বছরের মাঝখানের কয়েক মাস রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে সিনেমা মুক্তি বন্ধ ছিল, শেষ দুই মাসে প্রেক্ষাগৃহে এসেছে বেশ কয়েকটি সিনেমা, কিন্তু ব্যবসা ফেরেনি। ঢাকাই সিনেমার জন্য ২০২৪ তাই হয়ে রইল আরও একটি আক্ষেপের বছর। সব মিলিয়ে চলতি বছর চলচ্চিত্রজগৎ কেমন ছিল? খবর নিয়েছেন লতিফুল হক
১৯ জানুয়ারি মেহেদী হাসানের ‘শেষ বাজি’ দিয়ে শুরু হয়েছিল বছর, শেষ হবে আকরাম খানের ‘নকশী কাঁথার জমিন’ দিয়ে। মধ্যে এসেছে আরও ৩৯টি সিনেমা। ব্যবসা বা শিল্পমানের বিচারের এর মধ্যে উল্লেখ করার মতো কাজ হয়েছে হাতে গোনা। নূরুল আলম আতিক, গিয়াসউদ্দিন সেলিম, মোস্তফা সরয়ার ফারুকী, মোস্তাফিজুর রহমান মানিক, রায়হান রাফীর মতো পরীক্ষিত নির্মাতার সিনেমা যেমন ছিল, তেমনি ছিল মিশুক মনি, ধ্রুব হাসান, শঙ্খ দাশগুপ্তের মতো নবীন নির্মাতার সিনেমাও।
বাণিজ্যের বিচারে নিশ্চিতভাবেই বছরের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য সিনেমা ‘তুফান’।
রায়হান রাফীর এ সিনেমা মুক্তির আগে টিজার, গান দিয়ে রীতিমতো শোরগোল ফেলে দিয়েছিল অন্তর্জালে। গত ১৭ জুন পবিত্র ঈদুল আজহা উপলক্ষে হলে মুক্তির পর সেই ঝাঁজ ভালোভাবেই টের পাওয়া যায়। পরে দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে ব্যবসায় ভাটা পড়ে। সেই যে দর্শক হল বিমুখ হয়েছেন, বছরের শেষ পর্যন্ত তাঁদের ফেরানো যায়নি।
শাকিব অভিনীত আরেকটি সিনেমা ‘রাজকুমার’ মুক্তি পায় পবিত্র ঈদুল ফিতরে। হিমেল আশরাফ পরিচালিত সিনেমাটি তাঁর আগের সিনেমা ‘প্রিয়তমা’কে ছুঁতে পারেনি। নভেম্বরে মুক্তি পাওয়া শাকিবের আরেকটি সিনেমা অনন্য মামুনের ‘দরদ’ও তেমন ব্যবসা করতে পারেনি। রোজার ঈদের মুক্তি পাওয়া গিয়াসউদ্দিন সেলিমের ‘কাজলরেখা’ দেখতে ভিড় করেছেন দর্শক।
এফডিসিকেন্দ্রিক নির্মাতাদের জন্যও বছরটা ভালো যায়নি। একই ধরনের গল্প, নির্মাণে অযত্নের ছাপ, প্রচারের অভাব মিলিয়ে কোনো সিনেমাই সেভাবে মনে রাখার মতো হয়নি। এর মধ্যেও কামরুজ্জামান রোমানের ‘লিপস্টিক’ ভালো চেষ্টা ছিল। আলোচনা–সমালোচনা হলেও কথা হয়েছে ‘জ্বীন-২’ নিয়ে।
বরং ‘দেয়ালের দেশ’, ‘ফাতিমা’, ‘প্রিয় মালতী’র মতো কয়েকটি সিনেমা, যাঁরা অন্য রকম গল্প দেখতে চান, তাঁদের খোরাক মিটিয়েছে। চমকে দিয়েছেন মুহাম্মদ মোস্তফা কামাল রাজও। তাঁর ‘ওমর’ বছরের অন্যতম বুদ্ধিদীপ্ত সিনেমা। অল্প বাজেট, গল্প অনুমেয় হলেও চিত্রনাট্য আর নির্মাণের জোরে যে উতরে যাওয়া যায়, সিনেমাটি সেটারই প্রমাণ।
বছর শেষের বড় চমক ছিল ‘৮৪০’। মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর এই রাজনৈতিক বিদ্রূপাত্মকধর্মী সিনেমাটি মুক্তির আগে আরও বেশি প্রচার হলে বেশি দর্শকের কাছে পৌঁছাতে পারত।
আবারও শাকিব
কয়েক বছর ধরে নতুন নির্মাতাদের সঙ্গে কাজ করছেন শাকিব খান। তাঁরা ঢাকাই ছবির এই শীর্ষ নায়ককে নতুনভাবে পর্দায় হাজির করেছেন। এবারও তিন সিনেমায় (‘রাজকুমার’, ‘তুফান’, ‘দরদ’) তাঁকে ভিন্নভাবে দেখেছেন দর্শক। কখনো তিনি গ্রামের সাধারণ যুবক, কখনো কুখ্যাত গ্যাংস্টার—সব চরিত্রে তিনি নিজের ক্যারিশমার সঙ্গে অভিনয়েও জোর দিয়েছেন। ২০২৪-এ শরীফুল রাজের তিন সিনেমা (‘কাজলরেখা’, ‘দেয়ালের দেশ’ ও ‘ওমর’) মুক্তি পেয়েছে। তিন ধরনের চরিত্রে রাজ যথারীতি নিজের অভিনয়দক্ষতার ছাপ রেখেছেন। ‘ওমর’ ও ‘৮৪০’-এ নাসিরউদ্দিন খানও অভিনেতা হিসেবে নিজের জাত চিনিয়েছেন।
জিয়াউল রোশান, সাইমন সাদিক, নিরবের মতো বাণিজ্যিক সিনেমার পরিচিত নায়কের জন্য ২০২৪ ছিল গড়পড়তা বছর। তবে আলাদাভাবে উল্লেখ করতে হয় আদর আজাদের কথা। লিপস্টিক-এ তিনি দেখিয়েছেন বাণিজ্যিক সিনেমার সফল নায়ক হওয়ার মতো গুণ তাঁর মধ্যে ভালোই আছে।
তবু বুবলীর বছর
রায়হান রাফীর টান যাঁরা দেখেছেন তাঁরা জানেন, শবনম বুবলী অভিনয়টা ভালোই জানেন। কিন্তু অনেক সিনেমাতেই কেন যেন সেই বুবলীকে খুঁজে পাওয়া যায় না। চলতি বছর মুক্তি পাওয়া দুটি সিনেমা ‘মায়া: দ্য লাভ’ ও ‘রিভেঞ্জ’-এ বুবলী ছিলেন চলনসই। তবে ভিন্নধারার সিনেমা দেয়ালের দেশ-এ অভিনেত্রী বুবলীকে পাওয়া গেছে। এর মধ্যে ‘মায়া’ ও ‘দেয়ালের দেশ’ মুক্তি পেয়েছিল রোজার ঈদে। একই সময়ে একই অভিনেত্রীর দুটি ভিন্নধারার সিনেমা চলছে হলে, এটা বিরল দৃশ্যই বটে।
জয়া আহসান অভিনীত ‘নকশী কাঁথার জমিন’ দিয়ে বছর শেষ হবে। ছবিটি কেমন হয়, সেটা জানতে আরও অপেক্ষা করতে হবে। জয়া অভিনীত আরেকটি সিনেমা পেয়ারার সুবাস বছরের প্রথমভাগে মুক্তি পায়। নূরুল আলম আতিকের সেই ছবিতে জয়ার অভিনয় দারুণ, তবে সিনেমা হিসেবে এটা আরও ভালো হতে পারত।
পূজা চেরী বা ববির মতো বাণিজ্যিক সিনেমার নিয়মিত নায়িকাদের জন্যও বছরটা মোটামুটি কেটেছে। সবচেয়ে হতাশার, চলতি বছর সেভাবে বাণিজ্যিক সিনেমার নতুন নায়িকা উঠে আসেননি।
ছোট পর্দার জনপ্রিয় দুই তারকা মেহজাবীন চৌধুরী ও তাসনিয়া ফারিণের চলচ্চিত্রে অভিষেক হয়েছে। ‘ফাতিমা’য় ফারিণ ভালো করেছেন আর ‘প্রিয় মালতী’তে বছরের অন্যতম সেরা অভিনয় করেছেন মেহজাবীন।
তাঁদের দেখা নেই
মুক্তির কথা থাকলেও নানা জটিলতায় চলতি বছর বেশ কয়েকটি সিনেমা শেষ পর্যন্ত আসেনি। কোনোটির পোস্ট প্রোডাকশন শেষ হয়নি, কোনোটি কৌশলগত কারণে আসেনি, কোনোটি আবার রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে পিছিয়ে গেছে। চলতি বছর তাই আরিফিন শুভ, পরীমনি, নুসরাত ফারিয়া, আজমেরী হক বাঁধন, সিয়াম, তমা মির্জা অভিনীত কোনো সিনেমা মুক্তি পায়নি।
ছোট পর্দা থেকে
ছোট পর্দার তারকা ইয়াশ রোশানের দুটি সিনেমা এসেছে (ফাতিমা ও শরতের জবা)। তাঁর অভিনয় ঠিকঠাক হলেও সিনেমাগুলো খুব বেশি দর্শকের কাছে পৌঁছায়নি।
এর বাইরে সুদীপ দীপ, ইরফান সাজ্জাদ, আইশা খান, মৌসুমী হামিদ, জাকিয়া বারী মম, নিদ্রা দে নেহা অভিনীত সিনেমা প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পেয়েছে।
সার্টিফিকেট বোর্ড ও নতুন কমিটি
অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর চলচ্চিত্রে অনেক কিছু দৃশ্যমান বদল ঘটেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বদল সেন্সর যুগের ইতি ঘটিয়ে সার্টফিকেশন বোর্ড গঠন।
আলোচিত ১০ (মুক্তির তারিখ অনুযায়ী) রাজকুমার কাজলরেখা দেয়ালের দেশ ওমর লিপস্টিক জ্বীন-২ তুফান দরদ ৮৪০ প্রিয় মালতী
গত সেপ্টেম্বর মাসে বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সার্টিফিকেশন আইন–২০২৩-এর ৩ ধারার উপধারা(১) অনুযায়ী ১৫ সদস্যের সার্টিফিকেশন বোর্ড গঠিত হয়েছে। এরপর জাতীয় পুরস্কারের জুরিবোর্ড, চলচ্চিত্র অনুদান কমিটিসহ অনেক কমিটি পুনর্গঠিত হয়েছে। এসব কমিটিতে তরুণ ও এই সময়ের আলোচিত অনেক শিল্পী, কলাকুশলীকে দেখা গেছে।