দুই দশক ধরে স্টার সিনেপ্লেক্স দেশ-বিদেশের সিনেমা প্রদর্শন করে আসছে। নতুন করে বাড়ছে সিনেপ্লেক্সের পরিধি। ‘তৃতীয় দশকের স্বপ্ন’ এমন শিরোনামে দেশি-ভিনদেশি সিনেমা প্রসঙ্গে গতকাল সোমবার সন্ধ্যায় রাজধানীর ঢাকা ক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে স্টার সিনেপ্লেক্স কর্তৃপক্ষ। সংবাদ সম্মেলনে দর্শক-খরার কারণে সম্প্রতি স্টার সিনেপ্লেক্স থেকে ‘ডেডবডি’ সিনেমা প্রদর্শন বন্ধ করে দেওয়ার কারণে পরিচালকের ক্ষোভের প্রসঙ্গেও কথা বলেছেন প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান ও সংসদ সদস্য মাহবুব রহমান।
দুই দশকের যাত্রাপথে স্টার সিনেপ্লেক্স দেশ-বিদেশের ছবি প্রদর্শন করে আলোচনায় এসেছে। একই সময় বাইরের দেশের সিনেমার তুলনায় দেশের সিনেমা প্রদর্শনের ক্ষেত্রে বৈষম্যের অভিযোগেও অভিযুক্ত হয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। দেশের চলচ্চিত্রের কোনো কোনো নির্মাতা অভিযোগ করে বলেন, সিনেপ্লেক্স বাংলাদেশের সিনেমা প্রদর্শনে প্রাধান্য দেয় না! গেল সপ্তাহে মুক্তিপ্রাপ্ত এমডি ইকবাল পরিচালিত ‘ডেডবডি’ মুক্তির দুদিন পরই সিনেপ্লেক্স থেকে নামিয়ে দেওয়া হয়। এতে পরিচালক অভিযোগ করেন, সিনেপ্লেক্স বাংলা সিনেমার ভালো চায় না বলে ‘ডেডবডি’ তাই সেখান থেকে নামিয়ে দিয়েছে।
এমনকি দুই দিন আগে এফডিসিতে সংবাদ সম্মেলন ডেকে সিনেপ্লেক্স কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে অভিযোগের তির ছোড়েন। ইকবাল বলেছেন, ‘স্টার সিনেপ্লেক্সের নভো থিয়েটার শাখায় ডেডবডি সিনেমার একটি শো দিয়েছে। যেটির কখনো নাম শুনিনি, সেখানে ‘ডেডবডি’ সিনেমার শো দিয়েছে। আর স্টার সিনেপ্লেক্সের মিরপুর শাখায় একটি শো দিয়েছে, যার টিকিট মূল্য ৫০০ টাকা। ইকবাল দাবি করেছেন, এসব কারণে তিনি নিজেই তাঁর ম্যানেজারকে সিনেপ্লেক্স থেকে ছবি নামিয়ে দিতে বলেছেন।
‘ডেডবডি’ ছবির পরিচালকের এমন অভিযোগে অসন্তোষ প্রকাশ করে সিনেপ্লেক্সের চেয়ারম্যান মাহবুব রহমান বলেন, ‘যে অপবাদ দেওয়া হচ্ছে এতে সিনেপ্লেক্সের সবাই কষ্ট পেয়েছে। এখানে আমার বা সিনেপ্লেক্সের কোনো হাত নেই। আমি কোনো ব্যক্তি বা ছবির বিপক্ষে নই। ব্যবসা হলে প্রফিট সিনেপ্লেক্সের হবে। কিন্তু কোনো ছবি সিনেপ্লেক্সে দর্শক না দেখে, সেটা আমাদের দোষ নয়। এটা ছবি-সংশ্লিষ্টদের ব্যর্থতা। তারা ঠিকমতো প্রমোশন করেনি, ভালোমতো ছবিটি বানাতে পারেনি। প্রেস কনফারেন্স করে বলা হচ্ছে ‘সিনেপ্লেক্সকে কন্ট্রোল’ করতে হবে। আপনারা কিসের কন্ট্রোল করবেন? বিনিয়োগ করে রিস্ক নিচ্ছি আমি, আপনারা কেন কন্ট্রোল করবেন? এখানে গডফাদার আনতে চাচ্ছে কি না, জানি না।
মাহবুব রহমান রুহেল বলেন, ‘কথাগুলো বাধ্য হয়ে বলছি, সিনেপ্লেক্সে যাঁরা ছবি দেখেন, তাঁরা এসব ছবি (ডেডবডি) দেখতে চান না। আমাদের সার্ভে অনুযায়ী ১৯৯৭ সালের দিকে জন্ম যাঁদের, সেই প্রজন্ম বেশি ছবি দেখতে আসে। তারা ভালো গল্পের আধুনিক ছবি চায়। কিন্তু এসব না করে যা ইচ্ছা ও মানহীন ছবি দিয়ে যদি জোর করে বলা হয়, সিনেপ্লেক্সে দেখাতে হবে— এটা তো হবে না। ‘ডেডবডি’ চালানোর জন্য উনি (ইকবাল) আমাকে বারবার বলেছেন। ভেবেছি, এতবার যেহেতু বলছে দিয়ে দেখি কী হয়। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত এ ছবি দর্শক দেখেইনি, বরং নেগেটিভ প্রতিক্রিয়া দিয়েছে। আমাদের দর্শকেরা বলেছে, সিনেপ্লেক্সে এই টাইপের ছবি দেখতে চাই না। শিক্ষিত, উচ্চবিত্ত এবং মধ্যবিত্তরা আমাদের নিয়মিত দর্শক। তারাই আমাদের কাছে রাজা। এমন কোনো ছবি আমরা দেখাব না যে আমাদের ব্র্যান্ড ক্ষতিগ্রস্ত হবে।’
মানহীন ছবি নির্মাণের বিরুদ্ধে ক্ষোভ ঝেড়ে মাহবুব রহমান রুহেল বলেন, ‘যে যা ইচ্ছে ছবি বানাবে, তাই আমাকে দেখাতে হবে—এটা তো হতে পারে না। সিনেপ্লেক্স একটি শপ (দোকান) এবং ছবি হচ্ছে প্রোডাক্ট (পণ্য)। দোকানের মানুষের চাহিদামতো পণ্য না দিলে পারলে সেগুলো রাখব কেন? এসব নিয়ে আমাকে কেউ কখনো বাধ্য করতে পারবে না। দরকার হলে আমি এই ব্যবসাই করব না। আসলে সিনেপ্লেক্স ব্র্যান্ড হয়েছে দর্শকের আস্থার কারণে। মানুষ জানে সিনেপ্লেক্সে ছবি দেখলে বিরক্ত হবে না, বরং আনন্দময় সময় কাটাতে পারবে। এই বিশ্বাস আমাকে বজায় রাখতে হবে।’
‘ডেডবডি’ সিনেমা প্রসঙ্গে গিয়ে গিয়ে মাহবুব রহমান এও বললেন, ‘দর্শক বিশ্বাস করে এসে যে ছবি দেখে বিরক্ত হচ্ছে এবং ব্যবসায়িকভাবে আমি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি, স্ক্রিনিং কষ্ট উঠছে না সেই ছবি তো আমি চালাব না। কেউ যদি জোর গলায় খাওয়ানোর চেষ্টা করে, বলে যে তার ছবি বেষ্ট—সেখানে আমার কিছু বলার নেই। দর্শক যেটা বলবে আমরা সেদিকে বিশ্বাসী। এসব নিয়ে যে যতই প্রেস কনফারেন্স করুক আমার অবস্থান অনড় থাকবে। আমি সব সময় ভালো বাংলা ছবির পক্ষে। আমাদের ইয়াং মেধাবী পরিচালকেরা দর্শকদের চাহিদা বুঝে কিছু কিছু ভালো সিনেমা উপহার দিয়েছেন, যেমন হাওয়া, পরাণ, প্রিয়তমা, সুড়ঙ্গ, রাজকুমার।’
এদিকে ৩ মে বদরুল আনাম সৌদ পরিচালিত ‘শ্যামাকাব্য’ নামে আরেকটি ছবি মুক্তি পায়। মুক্তির দিনেই নির্মাতা অভিযোগ করেন, সিনেপ্লেক্সের বসুন্ধরা সিটি ব্রাঞ্চে ৩ নম্বর হলে যে স্ক্রিনে তার ছবি দেখাচ্ছে, সেখানে ছবি দেখে দর্শক বিভ্রান্ত হচ্ছেন। স্ক্রিন ঘোলাসহ নানা ধরনের সমস্যা রয়েছে। এ কারণে তিনি সিনেপ্লেক্স থেকে ছবি নামিয়ে নেন। এই অভিযোগ প্রসঙ্গেও কথা বলেছেন মাহবুব রহমান।
তিনি বলেছেন, বসুন্ধরাতে পাঁচটি স্ক্রিন রয়েছে। রিসেন্ট ভাড়া বাড়ানো হয়েছে। এ কারণে যে স্ক্রিনে সমস্যা আছে, সেটা ঠিক করা সম্ভব হয়নি। অপেক্ষা করছি, নতুন চুক্তি হওয়ার পর স্ক্রিনসহ বাকি যা আছে সেগুলো ঠিক করব। উনি (বদরুল আনাম সৌদ) ঠিক বলেছেন। ওই হলে আমাদের প্রজেকশনে একটু সমস্যা ছিল। ওনার ছবিটি যেহেতু ডার্ক, উনি স্ক্রিন চেঞ্জ করতে আমাকে পারসোনালি বলতে পারতেন। আমি রিপ্লেস করে দিতে পারতাম। কিন্তু তারা সিনেপ্লেক্সের লবিতে দাঁড়িয়ে আমাদের অপবাদ দিয়েছে, যা কাম্য নয়। তবে আমি পরিসংখ্যান দেখলাম তার ছবি দেখতে দর্শক কম এসেছিল। ছবি ভালো-মন্দ তা বলব না, তবে দর্শক সেভাবে ছিল না। ভালো সিনেমা বলতে দর্শক ঈদের পর এখনো সিনেপ্লেক্সে ‘রাজকুমার’ চলছে এবং দর্শক পছন্দ করায় আমরা চালাচ্ছি। দর্শক কম থাকায় নামিয়ে দেওয়ার পর আবার দর্শকেরা চাচ্ছে বলে ‘কাজলরেখা’ দেখাচ্ছি। আমি সাপ্লাই ডিমান্ডে বিশ্বাস করি। দর্শক যেটা চাইবে আমি সেটা দেখাব। এতে ব্লেম করলে মানব না।’