তাঁর অভিনয় ব্যতিক্রম। আঙ্গিক এবং বাচিক অভিনয়ে তাঁর স্বকীয়তা ছিল। সিনেমা হলে মুগ্ধ হয়ে সেই অভিনয় দেখতে যেতেন দর্শক। হলে দর্শক টানতে ছবির প্রচারণায় আলাদা গুরুত্ব পেতেন এই কৌতুক অভিনেতা। টেলিভিশনের পর্দায় এখনো প্রয়াত অভিনেতা দিলদারের উপস্থিতি তেমনটাই জানান দেয়। গতকাল ১৩ জুলাই ছিল এই গুণী এই অভিনেতার চলে যাওয়ার দিন। ২০০৩ সালের এই দিনে মারা যান।
২০ বছর বয়সে দিলদার প্রথম ক্যামেরার সামনে দাঁড়ান। তার পর থেকেই নিজের জগৎ চেনাতে থাকেন এই অভিনেতা। দিন দিন তিনি কৌতুক অভিনেতা হিসেবে অপ্রতিদ্বন্দ্বী, অনন্য প্রতিভার স্বাক্ষর রাখতে থাকেন বাংলা চলচ্চিত্রে। একসময় তাঁর জন্য লেখা হতে থাকে আলাদা গল্প। এমনও সময় গেছে, প্রযোজকদের আস্থা ছিল, দিলদার মানে হিট ছবি। মানুষকে হাসিয়েই তিনি পেয়েছেন যেমন খ্যাতি, তেমনি কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। তিনি মারা যাওয়ার পর বাংলা চলচ্চিত্রে কৌতুক অভিনয়ের সেই জায়গা এখনো খালি রয়ে গেছে। শক্তিমান এই অভিনেতা জীবদ্দশায় এই শূন্যতা নিয়ে ভাবতেন। তিনি জনপ্রিয় হিসেবে নায়কদের চেয়ে কোনো অংশে কম ছিলেন না।
পরিচালক মালেক আফসারী একটি ভিডিওতে তাঁর নিজস্ব অভিজ্ঞতা শেয়ার করে বলেন, ‘তখন উত্তরার দিকে শুটিং করছিলাম। শুটিং সেটে ফিল্মের দুজন সুপারস্টার বসে আছেন। তাঁদের ঘিরে ভক্তরা অটোগ্রাফের জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়েছেন। কোনোভাবেই ভিড় সরানো যাচ্ছে না। এমন সময় শুটিং সেটে দিলদার চলে আসেন। দিলদার নামটি শুনে প্রায় সব দর্শক হুমড়ি খেয়ে দিলদারের কাছে ভিড় জমান।’ বাংলা চলচ্চিত্রে এই অভিনেতার ৩৮ বছরের ক্যারিয়ার।
এই সময়ে তিনি নাম ভূমিকায় ‘আব্দুল্লাহ’, ‘বীর পুরুষ’, ‘বেদের মেয়ে জোসনা’, ‘স্বপ্নের পৃথিবী’সহ পাঁচ শতাধিক ছবিতে অভিনয় করেছেন। তাঁর জনপ্রিয়তার একটাই কারণ, তিনি দর্শকের কাছে দিলদার হয়ে উঠতে পেরেছিলেন। তিনি শুধু অভিনেতা নন, মানুষ হিসেবে সবার কাছে সমাদৃত ছিলেন। তাঁর সময়ের অন্য শিল্পীদের মন্তব্য, দিলদারের নিজের মধ্যে কোনো অহংকার ছিল না। জীবন যাপনও করতেন স্বাভাবিক।
প্রয়াত এই অভিনেতার দুই মেয়ে। বড় মেয়ে মাসুমা আক্তার রুমা দন্তচিকিৎসক। পরিবার নিয়ে থাকেন নিকেতনের বাসায়।
প্রথম আলোকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘প্রথম দুই বছর বাবাকে স্মরণ করা হতো। এখন আমরাই পারিবারিকভাবে স্মরণ করি। চলচ্চিত্র থেকে যাঁরা বাবাকে স্মরণ করার কথা, তাঁরাই দিনটি ভুলে থাকেন। বাবা তাঁর প্রিয় মানুষদের কাছে এত তাড়াতাড়ি মারা যাবেন, ভাবিনি।’ বিপুল জনপ্রিয় অভিনেতা দিলদারের মৃত্যুর পর তাঁর পরিবারের পাশ থেকে যেন আস্থার দেয়াল সরে যায়। চেনা মানুষগুলো অচেনা হয়ে যান। জন্ম বা মৃত্যু দিনে সেভাবে তাঁকে কেউ স্মরণ করেন না। তাঁদের সংকটের মুহূর্তেও কাউকে পাশে পাননি। কথা প্রসঙ্গে জানা গেল, এই অভিনেতা মারা যাওয়ার সময় বিভিন্ন প্রযোজকের কাছে প্রায় ৮০ লাখ টাকা পারিশ্রমিক পেতেন। পরিবারের দুঃসময়ে এই টাকা তাঁরা পাননি।
এই বিষয়ে তাঁর বড় মেয়ে বলেন, ‘বাবা কখনো কারও কাছে এক-দুবারের বেশি টাকা চাইতেন না। এ জন্য তিনি বেশির ভাগ সময় পারিশ্রমিক অগ্রিম নিয়ে নিতেন। কিন্তু অনেক সময় পরিচিত, কাছের প্রযোজকদের কাছে অগ্রিম টাকা চাইতেন না। এভাবে বাবার পাওনা ৮০ লাখ টাকা জমা হয়েছে। ওই সময় প্রযোজকদের কাছ থেকে বাবার পাওয়া ৩৫ লাখ টাকার চেক বাসায় ছিল, সেই টাকাও ওই সময় আমরা পাইনি।’ এই সময় তিনি সুপারহিট ‘আবদুল্লাহ’ ছবির কথা উল্লেখ করে বলেন, ‘ছবির প্রযোজকের সঙ্গে বাবার চুক্তি হয়েছিল, যদি ছবিটি সিনেমা হলে চলে, তাহলে তাঁরা বাবাকে ১০ লাখ টাকা পারিশ্রমিক দেবেন, ব্যর্থ হলে কোনো টাকা পাবেন না। কারণ, নায়ক হিসেবে বাবাকে নিয়ে প্রযোজক ঝুঁকি নিচ্ছেন। বাবাও রাজি হন।
পরে “আব্দুল্লাহ” ছবিটি হিট হলেও বাবা ছবির পারিশ্রমিক পাননি। এখন কে টাকা দিল না-দিল, এগুলো নিয়ে আমাদের আর কোনো দাবিদাওয়া নেই। আফসোসও নেই। বাবা নেই, এগুলো আমরা বলতেও চাই না। সবার কাছে একটাই চাওয়া, আপনারা বাবার জন্য দোয়া করবেন।’
দিলদারের ছোট মেয়ে জিনিয়া আফরোজ। প্রথম আলোকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে জিনিয়া বলেন, ‘চলচ্চিত্রের জন্য বাবা তাঁর পুরোটা জীবন বিলিয়ে দিয়েছেন। মৃত্যুর আগপর্যন্ত আপাদমস্তক চলচ্চিত্রের মানুষই ছিলেন। চলচ্চিত্রের ব্যস্ততায় দিনের পর দিন বাবার চেহারাটাও দেখতাম না। সকালে ঘুম থেকে উঠেই দেখতাম বাবা ঘরে নেই। আর রাতে যখন আমরা ঘুমিয়ে পড়তাম, তখন বাসায় ফিরতেন। সবার কাছে তখন বাবার কত কদর। কত লোকজন আসতেন বাসায়।’
স্মৃতিচারণা করে জিনিয়া বললেন, ‘বাবার জনপ্রিয়তা এমন ছিল, তাঁকে নিয়ে আমরা বাইরে কোথাও বের হতে পারতাম না। খুব ভিড় লেগে যেত। বেঁচে থাকতে ঠিকমতো বাবার সঙ্গওটাও পেতাম না। ১৯৯৫ সালের একটা ঘটনার কথা বলি। বোনের বিয়ের কেনাকাটা করতে মৌচাক মার্কেট গিয়েছিলাম। মুহূর্তের মধ্যে চাউর হয়ে যায়, দিলদার মার্কেটে এসেছেন। প্রচুর ভিড় হয়ে যায়। অবস্থা এতটাই ভয়ংকর আকার ধারণ করে, শেষ পর্যন্ত দোকানের গেটে তালা মেরে দিতে বাধ্য হন মালিক। এরপর মার্কেটের নিরাপত্তাপ্রহরী ও পুলিশ এসে আমাদের গাড়িতে তুলে দেয়। বাবাকে নিয়ে সেদিন গাড়ি বের করতেও বেশ কষ্ট হয়েছিল। ওসব অনুভূতি আমাদের আনন্দের। তাই এটা ভেবে ভালো লাগে, যাঁদের ভেতর সত্যিকার অর্থে বাবার বেঁচে থাকা উচিত, তিনি তাঁদের মাঝে ঠিকই আছেন। তাই কষ্টও পাই না। দর্শকহৃদয়ে বাবা ঠিকই আছেন।’
দিলদারের মা-বাবার দেওয়া নাম ছিল দেলোয়ার হোসেন। এদিকে এক মামার নামও ছিল দেলোয়ার হোসেন। তাই চলচ্চিত্রে আসার আগে ভাবলেন, নামটা বদলে ফেলবেন। সবার সম্মতিতে রাখলেন দিলদার হোসেন। বদলে যাওয়া এই নামেই তিনি ঠাঁই করে নেন দর্শকের হৃদয়ে।