ঢাকা শহরের ট্রাফিক জ্যাম ঠেলে ঢাকাই সিনেমার ‘কিং খান’ পৌঁছালেন কারওয়ান বাজারের একটি পাঁচ তারকা হোটেলের বল রুমের সামনে। পাশের কক্ষে সংবাদ সম্মেলন। গাড়ি থেকে নেমে ঠিক ১০ সেকেন্ডের পথ। সেই পথেই যেতেই একাধিকবার আটকে যেতে হলো শাকিব খানকে। গাড়ির থেকে নামার পর হুমড়ি খেয়ে পড়লেন একদল সাংবাদিক ও শাকিব ভক্তরা। বারবার থেমে যেতে হলো ঢালিউডের বীরদর্পে ছুটে চলা শাকিবকে।
শাকিবকে দেখে মুহূর্তেই ভিড় আরও বেড়ে যেতে থাকে। চারপাশ থেকে ফ্ল্যাশ লাইট আর ভিডিও রেকর্ডিং চলছে। কেউ যেন কাছে আসতে না পারেন, সে জন্য শাকিব খানকে ঘিরে রাখা। কিন্তু এত সবের মধ্যে অনেক অনুরোধ করেও ভিড় ঠেলে সরানো গেল না। কিছুদূর সারানো গেলেও পরেই আবার পা বাড়ানোর জায়গা নেই। এদিকে শাকিব খানের হাস্যোজ্জ্বল চেহারা দূর থেকেও বোঝা যাচ্ছে। উপচে পড়া এই ভিড়ে নেই কোনো বিরক্তির ছাপ। মূলমঞ্চের ভেতর ও বাইরে অনেকটা সময় দাঁড়িয়ে থাকার পর বসার সুযোগ পেলেন এই তারকা। মাত্র ১০ সেকেন্ডের পথ পার হতে লেগে গেল পাঁচ মিনিটের বেশি।
ভেতরে গিয়ে বসার পর আবারও গণমাধ্যমকর্মীরা ঘিরে ধরলেন শাকিবকে। অনুষ্ঠান শুরু হতে কিছুটা বিলম্ব। মঞ্চ থেকে তখন কড়া ভাষায় অনুষ্ঠানের উপস্থাপিকা মৌসুমী মৌ বলতে শুরু করলেন, ‘এভাবে ভিড় করলে অনুষ্ঠান শুরু করতে পারব না। দয়া করে সাংবাদিক ভাইয়েরা নির্দিষ্ট জায়গায় যান।’ কিন্তু কে শোনে কার কথা। অবশেষে দীর্ঘ চেষ্টায় ভিড় সরানো গেল। পাঠকদের হয়তো প্রশ্ন, এত ভিড় ঠেলে কোথায় কী করছেন শাকিব খান? এবার খোলাসা করা যাক।
গতকাল সোমবার বাংলা সিনেমা ইন্ডাস্ট্রির জন্য যেন স্মরণীয় একদিন। এই প্রথম ভিডিও স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্ম চরকি, প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান আলফা আই স্টুডিওজ লিমিডেট ও ভারতের স্বনামধন্য প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান এসভিএফ ফিল্মস একসঙ্গে কাজ করছে। তিনটি বড় প্রতিষ্ঠান বাংলা সিনেমাকে এগিয়ে আজ নতুন সিনেমার নাম ঘোষণা করে। পর্দায় দেখানো হয় শাকিব খানের সফল সিনেমার ফুটেজ। তখন আর নতুন করে বুঝতে বাকি থাকে না এই চমক শাকিবকে ঘিরে।
ঘোষণা করা হয়, আগামী ঈদুল আজহায় ‘তুফান’ সিনেমা নিয়ে আসছেন এই তারকা। সিনেমাটি পরিচালনা করবেন ‘পরাণ’, ‘সুড়ঙ্গ’ পরিচালক রায়হান রাফী। অনুষ্ঠানে ‘তুফান’ সিনেমার পোস্টার উন্মোচন করা হয়। সেই পোস্টার এখন ফেসবুকে ভাইরাল হয়েছে। শাকিব খানের ফেসবুক পেজ থেকেই শেয়ার হয়েছে হাজারের বেশি। ফেসবুক যেন ‘তুফান’ময়। বিনোদন অঙ্গনের অনেকেই পোস্টারটির প্রশংসা করছেন।
প্রশ্ন থাকতে পারে, বাংলাদেশের সিনেমার কি এবার ঘুরে দাঁড়ানোর সময়। যার শুরুটা কি এখানেই? সেই কথা উঠে এল ভিডিও স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্ম চরকির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা রেদওয়ান রনি, আলফা আই স্টুডিওজ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শাহরিয়ার শাকিল ও এসভিএফের পরিচালক ও সহপ্রতিষ্ঠাতা মহেন্দ্র সোনির মুখে। তাঁরা একসঙ্গে বাংলা সিনেমাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে চান। বাংলার বৃহৎ দর্শকের কাছে পৌঁছাতে চান।
দেশের সিনেমাকে এগিয়ে নিতে কী বললেন শাকিব খান? তার আগে বলে নেওয়া ভালো, বিশ্ব সিনেমা যে দিন দিন এগিয়ে যাচ্ছে, সেই বিষয়ে ভালোই ধারণা রয়েছে কিং খানের। কীভাবে দক্ষিণের সিনেমা বলিউডের সঙ্গে মিলে বড় বাজার তৈরি করছে, কীভাবে দর্শক তৈরি সেসব যেন ভাবায় এই ঢালিউডের কিং খানকে। তাঁর বক্তব্য সে কথাই বলে।
কথার শুরুতে শাকিব বলেন, ‘আয়োজনটা বড় হবে জানতাম। বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের সবচেয়ে শক্তিশালী প্রোডাকশন হাউস একসঙ্গে রয়েছে। তিনটা পাওয়ার হাউস একসঙ্গে। যে কারণে আয়োজনটা বড় হবে স্বাভাবিক কিন্তু এত বড় হবে আমার ধারণা ছিল না।’
এই সময় শাকিব দেশের সিনেমাকে দাঁড় করান বিদেশি সিনেমা বাজারের সামনে। সেখানে ঢালিউড সিনেমা অবস্থান কোথায়, বাধা কোথায়, সেসব তুলে ধরেন এই তারকা। তিনি বলেন, ‘সাউথের সিনেমা এখন হাজার কোটি টাকার ক্লাসে যাত্রা শুরু করেছে। সেখানে সাউথ ও বলিউড এক হয়ে কাজ করছে। তারা “বাহুবলী”, “কেজিএফ”–এর মতো সিনেমা বানিয়েছে। তারা এখন একসঙ্গে কাজ করছে। আগে এমনটা ছিল না। এই কারণে তাদের সিনেমা আজ বিশ্বে অনন্য উচ্চতায় পৌঁছেছে। কিন্তু আমরা কেন পিছিয়ে?’
ঢালিউড সিনেমা নিয়ে শাকিব খানের স্বপ্ন কী? ঢালিউড সিনেমা নিয়ে কী ভাবেন? শাকিবের মুখেই তা শোনা যাক, ‘স্বপ্ন দেখতাম কোনো দিন দাঁড়িয়ে বলব, আমাদের সিনেমা যুক্তরাষ্ট্রে কী অবস্থা, কতটা শো চলল, বুকিং কেমন; কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, সিঙ্গাপুরের কী অবস্থা..।’ কিছুটা থেমে শাকিব আবার বলতে থাকেন, ‘আমাদের অগ্রযাত্রা কিন্তু শুরু হয়ে গেছে। “সুড়ঙ্গ”, “প্রিয়তমা” রিলিজের পরে দেশের পরে বিদেশেও জনপ্রিয়তা পেয়েছে। প্রবাসী বাঙালিরা গর্ব করে বলেছে, “এগুলোই আমাদের সিনেমা।” এটা ছিল মুগ্ধ করার বিষয়।’
চলতি বছরটা যেন শাকিব খানের ক্যারিয়ারের অন্যতম একটি বছর। এর কারণ ‘প্রিয়তমা’ দেশ–বিদেশে তুমুল আলোচনা তৈরি করেছিল। সব শ্রেণির দর্শক সিনেমা দেখেছেন। সিনেমাটি নিয়ে প্রবাসীদের আগ্রহের কথা এখনো এই তারকা ভুলতে পারেননি। ইতালির গণমাধ্যমে নিজের সিনেমা দেখতে আসা দর্শকদের ভিড় দেখে দেশের সিনেমা নিয়ে আরও বেশি আগ্রহী হয়ে ওঠেন শাকিব।
নিজের বক্তব্যে দেশের সিনেমা নিয়ে আশাবাদ ব্যক্ত করেন শাকিব খান। দীর্ঘদিন ধরে দেশের প্রযোজক ও পরিচালকেরা যে স্বপ্ন দেখেছেন, সেটা যেন আর খুব বেশি দূরে নয়। সেদিকেই তাকিয়ে আছেন শাকিব। উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে তিনি বলেন, ‘সেদিন আর বেশি দূরে নয়, যেদিন আমাদের সিনেমা ১০০ কোটি টাকা আয় করবে। গ্রোস সেল করবে। একটা সময় এমনও মনে হবে যে বাংলা সিনেমার জন্য ১০০ কোটি টাকাও কম। এর কারণ দেশের জনসংখ্যা। নর্থ আমেরিকায় আমাদের ১২ থেকে ১৪ লাখের মতো প্রবাসী রয়েছেন। আবার পশ্চিমবঙ্গের দর্শকও কিন্তু নর্থ আমেরিকায় থাকেন। শুধু নর্থ আমেরিকার বাংলা দর্শক ২৫ থেকে ৩০ লাখ লাখ। সেখানে মিলিয়ন ডলারের বাজার তৈরি হয়ে আছে। শুধু দরকার ছিল বাংলার বড় একটা কোলাবোরেশনের। একসঙ্গে মিলে কাজ করার। একসঙ্গে কাজ না করলে দেশের সিনেমাকে সেই জায়গায় আমরা কখনোই দেখতে পারব না।’
যৌথভাবে ঢালিউড সিনেমাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টাকে সাধুবাদ জানান শাকিব খান। এর সঙ্গে এই তারকাকে রাখার জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান ও চরকির প্রতি। সবশেষে শাকিব খান হেসে বলেন, ‘শত কোটি টাকা ব্যবসা করলে কত দেবে আমাকে? ২৫ ভাগ আমার?’ এরপর হাসতে হাসতেই মঞ্চ থেকে নামেন এই তারকা। উপস্থিত সাংবাদিকেরাও শাকিবের কথায় না হেসে পারেন না।