মায়ের সঙ্গে অন্যরকম এক বন্ধুত্ব ছিল চিত্রনায়ক আরিফিন শুভর। মায়ের কাছে সব সন্তানের মতো তিনিও ছিলেন শিশুর মতো। মাকে ঘিরেই ছিল তাঁর দিন আর ব্যস্ততা। মায়ের সঙ্গে ছায়ার মতো থাকা শুভ আজ বাক্রুদ্ধ। এই অভিনেতা আজ তাঁর মমতাময়ী মাকে হারিয়েছেন। কিন্তু মায়ের জন্য কষ্ট; মায়ের সুখের দিনগুলো অসুস্থতা কেড়ে নিয়েছিল। টানা ৯ বছর এই অভিনেতাকে ভাবিয়েছে, মাকে বুঝি শান্তি দিতে পারলাম না।
শুভ বেশির ভাগ সময় চেষ্টা করতেন মায়ের সঙ্গে সময় কাটানোর। দারুণ সেই সময়গুলো আড্ডায় মেতে উঠতেন মা–ছেলে। এই তো গত মাসেও মায়ের সঙ্গে ফেসবুকে রিল বানিয়েছিলেন শুভ। মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে ছোট শিশুর মতো শুয়ে ছিলেন এই চিত্রনায়ক। নিজে খাচ্ছিলেন আর শিশুর মতো করে বলছিলেন, ‘মা, খাবা।’
শক্ত খাবার খাবেন না বলে সেই ভিডিওতে শুভর মাকে বলতে শোনা যায়, ‘ওরে সর্বনাশ, নারে বাবা।’ তারপর মা–ছেলের একে অন্যের দিকে তাকিয়ে মনজুড়ানো হাসি। পরে শুভ মায়ের কাছে মজার ছলে জানতে চান—‘মা আমাকে কই থেকে দত্তক আনছিলা?’ মা বলেন, ‘তোকে দত্তক আনব কেন, পেটে থেকে আনছি?’ মায়ের সঙ্গে শুভর এই খুনসুটির ভিডিও দর্শকেরা পছন্দ করেছিলেন, নিজেদের সঙ্গে ভাগাভাগি করে নিয়েছিলেন।
কিশোর থেকেই শুভ ছিলেন লাজুক প্রকৃতির। ছিলেন মা-বাবার ভক্ত। বেড়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে তাঁর জীবনের সবচেয়ে বড় প্রেরণা হয়ে উঠছিলেন তাঁর মা খাইরুন নাহার। বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে তরুণদের কোনো পরামর্শ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে শুভ সবার আগে জানাতেন, ‘মা-বাবার প্রতি ভালোবাসার কথা। তাঁদের বেশি গুরুত্ব দিতে বলতেন। একটা বয়সের পরে তাদের বেশি সময় দিতে। তিনি নিজেও সবচেয়ে বেশি চিন্তিত ছিলেন মায়ের অসুস্থতা নিয়ে। ৯ বছর ধরে তাঁর মা সিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত ছিলেন। কাজের বাইরে সময়গুলো মায়ের সঙ্গেই কাটাতেন অভিনেতা।
এর আগে গত বছর অক্টোবরে মায়ের সঙ্গে শুভর আরও একটি ভিডিও ভাইরাল হয়। সেবার শুভকে বেশ কিছুদিনের জন্য ঢাকার বাইরে যেতে হয়। তার আগে ভিডিওটি প্রকাশ করেন শুভ। সেই সময় মায়ের সঙ্গে কাটানো ও কথোপকথনের ৪২ সেকেন্ডের ভিডিওটি ভাইরাল হয়।
ভিডিওতে শুভ বলেন, ‘মা, সুন্দরভাবে হবে তো কাজটা?’ মা তাকে আশীর্বাদ করেন। আবার মাকে বলেন, ‘মা তুমি কি আমাকে মিস করবা? মা বলেন, ‘হ্যাঁ’। শুভ বলেন, ‘মিথ্যা কথা।’ ‘কইতাছি না মিস করব, তুই এত দিন দেশে থাকবি না।’ পরে মাকে জড়িয়ে ধরে শুভ বলেন, ‘এটা পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি মিথ্যা কথা।’ মা তাঁর কথা ফেলতে দেন না। পরক্ষণেই ছেলের দিকে তাকিয়ে বলেন, ‘নারে বাজান, সত্যি মিস করব।’
মাকে ঘিরে কত আশা ছিল, স্বপ্ন ছিল। সেগুলো কিছুই হচ্ছিল না। কারণ, মায়ের অসুস্থতার কারণে গত ৯ বছর মাকে নিয়ে তেমন বের হননি এই অভিনেতা। কারণ, ব্যস্ত মায়ের জীবন হঠাৎ করে থেমে গিয়েছিল। এটা যেন শুভর জীবনের দীর্ঘ এক কষ্টের অধ্যায়। এই কষ্ট অসুস্থতা। যে কারণে বেশির ভাগ সময় বাসাতেই থাকতেন। শুভকেও থাকতে হতো বাসায়। গত বছর তাঁর মা খাইরুন নাহার মা পদক পেয়েছিলেন। সেদিন যেন নিজেকে ধন্য মনে করেছিলেন এই তারকা। মাকে নিয়ে পুরস্কার নিতে হাজির হয়েছিলেন।
পরে আরও একবার বের হয়েছিলেন। সেদিন মায়ের সঙ্গে ছবি পোস্ট করে শুভ লিখেছিলেন, ‘এই মানুষটা আমার নায়ক, এইটুকু বলতে পারি, এই মানুষটার যে ধৈর্য, সেটার এক পয়সাও যদি আমি পেতাম, আমি পৃথিবীর সব থেকে সুখী আর সফল মানুষ হতাম। ও মা, রিকশায় করে একটু নদীর পাড়ে ঘুরতে নিয়ে যাও না প্লিজ।’
অনেক দিন পর্যন্ত ছেলের কোনো সিনেমা দেখেননি মা। এটা ছিল শুভর জন্য আফসোসের। শুভ নিজেও চাননি অসুস্থ মাকে বাইরে নিয়ে যেতে। তারপরও শেষবার এই সুযোগ হয়েছিল। গত বছর মুক্তি পাওয়া শুভর ‘ব্ল্যাক ওয়ার’ সিনেমা মা-ছেলে পাশাপাশি বসে দেখেছিলেন। সেই সিনেমা দেখার স্মৃতি তাঁর অভিনয়জীবনের অন্যতম ছিল।
সেদিন শুভ বলেছিলেন, ‘আমার সিনেমার ১৩ বছরের ক্যারিয়ার। এই সময়ে এই প্রথম মাকে নিয়ে সিনেমা হলে একসঙ্গে আসছি। মায়ের সঙ্গে বসে সিনেমা দেখা আমার সত্যিই সবচেয়ে বড় পাওয়া। কারণ, মা মানসিক ও শারীরিকভাবে অসুস্থ। তারপরও মা আমার সঙ্গে গিয়ে সিনেমাটি দেখেছেন, এটাই আমার জন্য অত্যন্ত খুশির খবর। মায়ের হাসিমুখের চাহনি আমার সব তৃপ্তি এনে দিয়েছে। এ অনুভূতি কিছু শব্দে প্রকাশ করা কখনো সম্ভব নয়।’
ছেলের প্রথম সিনেমা দেখে মায়ের অনেক কৌতূহল ছিল। পাশে বসে আছেন ছেলে। সেই ছেলে কীভাবে সিনেমার মধ্যে দুবাই গেলেন, কেন সিনেমার মধ্যে মারামারি করছেন। কেন এত গোলাগুলি। এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজেছেন মা। সেই সময় মাকে সব বুঝিয়ে বলেছেন শুভ। তবে শুভর জন্য সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি ছিল, সিনেমাটি তাঁর মায়ের পছন্দ হয়েছিল। উপভোগ করেছিলেন সিনেমাটি।
আরিফিন শুভর সঙ্গে তাঁর মায়ের সম্পর্ক ছিল সবকিছুর ঊর্ধ্বে। মাকে নিয়ে কখনো কথা বলতে গেলে আবেগপ্রবণ হয়ে যেতেন এই তারকা। মায়ের প্রসঙ্গে কথা বলতে গিয়ে শুভ জানিয়েছিলেন, ‘আমি আসলে ওই মহিলার বাবা। আমাদের সম্পর্কটা উল্টো। এখন সম্পর্কটা এমন হয়ে গেছে। মা আমার ছয় কি সাত বছরের শিশু আর আমি তাঁর বাবা।’
শুভর মা বিমা কোম্পানিতে চাকরি করতেন। শুরুর দিকে মায়ের বেতন ছিল ৯ হাজার টাকা। মায়ের সংগ্রাম দেখে একটু একটু করে নিজেকে এগিয়ে নিয়েছেন শুভ। মায়ের মতো একসময় পরিশ্রমী হয়ে ওঠেন এই তারকা। নিজেকে তৈরি করেন। কিন্তু ধীরে ধীরে সবকিছু গুছিয়ে শুভ যখন স্বপ্ন দেখছিলেন, মা এখন থেকে শুধুই আরাম করবেন, তখনই অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি। মাকে নিয়ে এক সাক্ষাৎকার জানিয়েছিলেন, ‘আমি আমার মাকে যদি একটু শান্তি দিতে পারতাম, যেটা সে কোনো দিন পায়নি।’