‘বলী’ সিনেমার দৃশ্য। ছবি : পরিচালকের সৌজন্যে
‘বলী’ সিনেমার দৃশ্য। ছবি : পরিচালকের সৌজন্যে

শক্তি আর কৌশলের খেলার চেয়ে বেশি কিছু ‘বলী’

১৯৯৬ সালে যাত্রা শুরুর সময় থেকে নিউ কারেন্টস বিভাগ দক্ষিণ কোরিয়ার বুসান চলচ্চিত্র উৎসবের গুরুত্বপূর্ণ বিভাগ হিসেবে স্বীকৃত। সারা বিশ্বের চলচ্চিত্রবোদ্ধা-সাংবাদিকদের বিশেষ দৃষ্টি থাকে এশিয়ার সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ এই উৎসবের প্রতিযোগিতামূলক শাখার দিকেই। এর বড় কারণ, শুধু এই বিভাগের জন্যই উৎসবের ৩০ হাজার ডলারের সবচেয়ে বড় দুটি পুরস্কার (গ্র্যান্ড প্রাইজ) ‘নিউ কারেন্টস অ্যাওয়ার্ড’। এর বাইরে এই বিভাগের ছবি বিবেচিত হয় নেটপ্যাক, ফিপ্রেসকি ও ক্রিটিকস বি অ্যাওয়ার্ডের জন্যও। বুসানের ২৮ বছরের ইতিহাসে এর আগে বাংলাদেশের একটি মাত্র ছবি এই বিভাগে জায়গা করে নিয়েছিল—‘জালালের গল্প’।  

‘বলী’ সিনেমার দৃশ্য। ছবি : পরিচালকের সৌজন্যে

গুরুত্বপূর্ণ এই বিভাগেই এবারে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ থেকে মনোনয়ন পেয়েছে একসঙ্গে দুটি ছবি—ইকবাল হোসাইন চৌধুরীর ‘বলী’ (দ্য রেসলার) ও বিপ্লব সরকারের ‘আগন্তুক’। নানা প্রতিকূলতা পেরিয়ে ইকবাল হোসাইন চৌধুরীকে প্রথম সিনেমা বলী নির্মাণ করতে হয়েছে। প্রথম আলোর সঙ্গে হোয়াটসঅ্যাপ আলাপে নির্মাণের পেছনের সেই অজানা গল্পই তিনি ভাগাভাগি করলেন।

২০১৪ সালের কথা। তখন বলী ছবির চিত্রনাট্যের প্রথম খসড়া লেখার কাজ হয়। পরিচালকের ভাবনা ছিল ‘বলী’কে ৪০ মিনিটের স্বল্পদৈর্ঘ্য সিনেমা বানানো হবে। সব পরিকল্পনা চূড়ান্ত, শুটিংয়ের আগের দিন বেঁকে বসলেন ছবির মূল অভিনেতা। ভেস্তে গেল সব। ইকবাল বলেন, ‘পরবর্তী সময় এই গল্পটাকে আমি বেছে নিয়েছি নাকি, গল্প আমাকে বেছে নিয়েছে, জানি না।’

দেশের প্রেক্ষাপটে সিনেমা নির্মাণ মানেই নানা প্রতিকূলতা। তবে এসব পাত্তা না দিয়ে ২০২১ সালে ‘বলী’ সরকারি অনুদান পায়।

ইকবাল হোসাইন চৌধুরী

পরিচালক বলেন, ‘পিপলু আর খানের অ্যাপল বক্স প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান সঙ্গে থাকায় আমাদের জন্য কাজটা আসলে খুব কঠিন হয়নি। আমার নির্বাহী প্রযোজক তানভীর হোসেন, সহপ্রযোজক সাইফুল আজিমের অসামান্য সহযোগিতার কথা আলাদাভাবে বলতে হয়। এর বাইরে, ছবির ভিএফএক্স খুব চ্যালেঞ্জিং ছিল। পানির নিচের দৃশ্য ধারণ করতে গিয়ে আমাদের অনেক ঝামেলায় পড়তে হয়েছে। অভিনেতাদের বলীখেলা শেখানোর জন্য আমাদের দুজন বলী খুঁজে আনতে হয়েছে সেই কুতুবদিয়া থেকে।’

এরপর দীর্ঘ সময় যায় প্রি-প্রোডাকশনে। একঝাঁক তরুণমুখ নিয়ে গত বছর শুরুর দিকে বলীর শুটিং শুরু হয়। সিনেমার প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেছেন নাসির উদ্দিন খান। তাঁর ওপর কেন ভরসা করলেন—এমন প্রশ্নে ইকবাল বলেন, ‘কারণ, তাঁর চেয়ে ভালো কোনো বিকল্প আমার হাতে ছিল না। ২০২২ সালে যখন ওনাকে ছবিতে নিই, তিনি তখন “অ্যালেন স্বপন” হয়ে ওঠেননি। নাসির উদ্দিন অন্তত আমার কাছে যেকোনো বিচারে বিশ্বের বড় মাপের অভিনেতাদের একজন।’

‘বলী’ সিনেমার দৃশ্য। ছবি : পরিচালকের সৌজন্যে

পরিচালক আগে ছিলেন সাংবাদিক। সেখান থেকে চলচ্চিত্র নির্মাণে আসার গল্পটা একদমই আলাদা। নতুন করে আবার শুরু করতে হয়েছে। ইকবাল বলেন, ‘কানাডার ইয়র্ক ইউনিভার্সিটির ফিল্ম অ্যান্ড মিডিয়া বিভাগ আমাকে দুই বছরের জন্য ফেলোশিপ দিয়েছে। সাধারণত যাঁরা কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিল্ম প্রোডাকশন পড়েন, তাঁরা ফিল্ম ফিলোসফি পড়েন না। আমার সমস্যা, আমি দুটোই পড়েছি। সিনেমার দুটো দিকই আমার সমান পছন্দ।’

চুপিসারেই পরিচালক গত বছর সিনেমার শুটিং শেষ করেন। এরপর বাকি কাজ হয় কানাডায়। এই সময় ট্রেলার, টিজার কোনো কিছুই প্রকাশ করেননি; গল্প নিয়েও জানাননি। এই প্রসঙ্গে ইকবাল বলেন, ‘এখন বাংলাদেশের ওটিটি কনটেন্ট বা অনেক সিনেমাও তাদের মার্কেটিংয়ে বড় বাজেট খরচ করে। আমাদের সেই বাজেট বা সুযোগ ছিল না। তাই ভাবলাম উল্টোটা করি। কাউকে নাই বলি, আমাদের ছবির শুটিং শেষ, সরকারের উপদেষ্টা কমিটি আমাদের সিনেমার চূড়ান্ত কপি দেখে উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছে ইত্যাদি।’

একজন তরুণ, তিনবারের চ্যাম্পিয়ন বলী খেলোয়াড়কে চ্যালেঞ্জ করেছে একজন বয়স্ক লোক—এটাই গল্প। কিন্তু ‘বলী’ আসলে স্রেফ এই শক্তি আর কৌশলের খেলার চেয়ে বেশি কিছু। গল্প সম্পর্কে আপাতত এটুকুই বলতে চান পরিচালক। তিনি জানান, ছবিটি পুরোপুরি তৈরি হয়েছে সবেমাত্র মাস কয়েক হলো। এরপরই প্রথম সংবাদ এল বুসান উৎসব থেকে। ইকবাল বলেন, ‘“বলী”কে সরাসরি নিউ কারেন্টস বিভাগে আমন্ত্রণ জানিয়েছে, আমরা সেটাকে খুবই সম্মানের সঙ্গে গ্রহণ করেছি। আমরা বুসান উৎসব কর্তৃপক্ষের কাছে কৃতজ্ঞ। নিউ কারেন্টসে একই বছরে দুটো ছবি, এটা বাংলাদেশের সিনেমার ইতিহাসে অবশ্যই একটি অবিস্মরণীয় ঘটনা। কিম জিসুক বিভাগে শ্রদ্ধেয় নির্মাতা মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর সিনেমাও আছে। সব মিলিয়ে বিশ্বের অনেক বড় পত্রিকা এই সুবাদে বাংলাদেশকে তাদের শিরোনামে এনেছে।’ ‘বলী’ নিয়ে সামনের পরিকল্পনা জানতে চাইলে পরিচালক বলেন, ‘আমি এখন পরের সিনেমা লিখছি। “বলী” নিয়ে বাকি ভাবনা আমার প্রযোজকেরা করবেন।’