জোলাভাতি, গুলতি, রস কষ শিঙাড়া বুলবুলি, লাটিম–নাটাই, নারকেলপাতার চশমা—ফেলে আসা শৈশবকে ‘আম–কাঁঠালের ছুটি’ সিনেমায় প্রাণ দিয়েছেন মোহাম্মদ নূরুজ্জামান। এই সিনেমার গল্প জীবন থেকে নেওয়া, চিরচেনা। কেউ কেউ বলবেন, ‘গল্পটা আমার।’ সত্তর থেকে আশির দশকে কিংবা মধ্যনব্বইয়ে যাঁরা শৈশবকে ফেলে এসেছেন, তাঁরা চোখ বুজলেই শৈশবের স্মৃতির অলিন্দ থেকে ঘুরে আসতে পারেন। সেই স্মৃতি থেকেই উঠে এসেছে সিনেমার চরিত্র—মুইন্না, আনাইরা, মুইন্না–আনাইরার মা, শুভ।
সত্তর–আশির দশকেও স্কুলের গ্রীষ্মকালীন ছুটিকে বলা হতো ‘আম–কাঁঠালের ছুটি’। এই সময়ে আম–কাঁঠাল পাকে বলে মুখে মুখে এই নাম ছড়িয়েছে। মুইন্না খুব ডানপিটে, বনবাদাড়ে ঘুরে বেড়ায়, গুলতি দিয়ে আম পেড়ে খায়। মুইন্নার আসল নাম মনোয়ার, গ্রামের আর দশজন শিশুর মতো সে আসল নাম হারিয়ে ফেলেছে।
বয়সে ছোট কেউ ‘মুইন্না’ ডাকলে গোস্বা করে। বাড়ির দরজায় নিজের আসল নাম লিখে রেখেও সে ‘মনোয়ার’ হতে পারেনি। মুইন্নার ‘ক্রাইম পার্টনার’ ছোট ভাই আনাইরা; সঙ্গে আরও তিন-চারজন সাঙ্গপাঙ্গ রয়েছে।
সিনেমার বাজেট সীমিত; ফলে দৃশ্যধারণে কৃত্রিমতার বিলাসিতা ছিল না। চিত্রনাট্য ধরে ছবির মতো একটি গ্রামে সিনেমাটির দৃশ্য ধারণ করা হয়েছে। গাজীপুরের হারবাইদসংলগ্ন এই গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে নদী, তীরে ভেড়ানো নৌকা; গ্রীষ্মের কড়া দুপুরে গাছে গাছে ঘুঘু ডাকে, চাকভর্তি মৌমাছি ভন ভন করে।
২০১৫ সালের গ্রীষ্মে সিনেমার দৃশ্যধারণের পরিকল্পনা করেছিলেন নির্মাতা। প্রথম দফায় দিন দশেক দৃশ্যধারণের পর ভারী বর্ষা নামে। বাধ্য হয়ে দৃশ্যধারণ বাতিল করা হয়, গ্রীষ্মের জন্য আরও এক বছর অপেক্ষা করেন পরিচালক। পরের বছর নির্ধারিত সময়ের আগেই দৃশ্যধারণে নেমে পড়েন নির্মাতা। সেবার বর্ষা আরও এগিয়ে এসেছিল। সেবারও তাই ইউনিট গুটিয়ে ঢাকায় ফিরতে হয়েছিল।
চিত্রনাট্য অনুযায়ী চরিত্রের বয়স আট বছরের বেশি হওয়া যাবে না। দুই বছরে শিল্পীদের অনেকে চরিত্রের চেয়ে বেড়ে ওঠে, ফলে কয়েকজনকে বাদ দিতে হয়, ফেলে দিতে হয় ফুটেজ। তৃতীয় বছরের চেষ্টায় দৃশ্যধারণে সফল হন নির্মাতা; নানা চড়াই–উতরাই পেরিয়ে ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে শেষ হয় দৃশ্যধারণ।
শরীফ উদ্দিনের ছোটগল্প অবলম্বনে নির্মিত সিনেমার দৃশ্যগুলো জীবন্ত। দৃশ্যগুলোয় প্রাণ দিয়েছেন অভিনয়শিল্পীরা; শিল্পীদের মধ্যে মুইন্না চরিত্রে ময়মনসিংহের লিয়ন, আনাইরা চরিত্র টঙ্গীর আরিফ, শুভ চরিত্রে জুবায়ের, মুইন্না-আনাইরার মায়ের চরিত্রে ফাতেমা সাবলীল অভিনয় করেছেন, চরিত্রের সঙ্গে নিবিড়ভাবে মিশে গেছেন। অথচ তাঁরা কেউই পেশাদার শিল্পী নন, এটিই তাঁদের প্রথম সিনেমা।
গত রোববার শিল্পকলা একাডেমিতে সিনেমার উদ্বোধনী প্রদর্শনী শেষে আনাইরার সঙ্গে দেখা। পর্দার ছোট্ট আনাইরা আর ছোট্টটি নেই, সিনেমার মতো হুট করেই বড় হয়ে গেছে! সিনেমার দৃশ্যধারণের পর ছয় বছর কেটে গেছে, এর মধ্যে শুধু আনাইরা নয়, পর্দার শুভকেও আর সামনাসামনি দেখে চেনার জো নেই; বাকিরাও বেড়ে উঠেছে। কেউ কেউ এখন দশম শ্রেণিতে পড়ছে। তবে পর্দায় তাদের শৈশবটা আটকে আছে, বড় পর্দায় নিজেকে প্রথমবার দেখে তারা আপ্লুত।
সিনেমার সাউন্ড ডিজাইনের নিপুণ ব্যবহারও দর্শকের কানে শ্রুতিমধুর লেগেছে; পাশাপাশি সংলাপও মনোযোগ কেড়েছে। কিছু কিছু সংলাপে হো হো করে হেসে উঠেছে মিলনায়তন। বলা হচ্ছে, এটি পূর্ণদৈর্ঘ্য শিশুতোষ সিনেমা; তবে সিনেমাটি শিশুদের ছাপিয়ে বুড়োদেরও সমানভাবে আনন্দ দেবে।
আম–কাঁঠালের ছুটিমুক্তি: ১৮ আগস্টব্যাপ্তি: ৯৭ মিনিটগল্প: শরীফ উদ্দিনপ্রযোজনা, পরিচালনা, চিত্রনাট্য ও সাউন্ড ডিজাইন: মোহাম্মদ নূরুজ্জামানসিনেমাটোগ্রাফি: মোহাম্মদ নূরুজ্জামান ও ম্যাক সাব্বিরপ্রধান সহকারী পরিচালক: যুবরাজ শামীমঅভিনয়: লিয়ন, জুবায়ের, আরিফ, হালিমা, তানজিল, ফাতেমা, কামরুজ্জামান কামরুল, আবদুল হামিদ প্রমুখ।
বাংলাদেশের টঙ্গী কিংবা রাশিয়ার সিমবার্স্ক—দুনিয়ার সব শৈশবই এক সুতায় বাঁধা; সুতার রং, বুনন হয়তো আলাদা। আপাতদৃষ্টে নির্মাতা সিনেমায় বাংলাদেশের শৈশবকে তুলে ধরেছেন, তবে সেটি বৈশ্বিক শৈশবে পরিণত হয়েছে। রাশিয়ায় এক উৎসবে সিনেমাটি উপভোগ করেছেন দেশটির দর্শকেরা।
সিনেমাটি বেশ উপভোগ্য হলেও দু–একটি দৃশ্যকে আরও ছোট করা যেত, তাহলে ছবিটি আরও আঁটসাঁট হতো।