বছরের পর বছর ধরে সেন্সর বোর্ডে আটকে আছে সিনেমাগুলো, নানা অজুহাতে মুক্তির ছাড়পত্র পায়নি। তবে সার্টিফিকেশন বোর্ড গঠিত হওয়ায় তৈরি হয়েছে নতুন আশা। আটকে থাকা আট ছবির খবর নিয়েছেন মনজুর কাদের
তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, ‘নমুনা’, ‘রানা প্লাজা’, ‘অমীমাংসিত’, ‘শনিবার বিকেল’, ‘মেকআপ’, ‘আমার বাইসাইকেল-মর থেংগারি’সহ আটটি ছবি আটকে আছে। কোনো ছবি ১৫ বছরে মুক্তি দিতে পারেননি পরিচালক। সেন্সর প্রথা বিলুপ্ত হয়ে এরই মধ্যে সার্টিফিকেশন বোর্ড গঠিত হয়েছে। প্রযোজক-পরিচালকেরা অপেক্ষায় আছেন, আটকে থাকা ছবিগুলো এবার মুক্তির অনুমতি পাবে।
সার্টিফিকেশন বোর্ডের সদস্য হওয়ার পরই ফেসবুকে দেওয়া এক পোস্টে পরিচালক খিজির হায়াত খান লিখেছেন, ‘আটকে থাকা সিনেমা মুক্তি দেওয়ার জন্য আমাদের আপ্রাণ চেষ্টা থাকবে।’ গতকাল শনিবার দুপুরে খিজির হায়াত খান বললেন, ‘আমরা আটকে থাকা ছবিগুলো নিয়ে দ্রুত কাজ করতে চাই। এখানে কিছু ব্যাপার আছে, কিছু ছবি আদালতে আছে, কিছু আপিল বোর্ডে। এখনো আপিল বোর্ড গঠন হয়নি। যে ছবিগুলো আদালত ও আপিল বোর্ড ছাড়া আমাদের কাছে আসবে, সেসব ছবি আমরা দেখব। দ্রুত যাতে ছবিগুলো আলোর মুখ দেখে সে ব্যবস্থা করব।’
১৫ বছর আগে সরকারি অনুদানে ‘নমুনা’ তৈরি করেন এনামুল করিম নির্ঝর। প্রথম ছবি ‘আহা’ জাতীয় পুরস্কার পাওয়ার পর নমুনার জন্য অনুদান পান তিনি। বাংলাদেশের সামাজিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতা নিয়ে ছবিটি তৈরি হয়েছে। এভাবে সেন্সর বোর্ডে ছবি আটকে থাকাটা পরিচালকের জন্য হতাশার ছিল। তাই তো একটা সময় পর ছবিটি প্রসঙ্গে কথা বলা বন্ধ করে দেন পরিচালক। এই পরিচালক বললেন, ‘আগেও বলেছি, আবারও বলছি, পরিস্থিতি বুঝে তারপর সিদ্ধান্ত নেব। কখনো সত্যিকারের গণতান্ত্রিক পরিবেশ আসে, তাহলে অবশ্যই একটা উদ্যোগ নেব। এ ছাড়া আর কিছু বলার নেই।’
‘আশা করছি, ছাড়পত্র পেতে এখন সমস্যা হবে না’
রায়হান রাফীর ওয়েব ফিল্ম ‘অমীমাংসিত’ প্রদর্শন উপযোগী নয় বলে মাস তিনেক আগে জানায় তৎকালীন বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সেন্সর বোর্ড। গতকাল রাফী প্রথম আলোকে বললেন, দু-এক দিনের মধ্যে ছবিটি সার্টিফিকেশন বোর্ডে জমা দেবেন। ছাড়পত্র পেলেই মুক্তির দিনক্ষণ চূড়ান্ত করবেন।
কয়েক দফা সেন্সর বোর্ড ও আইন আদালতের জটিলতা পেরিয়ে মুক্তির জন্য প্রস্তুত ছিল সাভারের রানা প্লাজা ধসের ঘটনা নিয়ে নির্মিত সিনেমা ‘রানা প্লাজা’। ২০১৫ সালের ৪ সেপ্টেম্বর মুক্তির তারিখও চূড়ান্ত হয়। মুক্তির আগের দিন সন্ধ্যায় পরিচালক জানতে পারেন, ছবির মুক্তিতে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছেন হাইকোর্ট। দীর্ঘ ৯ বছরেও ছবিটি মুক্তি পায়নি। পরিচালক নজরুল ইসলাম খান এরই মধ্যে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন বলে জানালেন। গতকাল তিনি বললেন, ‘কথাবার্তা অনেক দূর এগিয়েছে। মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের আমার বক্তব্য জানিয়েছি। তাঁরা আমাকে লিখিতভাবে সব বিষয় জানাতে বলেছেন। খুব শিগগিরই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেব। ছবিটা আমি দ্রুতই দর্শকের কাছে পৌঁছে দিতে চাই।’
দুই বছর আগে অনন্য মামুনের ছবি ‘মেকআপ’ দেখার পর প্রদর্শন উপযোগী নয় বলে জানিয়ে দেয় তৎকালীন সেন্সর বোর্ড। দেশের চলচ্চিত্র অঙ্গনের মানুষকে দৃষ্টিকটুভাবে উপস্থাপনের অভিযোগে ছবিটি নিষিদ্ধ করা হয়েছে বলে জানান সদস্য খোরশেদ আলম খসরু। গতকাল শনিবার ছবির পরিচালক জানালেন, ‘সোমবারের মধ্যে আমার ছবিটি আবার জমা দেব। আশা করছি, ছাড়পত্র পেতে এখন আর সমস্যা হবে না।’
‘পরিবর্তনের নমুনা আমরা দেখতে চাই’
সেন্সর বোর্ডে ৯ বছর ধরে আটকে আছে চাকমা ভাষায় নির্মিত বাংলাদেশের প্রথম সিনেমা ‘আমার বাইসাইকেল-মর থেংগারি’। নির্মাতা প্রথম আলোকে জানান, ২০১৫ সালের মে মাসে সিনেমাটি সেন্সর বোর্ডে জমা দিয়েছেন; মাঝে ৯ বছর পেরোলেও সেন্সর ছাড়পত্র মেলেনি। গতকাল দুপুরে তিনি বললেন, ‘এখন যেহেতু সার্টিফিকেশন বোর্ড হয়েছে, সবাই পরিবর্তনও চাইছে, সেই পরিবর্তনের নমুনা আমরা দেখতে চাই। ছবিটি যত দ্রুত মুক্তির ব্যবস্থা করবে, ততই ভালো লাগবে। দর্শকের জন্য ছবিটা বানিয়েছি, দর্শকদের দেখার ব্যবস্থা করে দিক।’
প্রথম সিনেমা ছাড়পত্র না পেলেও দ্বিতীয় সিনেমা ‘দ্য লাস্ট পোস্ট’ অফিস বানিয়ে এরই মধ্যে মুক্তি দিয়েছেন অং রাখাইন।
মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর ‘শনিবার বিকেল’ মুক্তির দাবিতে গত বছর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তুমুল আলোচনা হয়। প্রথম আলোকে মাস দেড়েক আগে পরিচালক ফারুকী বলেছিলেন, ‘কোনো ছবিই আটকে রাখা যাবে না। এই যে ছবি আটকানোর সংস্কৃতি, মানুষের মুখ বন্ধ করার সংস্কৃতি, সংবাদমাধ্যমের গলা চেপে ধরার সংস্কৃতি, চলচ্চিত্র নির্মাতার গলা চেপে ধরার সংস্কৃতি—এসব সংস্কৃতি থেকে বাংলাদেশকে বের হয়ে আসতে হবে।’ এ ব্যাপারে গতকাল ফারুকীর সঙ্গে যোগাযোগ করে কথা বলা সম্ভব হয়নি।
সার্টিফিকেশন বোর্ডের একাধিক কর্মকর্তার সূত্রে জানা গেছে, আদালত ও আপিল বোর্ডে আটকে থাকা ছবি আগে রিভিউ করা হবে। এরপর নিষ্পত্তির ব্যাপারে উদ্যোগ নেওয়া হবে। কিছু ছবি সার্টিফিকেশন বোর্ডের তত্ত্বাবধানে আছে। এরই মধ্যে সংশ্লিষ্টদের নিয়ে আয়োজিত প্রথম সভায় আটকে থাকা ছবিগুলো সার্বিক অবস্থা দেখে প্রয়োজনীয় সব পদক্ষেপ নেওয়ার ব্যাপারে আলোচনা হয়েছে।