ছবিটি সাদা–কালো, কোনো সংলাপ নেই। এক কারখানার তিন কর্মীর যাপিত জীবনকে ‘নির্বাণ’ সিনেমায় তুলে এনেছেন নির্মাতা আসিফ ইসলাম। ৪৬তম মস্কো আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে (এমআইএফফ) স্পেশাল জুরি অ্যাওয়ার্ড পেয়েছে সিনেমাটি।
বাংলাদেশে সময় গত শুক্রবার রাতে উৎসবের সমাপনী আয়োজনে সেরা সিনেমা, সিনেমার পরিচালকসহ বিভিন্ন শাখায় বিজয়ীর নাম ঘোষণা করেছে উৎসব কর্তৃপক্ষ। গত শুক্রবার মধ্যরাতে নির্মাতা আসিফ ইসলাম রাশিয়া থেকে প্রথম আলোকে জানান, পুরস্কার ঘোষণার খবর তিনি বিশ্বাসই করতে পারছিলেন না। পুরস্কার হাতে নিয়ে এখনো তিনি কাঁপছেন।
আসিফের ভাষ্যে, ‘আমাদের সিনেমার নাম ঘোষণার পর আমি চমকে উঠি। পুরস্কার হাতে নেওয়ার পরও একটা ঘোরের মধ্যে ছিলাম। এখনো আমি কাঁপছি। কথা বলতে পারছি না। এই অর্জন আমাদের অনেক কিছু দিয়েছে।’
এটি বিশ্বের পুরোনো চলচ্চিত্র উৎসবের একটি। ১৯ এপ্রিল উৎসবের ৪৬তম আসরের পর্দা উঠেছে। এতে নির্মাতা আসিফ ইসলাম ও সিনেমার অভিনেত্রী প্রিয়াম অর্চি অংশ নেন। রুশ বার্তা সংস্থা তাসসহ বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে নির্বাণ-এর পুরস্কারপ্রাপ্তির খবর প্রকাশিত হয়েছে। তাসের খবরে ছবিটি নিয়ে বলা হয়, তিন চরিত্রের মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্বকে তুলে এনেছেন নির্মাতা।
পুরস্কার নিয়ে গতকাল ঢাকার পথে উড়াল দিয়েছেন নির্মাতা আসিফ। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশে পুরস্কার নিয়ে যেতে পারছি, এটাই আমার জন্য বড় প্রাপ্তি।’ এর আগে নির্মাতা ফয়সাল রদ্দির সঙ্গে যৌথভাবে ‘পাঠশালা’ নামে একটি সিনেমা নির্মাণ করেছেন আসিফ। এককভাবে নির্মিত প্রথম সিনেমা ‘নির্বাণ’।
সিনেমাটির লেখক ও সহপ্রযোজক আনোয়ার হোসেনকে নিয়ে ২০২২ সালে ছবিটি নির্মাণে হাত দেন আসিফ। আসিফ জানান, শুরুতে সিনেমার চিত্রনাট্য ছিল ছোট। শুধু একটি আইডিয়া ছিল তাঁদের। তাঁর সঙ্গে ছিলেন সিনেমার লেখক। দুজন একসঙ্গে শুটিংয়েও ছিলেন। দিনের পর দিন তাঁরা সংলাপহীন এই সিনেমা দাঁড় করিয়েছেন।
পরিচালক বলেন, ‘এই পুরস্কার আমাদের আরও বড় স্বপ্ন দেখাচ্ছে। এটা আমাদের ইন্ডাস্ট্রির জন্য সুখবর।’
সিনেমায় মূল চরিত্রে অভিনয় করেছেন প্রিয়াম অর্চি। পুরস্কারপ্রাপ্তির খবরে প্রিয়াম প্রথম আলোকে বলেন, ‘সবকিছু স্বপ্নের মতো মনে হচ্ছে। পরিচালক নিজেই জানিয়েছেন। শোনার পর ভাবছিলাম যে সিনেমাটি দুজন মানুষ দিয়েই শুরু। সেখানে চারজন অভিনেত্রী যোগ দিল। সিনেমা নির্মাণের পেছনের ঘটনার কথাই বেশি মনে পড়ছে। সিনেমার পরিচালক আসিফ ভাই, লিখেছেন আনোয়ার হোসেন ভাই। তাঁরা যে পরিশ্রম করেছেন, সেটাই মনে পড়ছে। আমরা টিমটা যে জার্নি নিয়ে শুরু করেছিলাম, সেটা আজ সফল হলো। এই প্রাপ্তি আমাদের অনেক বেশি অনুপ্রাণিত করবে।’
এর আগে ৪৪তম মস্কো আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্রে স্পেশাল জুরি অ্যাওয়ার্ড পেয়েছে ঢাকার নির্মাতা যুবরাজ শামীমের ছবি ‘আদিম’। পাশাপাশি নেটপ্যাক জুরি পুরস্কারও পেয়েছিল ছবিটি। ‘আদিম’-এর পথ ধরে এবার স্পেশাল জুরি অ্যাওয়ার্ড পুরস্কারটি পেল ‘নির্বাণ’।
‘নির্বাণ’ সিনেমার গল্প নিয়ে প্রিয়াম অর্চি বলেন, ‘আমাদের সিনেমায় কোনো সংলাপ নেই। সিনেমাটিতে তিন কর্মীর যাপিত জীবনের চিত্র উঠে এসেছে। মনস্তাত্ত্বিক অনেক বিষয় সিনেমায় দেখানো হয়েছে। একটি ফ্যাক্টরির কর্মীদের আসা-যাওয়ার মাঝে অনেক গল্প থাকে, সেগুলো তুলে ধরা হয়েছে। যেটাকে আমরা মেডিটেশনের সঙ্গে তুলনা করেছি। মেডিটেশনে যেমন শুরুতেই প্রবেশ করা কঠিন, কিন্তু একবার প্রবেশ করলে পরে আর কঠিন মনে হয় না। সিনেমা দেখে দর্শকেরা সেই কথাই বলছিলেন। কিন্তু সিনেমাটির মন্থরগতি নিয়ে আমরা কিছুটা চিন্তিত ছিলাম। এখন মনে হচ্ছে, সেখানে আমরা উতরে গেছি।’
৪৬তম মস্কো আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের সেরা চলচ্চিত্রের পুরস্কার মিচেল সালগাদো পরিচালিত সিনেমা শেম; মেক্সিকো ও কাতারের যৌথ প্রযোজনায় ছবিটি সত্য ঘটনা অবলম্বনে নির্মিত হয়েছে। উৎসবে সেরা পরিচালক হয়েছেন ইরানের ছবি কোল্ড সিং নির্মাতা নাহিদ আজিজি সেদ্দিঘ। আট দিনের এই উৎসবে ৫৬ দেশের ২৪০টি পূর্ণদৈর্ঘ্য ও স্বল্পদৈর্ঘ্য সিনেমার ৩৮০টি প্রদর্শনী হয়েছে। ৯টি প্রেক্ষাগ্রহে প্রায় ৪০ হাজারের মতো দর্শক ছবিগুলো উপভোগ করেছেন।
২০১৯ সালে ৪১তম মস্কো আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের মূল প্রতিযোগিতা বিভাগে নির্বাচিত হয় মোস্তফা সরয়ার ফারুকী পরিচালিত ‘শনিবার বিকেল’ ছবিটি। সেবার দুটি ইন্ডিপেনডেন্ট জুরি পুরস্কার পেয়েছে ছবিটি; রাশান ফেডারেশন অব ফিল্ম ক্রিটিকস জুরি পুরস্কার আর অন্যটি কমেরসান্ত পুরস্কার। ৪৫তম মস্কো আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে নূরুল আলম আতিক পরিচালিত ‘পেয়ারার সুবাস’ মূল প্রতিযোগিতা বিভাগে জায়গা করে নিয়েছিল।