তরুণ এক চলচ্চিত্রপ্রেমী। মাত্র অনার্স দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী। দেখতে তাঁকে অনেকটাই ছোট মনে হয়। সহকারী পরিচালক হিসেবে মানানসই। তিনিই কাজী হায়াৎ, মনতাজুর রহমান আকবর, দেলোয়ার জাহান ঝন্টু, জাকির হোসেন রাজুদের মধ্যে এলেন সিনেমা বানাতে। গল্প নিয়ে ঘুরছেন। কিন্তু তরুণ বলে কোনো উপায় পাচ্ছেন না।
এর কারণ এই তরুণ ছোকরার ওপর আস্থা ছিল না প্রযোজকদের। কেউ কেউ মুখের ওপর জানিয়ে দিয়েছেন, তাঁর ওপর আস্থা নেই। প্রযোজকদের দরজায় ঢুঁ মেরে ক্লান্ত এই নির্মাতা। সেই তরুণ সিনেমা বানানোর জন্য কঠিন এক সিদ্ধান্ত নিলেন। নিজেদের বাড়ি বিক্রি করবেন। এই কথা শুনে তাঁর বাবা যেন আকাশ থেকে পড়লেন। বলছি মোস্তাফিজুর রহমান মানিকের সিনেমা ‘দুই নয়নের আলো’র নির্মাণের কথা। সেই সিনেমাটি আজ মুক্তির দুই দশকে পড়ল।
দুই দশক পূর্তি উপলক্ষে সিনেমাটির পরিচালক শোনালেন প্রথম সিনেমা নির্মাণের গল্প। যে গল্পটা ছিল সিনেমার মতো। তিনি জানান, সব ঠিক হলেও বাড়ি বিক্রি নিয়ে জটিলতায় পড়ে যান। পরিবার রাজি নয়। এদিকে সিনেমার জন্য টাকা দরকার। মানিক বলেন, ‘তখন অনেক ঝামেলা হয়েছে। মধ্যবিত্ত পরিবার কি বাড়ি বিক্রি করতে চায়। আমার নিজের কাছেও কষ্ট লাগছিল। পরে সব বুঝে মা বোন–বাবাকে রাজি করায়। সেই টাকা দিয়ে শুরু হয় সিনেমা নির্মাণের কাজ। নিজেই সিনেমার প্রযোজক হয়ে যাই।’ মানিকের এই সিনেমায় নাম লেখান জনপ্রিয় অভিনেত্রী শাবনূর। দীর্ঘ ক্যারিয়ারে শাবনূরকে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার এনে দেয় সিনেমাটি।
মানিক বলেন, ‘আমার বয়স খুব কম হওয়ার কারণে এ যাত্রাটি আমার জন্য পরতে পরতে কঠিন ছিল। সিনেমার জন্য আমি কোনো প্রযোজক পাইনি। এটা একটা কষ্ট। আমার মনে সাহস ছিল যেভাবেই হোক সিনেমাটি আমি বানাবই। পরে বাড়ি বিক্রির পরে একটা দায়বদ্ধতা তৈরি হলো। আরও বেশি মনোযোগ দিয়ে কাজটি করেছি। আমার কাছে মনে হচ্ছিল সব ঠিক থাকলে আমি উতরাতে পারব। সেটিই হয়েছে।’
মানিক তখন নতুন পরিচালক হলেও সিনেমায় প্রধান চরিত্রে অভিনয়ের জন্য তাঁর প্রথম পছন্দ ছিল শাবনূর। কিন্তু শাবনূর তখন তুমুল জনপ্রিয়। তাঁর শিডিউল পাওয়া মানে পরিচালকদের কাছে সোনার হরিণ পাওয়ার মতো। এদিকে প্রথম দিকে সিনেমাটিতে অভিনয়ের ব্যাপারে শাবনূরের আগ্রহ ছিল না। সিনেমার পরিচালকের কথা শুনে গুরুত্ব দেননি। কারণ, ২৩ বছরের এক তরুণ এই সিনেমা বানাতে চান। সেই সময়ে তরুণেরা চাইলেও সহজে সিনেমা বানাতে পারতেন না। লগ্নি পেতেন না। ভালো তারকার শিডিউল পেতেও হিমশিম খেতে হতো।
পরে সেই শাবনূরই পরিচালককে অবাক করেছিলেন। একটানা ৪০ দিন শিডিউল দিয়ে দেন। শুটিংয়ে ছিলেন সবচেয়ে বেশি মনোযোগী। তরুণ পরিচালক মোস্তাফিজুর রহমান মানিকের কাছে যেন সবাই অবাক করার মতো ছিল। এই পরিচালক বলেন, ‘আমি “ভালোবাসা কারে কয়” নামের একটি সিনেমার সহকারী হিসেবে কাজ করি। সেই সিনেমার নায়িকা ছিলেন শাবনূর। তখন থেকেই চিনতেন। পরে একদিন আপাকে বললাম, আপনাকে নিয়ে আমি একটি সিনেমা বানাব। কিন্তু তিনি কোনো গুরুত্বই দিলেন না। আমার গল্পের জন্য তাঁকেই দরকার। উপায় না পেয়ে আমার বস জাকির হোসেন রাজু ভাইকে বললাম।’
সহকারীর সিনেমা বানানোর কথা শুনে জাকির হোসেন রাজু আর কিছু বললেন না। নির্মাণের পরিকল্পনা শুনে আশ্বস্ত হলেন। কিছু পরামর্শও দিলেন। প্রথম মিথ্যা বলে শাবনূরের কাছে গল্প দিয়ে পাঠালেন মানিককে। ‘রাজু ভাই শাবনূরকে ফোন দিয়ে বললেন, ‘‘আমি একটি সিনেমা বানাব। তোমার সঙ্গে একটি ছেলে দেখা করবে।’’ আমি শাবনূরের বাসায় গেলাম। তাঁকে গল্প শোনালাম। গল্প ও গানগুলো শুনে আপা দারুণ খুশি। পরে জানতে চাইলেন, ‘সিনেমা বানাবে কে?’ বললাম আমি। শুনে তিনি আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন। প্রথমে ভেবেছিলেন, পরিচালক জাকির হোসেন রাজু সিনেমাটি নির্মাণ করবেন। কিন্তু গল্প ভালো লাগায় আমাকে তেমন কিছু বলতে পারছিলেন না।’ বলেন মানিক।
পরে শুরু হয় শুটিং। রিয়াজ, ফেরদৌসসহ বেশ কিছু অভিনয়শিল্পী ছিলেন। তাঁরা সবাই পরিচালককে সহায়তা করেন। তবে সিনেমার চিত্রনাট্য পড়ে অবাক হয়ে যান ফেরদৌস। তিনি শুটিংয়ে প্রথম শাবনূরকে জানিয়েছিলেন এই সিনেমায় সে ঠিকমতো অভিনয় করলে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পাবে। সিনেমার প্রয়াত চিত্রগ্রাহক এম এইচ স্বপনও তাঁকে আগেই জানিয়েছিলেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারের কথা।
সেই অভিজ্ঞতা ভাগাভাগি করে পরিচালক বলেন, ‘শাবনূর, ফেরদৌস, রিয়াজ, শাকিল খানসহ সব তারকা আমাকে সহায়তা করেছেন। সিনেমাটির শুটিংয়ের সময় পুরস্কার পাবে কি না, এটা আমার মাথায় ছিল না। কিন্তু শিল্পী, ক্যামেরাম্যান, কলাকুশলীরা সবাই আগ্রহ নিয়ে কাজটি করছেন, এটা আমাকে অনুপ্রাণিত করেছে। একবার সিনেমার শুটিং শেষে শাবনূর আমাকে পরীক্ষার কেন্দ্রে গাড়িতে পৌঁছে দিয়েছিলেন। রিয়াজ, ফেরদৌস ভাই সব সময় সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন।’
সেই ‘দুই নয়নের আলো’ সিনেমাটি পরে তিনটি শাখায় জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পায়। দেখতে দেখতে ‘দুই নয়নের আলো’ আজ ২০ বছরে পা দিল। সিনেমাটি মুক্তির পরে ব্যবসাসফল হয়। সাবিনা ইয়াসমীন, অ্যান্ড্রু কিশোর, সুবীর নন্দী, কুমার বিশ্বজিৎ, মনির খান ও বেবী নাজনীনদের গানগুলো জনপ্রিয় হয়। সবশেষে পরিচালক বলেন, ‘সিনেমার জন্য বাড়ি বিক্রি করেছিলাম সেই আফসোস আর পরে হয়নি। সিনেমাটি দর্শকদের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়েছিল, আমাকে আর পেছনে তাকাতে হয়নি, সেটাই ছিল বড় প্রাপ্তি। এই চলচ্চিত্রটি সব সময় আমার জীবনে বিশেষ স্মৃতি হয়ে থাকবে।’