না। লালগালিচার পর হঠাৎ করেই মেঘ। বেড়ে গেল শীত। আমাদের সিনেমার স্ক্রিনিংয়ের পর আমি রাস্তায় দাঁড়িয়ে কাঁপছিলাম। আমাদের গাড়ির জন্য অপেক্ষা করছিলাম। তখন রাশিয়ার এক পরিচালক নিজের কোট খুলে আমাকে দেন। পরে তাঁদের সঙ্গে আড্ডা জমে যায়। তাঁরাও ভেবেছিলেন, আমরা ভারত থেকে এসেছি।’
চিন্তিত প্রিয়ামরা
বিশ্ববাজারে কিছুটা হলেও স্বাধীন ঘরানার সিনেমার দর্শক রয়েছে। সেভাবে সিনেমাগুলো নিয়ে প্রচার হয়। সিনেমাগুলোর দর্শক তৈরি নিয়ে কাজ করা হয়। কিন্তু বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এই সিনেমাগুলোর ভবিষ্যৎ নিয়েই চিন্তিত প্রিয়াম ও পরিচালক আসিফ ইসলাম। এই অভিনেত্রী মনে করেন, এই ঘরানার সিনেমার দর্শকদের আলাদা একটি ‘হাব’-এ নিয়ে আসতে পারলে ভালো। কারণ, অনেক তরুণ দর্শক এই সিনেমা দেখতে চান। কিন্তু তাঁদের কাছে একই মাধ্যম থেকে সিনেমাটি সম্পর্কে তথ্য পৌঁছে দেওয়া হলে দর্শক তৈরি করা হবে। না হলে এই ঘরানার সিনেমা নির্মাণে তরুণেরা আগ্রহ পাবেন না। পিছিয়ে যাবে শৈল্পিক ও আন্তর্জাতিক মানের কাজ।’