‘জনপ্রিয়তার ভেতর দিয়ে সিনেমার সাফল্য তৈরি হয় না’

‘হাওয়া’ সিনেমার পোস্টার। আইএমডিবি
‘হাওয়া’ সিনেমার পোস্টার। আইএমডিবি

‘“হাওয়া” নিয়ে বলতে বলতে আমার সব কথা হাওয়া হয়ে গেছে,’ বললেন মেজবাউর রহমান সুমন। প্রশ্ন ছিল, ‘হাওয়া’র নির্মাণ নিয়ে এমন কিছু বলুন, যা দর্শক জানেন না। উত্তর দিতে গিয়ে রসিকতার মেজাজে কথাটা বললেন পরিচালক। পরে বিষয়টি ভেঙে বললেন। চেয়েছিলেন সিনেমাটি মুক্তির আগে-পরে যত সম্ভব কম কথা বলতে। তারপরও অল্প অল্প করে বলতে গিয়ে সব কথা হাওয়া হয়ে গেছে! মেজাবাউর রহমান সুমনের সিনেমা ‘হাওয়া’ মুক্তির এক বছর পূর্ণ হচ্ছে আজ।

গত বছরের ২৯ জুলাই মুক্তির পর ব্যাপক ব্যবসায়িক সাফল্য, সমালোচকদের প্রশংসা—সবই পেয়েছে ছবিটি। নির্মাতা হিসেবে হাওয়াকে কীভাবে মনে রাখবেন? এবার একটু সিরিয়াস হলেন। রসিকতার মেজাজ পাল্টে সুমন বললেন, ‘আমরা বলেছিলাম, “হাওয়া” বিষণ্নতার ছবি বা নিঃশেষ হয়ে যাওয়ার ছবি। কিন্তু “হাওয়া” আমাদের প্রথম ছবি, এটা অনেক বড় অনুভূতি। সাফল্য ও ব্যর্থতার যে অলৌকিক অঙ্ক, সেটা তো কষে যেতে পারব না। আমাদের কাছে সফলতা এতটুকুই, ছবিটি আমরা আমাদের মতো করে বানিয়েছিলাম; কিন্তু দর্শক “হাওয়া”কে তাঁদের করে নিয়েছেন। এক বছর পূর্তিতে এটাই মনে হচ্ছে।’

‘দুরন্ত নির্মাণ আর অভিনয়ের মিশেলে তৈরি হয়েছে ছবিটি। পরিচালক দক্ষতার সঙ্গে চরিত্রগুলোর মধ্যকার দ্বন্দ্ব তুলে ধরতে পেরেছেন, যা ছুঁয়ে গেছে দর্শকদেরও,’ এভাবে বাংলাদেশি সিনেমা ‘হাওয়া’র রিভিউ লিখেছেন ভারতীয় গণমাধ্যম স্ক্রলডটইনের লেখক নন্দিনী রামনাথ। ৭ জুলাই ভারতীয় স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্মে মুক্তি পেয়েছে ছবিটি। কেবল স্ক্রলডটইন নয়, লেটেস্টলিডটকম, বিঞ্জডসহ আরও অনলাইন সংবাদমাধ্যমের সমালোচকেরা তারিফ করেছেন ছবিটির। বাংলা, হিন্দি, তেলেগু, তামিল ও মালয়ালম—সনি লিভে ‘হাওয়া’ দেখা যাচ্ছে পাঁচটি ভাষায়।

‘হাওয়া’ চলচ্চিত্রের দৃশ্যে নাজিফা তুষি

মুম্বাইয়ের আন্ধেরি এলাকার বাসিন্দা পৃথা সান্যাল ছবিটি দেখে রীতিমতো উচ্ছ্বসিত। গতকাল প্রথম আলোকে তিনি বলেছেন, ‘সম্প্রতি ওটিটিতে ছবিটি দেখার সৌভাগ্য হলো আমার। অভিনেতা চঞ্চল চৌধুরী সব সময়ই চমকে দিয়েছেন। “হাওয়া” ছবিতে তিনি আবার চমকে দিলেন। তাঁর মতো অভিনেতার জন্য কোনো প্রশংসাই যথেষ্ট নয়। এই ছবির সব অভিনয়শিল্পী যেন একে অপরকে টেক্কা দিয়েছেন। দুর্দান্ত কাস্টিং। টান টান চিত্রনাট্য। চোখজুড়ানো সিনেমাটোগ্রাফি। আর সব শেষে অবশ্যই বাহবা দিতে হয় পরিচালক মেজবাউর রহমান সুমনকে।’

বাংলাভাষী দর্শকদের বাইরে অন্যদের প্রশংসা কেমন লাগছে? গতকাল দুপুরে মুঠোফোনে পরিচালক বলেন, ‘সনি লিভে মুক্তির পর বাংলাভাষী দর্শকদের বাইরে অনেকেই আমাকে টেক্সট করছেন, এটা খুবই আনন্দের ব্যাপার। একটা ছবি যখন বাণিজ্যিকভাবে সাফল্য পায়, সেটাতে মানুষের একধরনের আগ্রহ থাকে। কিন্তু আমার কাছে মনে হয়, “হাওয়া” মানুষ আসলে সে জায়গা থেকে দেখেননি। একটা অলটারনেটিভ ছবি দেখার আগ্রহ থেকেই মানুষ সিনেমাটি দেখছেন, নির্মাতা হিসেবে এটাই সবচেয়ে আনন্দের।’

মেজবাউর রহমান সুমন

কথা হলো খুলনার লিবার্টি সিনেপ্লেক্সের কাউন্টার ম্যানেজার মোশারফ হোসেনের সঙ্গে। তিনি প্রথম আলোকে জানান, গত ১০ বছরে লিবার্টি হলের সবচেয়ে ব্যবসা সফল ছবি ‘হাওয়া’, যার প্রতিটি শো হাউসফুল গেছে। দল বেঁধে শিক্ষার্থীরা এসেছিলেন ছবিটি দেখতে। রাজধানীর মাল্টিপ্লেক্সগুলোতে মানুষের আগ্রহের একটা ব্যাখ্যা হয়তো দাঁড় করানো যায়। কিন্তু মফস্‌সল শহরে ছবিটি নিয়ে যে আগ্রহ দেখা গেছে, সেটার ব্যাখ্যা কী? এক বছর পর ছবিটির বাণিজ্যিক সাফল্য বিশ্লেষণ করতে বললে নির্মাতা বললেন, ‘দেখার জন্য সব উপাদান ছবিতে আছে, নির্মাতা হিসেবে এই দাবি কখনোই করতে চাই না। আমরা সিনেমাটিকে যেভাবে দেখেছি, সে জায়গা থেকেই বানিয়েছি। মুক্তির আগে থেকেই বলেছিলাম, পোস্টার, ট্রেলার কিংবা গান দেখে যদি মনে হয় ছবিটি দেখতে চাই, তাহলে দেখতে আসতে পারেন। “হাওয়া” আমাকে সাহস দিয়েছে, আমি আমার ভাবনায় ছবি বানাতে পারব। নির্মাতাকে তো দর্শকের রুচির পরিবর্তনও করতে হয়; দর্শক যেটা চাচ্ছেন সেটাই শুধু না করে নির্মাতা হিসেবে নিজের স্বপ্ন প্রকাশ করব।’

‘হাওয়া’ নিয়ে প্রশংসা যেমন হয়েছে, কেউ কেউ আবার সিনেমাটিক দৃষ্টিভঙ্গিতে ছবিটির সমালোচনাও করেছেন। সুমন মনে করেন, পৃথিবীর কোনো সিনেমা, চিত্রকর্ম, সাহিত্য সবার একই রকমভাবে ভালো লাগে না। কারও হয়তো হাওয়ার জাদুবাস্তবতা ভালো লাগেনি। আবার কারও এটা খুবই ভালো লেগেছে।

চাপটা নিতে চাই না। আমার প্রতি যদি মানুষের আগ্রহ তৈরি হয়, সেটা তো ভালো; কিন্তু তাঁদের প্রত্যাশা যদি থাকে আবার “হাওয়া”র মতো ছবি দেব, সেটা আমার জন্য চাপ। আমি আরেক ধরনের গল্প নিয়ে, আরেক ধরনের ডিজাইনে আমার মতো ছবি বানাব। আমার সব নিয়ে তো দর্শকের সমান আগ্রহ তৈরি হবে না। সেটা পরের ছবির ক্ষেত্রেও হতে পারে। দর্শককে ছবির জন্য আগ্রহী করে তুলতে হবে, ওই চাপও মাথায় নিতে চাই না। জনপ্রিয়তার ভেতর দিয়ে সিনেমার সাফল্য তৈরি হয় না।

‘হাওয়া’র পর তাঁর পরের কাজে দেখার অপেক্ষায় দর্শক। পরিচালক জানান, চিত্রনাট্য তৈরি আছে আগে থেকেই। শিল্পী নির্বাচন ও লোকেশন দেখা চলছে। প্রথম ছবির এমন সাফল্য তাঁর জন্য বাড়তি চাপ তৈরি করছে কি না? এমন প্রশ্নর উত্তরে সুমন বলেন, ‘এটা তো চাপই। তবে চাপটা নিতে চাই না। আমার প্রতি যদি মানুষের আগ্রহ তৈরি হয়, সেটা তো ভালো; কিন্তু তাঁদের প্রত্যাশা যদি থাকে আবার “হাওয়া”র মতো ছবি দেব, সেটা আমার জন্য চাপ। আমি আরেক ধরনের গল্প নিয়ে, আরেক ধরনের ডিজাইনে আমার মতো ছবি বানাব। আমার সব নিয়ে তো দর্শকের সমান আগ্রহ তৈরি হবে না। সেটা পরের ছবির ক্ষেত্রেও হতে পারে। দর্শককে ছবির জন্য আগ্রহী করে তুলতে হবে, ওই চাপও মাথায় নিতে চাই না। জনপ্রিয়তার ভেতর দিয়ে সিনেমার সাফল্য তৈরি হয় না।’

কথায় কথায় পরিচালক আরও জানালেন, এক বছর পূর্তি উপলক্ষে তাঁরা একটি ভিজ্যুয়াল প্রেজেন্টেশন প্রকাশ করবেন। যেখানে থাকবে গত এক বছরে সিনেমাটির নানা সাফল্যর গল্প।