কয়েক বছর ধরেই এফডিসিকেন্দ্রিক পরিচালকের বলার মতো সাফল্য নেই। অন্যদিকে ভালো করছেন ছোট পর্দা থেকে উঠে আসা নির্মাতারা। বিশ্লেষকেরা বলছেন, এফডিসিকেন্দ্রিক অনেক নির্মাতাই এই সময়ের উপযোগী সিনেমা তৈরি করতে পারছেন না।
২০২০ সাল থেকে এ পর্যন্ত গত সাড়ে তিন বছরে প্রায় দেড় শ সিনেমা মুক্তি পেয়েছে। এগুলোর মধ্যে যে সিনেমাগুলো সাড়া ফেলেছে, বেশির ভাগই বানিয়েছেন ছোট পর্দা থেকে আসা নির্মাতারা। ‘বিশ্বসুন্দরী’, ‘বীর’, ‘মিশন এক্সট্রিম’, ‘মিশন এক্সট্রিম ২’, ‘লিডার: আমি বাংলাদেশ’, ‘শ্বশুরবাড়ি জিন্দাবাদ ২’, ‘জ্বীন’, ‘লোকাল’, ‘শান, ‘গলুই, ‘পরাণ’, ‘হাওয়া’, ‘অপারেশন সুন্দরবন’, ‘দামাল’, ‘প্রহেলিকা’, ‘প্রিয়তমা’, ‘সুড়ঙ্গ’সহ গত সাড়ে তিন বছরে ২০টির মতো সিনেমা কমবেশি আলোচনায় এসেছে। এর মধ্যে ‘পরাণ’, ‘হাওয়া’, ‘প্রিয়তমা’, ‘সুড়ঙ্গ’সহ কয়েকটি সিনেমা দেখতে দর্শকদের ব্যাপক আগ্রহ লক্ষ করা গেছে। ‘হাওয়া’, ‘প্রিয়তমা’, ‘সুড়ঙ্গ’র মতো কয়েকটি আবার দেশের বাইরেও আয়ের রেকর্ড গড়েছে। মেজবাউর রহমান সুমন, হিমেল আশরাফ, রায়হান রাফী—তিন ছবির পরিচালকই ছোট পর্দা থেকে আসা।
গলদ কোথায়
চলচ্চিত্র–সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, এফডিসিকেন্দ্রিক সিনেমার নামীদামি যেসব পরিচালক একটা সময় একের পর এক হিট সিনেমা উপহার দিয়েছেন, তাঁদের প্রায় কেউই আর সিনেমা বানান না। তাঁদের অনেক সহকারী এখন নিয়মিত সিনেমা করছেন। কিন্তু তাঁদের সিনেমা পূর্বসূরিদের মতো সাফল্য পাচ্ছে না। এ প্রসঙ্গে একসময়ের জনপ্রিয় পরিচালক মতিন রহমান বলেন, ‘যাদের নির্মাণকৌশল ভালো, স্বকীয়তা আছে, গল্প বলায় ভালো, তাদের ছবি ভালো যাচ্ছে। বিভিন্ন মাধ্যম থেকে আসা পরিচালকেরা বিশ্ব চলচ্চিত্রের আবেদন, ভাষা বুঝতে পেরেছেন। ফলে তাঁদের সিনেমা ভালো হচ্ছে। এতে কোনো দ্বিমত নেই। বর্তমান সময়ের দর্শকেরা নানা দেশের, নানা ভাষার ছবি দেখে একটা রুচি তৈরি হচ্ছে। সেই টেস্টের কাছাকাছি যাঁরা নির্মাণ করতে পারছেন, তাঁদের ছবি চলছে।’
এফডিসিকেন্দ্রিক নির্মাতাদের সমালোচনা করে এই পরিচালক আরও বলেন, ‘এসব পরিচালক নির্মাণ–স্টাইলে সেই পুরোনো ঘরানায় প্রভাবিত হয়ে আছেন। তাঁরা আধুনিক আবেদনটা এখনো ধরতে পারছেন না। না ধরতে পারলে এফডিসির ছবির বড় ছন্দপতন হবে। দর্শক কী ধরনের ছবি দেখতে চান, তা এসব পরিচালকের ভাবতে হবে। তাঁরা চাইলে দর্শক জরিপও করতে পারেন। তাঁদের জানতে হবে, অন্য মাধ্যম থেকে আসা পরিচালকের ছবিগুলো দর্শক কেন দেখছেন? তাহলে নিজেদের ভুলত্রুটি ধরতে পারবেন।’
এ ব্যাপারে নির্মাতা কাজী হায়াৎ বলেন, ‘এখনকার (এফডিসিকেন্দ্রিক) পরিচালকের কোনো গবেষণা নেই। এখন যেসব ছবি দর্শক গ্রহণ করছেন, সেসব ছবি দেখে তাঁদের শেখার আছে। আমরা আগে যেসব দর্শককে টার্গেট করে ছবি বানাতাম, সেই দর্শক এখন আর নেই। কিন্তু আমাদের উত্তরসূরিরা সেই আগের ধারা এখনো অনুসরণ করছে। এখন নিম্নবিত্ত, উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত—সব শ্রেণির দর্শকই সিনেমা হলে যাচ্ছেন। সেই দিকটাও মাথায় রাখতে হবে।’
এই পরিচালক গত ঈদে মুক্তি পাওয়া আলোচিত সিনেমা ‘প্রিয়তমা’য় অভিনয় করেছেন। ছোট পর্দা থেকে আসা নির্মাতা হিমেল আশরাফের সঙ্গে কাজের অভিজ্ঞতা জানিয়ে তিনি বলেন, ‘চার মিনিটের একটি দৃশ্যের জন্য টানা এক শিফট আমাকে দিয়ে শুটিং করিয়েছে হিমেল। ভালো কাজের জন্য এটাও একটা ব্যাপার।’
কী বলছেন পরিচালকেরা
প্রথমে শওকত জামিল, পরে শহীদুল ইসলাম খোকনের সহকারী পরিচালক ছিলেন অপূর্ব রানা। এফডিসিকেন্দ্রিক এই পরিচালকের সব৴শেষ মুক্তিপ্রাপ্ত ছবি ‘পুড়ে যায় মন’ ও ‘ইনোসেন্ট লাভ’। একটিও আলোচনায় আসেনি। বর্তমান তিনি নির্মাণ করছেন রাইটার ও জলরং নামের দুটি ছবি। এমন পরিস্থিতি নিয়ে এই পরিচালকের বক্তব্য, ‘যাঁরা এফডিসিকেন্দ্রিক ব্যবসাসফল ছবি উপহার দিয়েছেন, তাঁরা এখন আর ছবি বানান না। আগেকার সেই বড় বড় প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানও নেই। আমরা যাঁরা ছবি বানাচ্ছি, পেশাদার প্রযোজকের অভাববোধ করছি। কম বাজেট দিয়ে ভালো ছবি কীভাবে হবে। অন্যদিকে ওটিটি, টেলিভিশন থেকে যে পরিচালক মূলধারার সিনেমা বানাচ্ছেন, তাঁদের বাজেটের সমস্যা নেই। কাজও ভালো হচ্ছে। তা ছাড়া থার্টি ফাইভ থেকে সিনেমা ডিজিটালে রূপান্তরিত হওয়ার কারণে একটি সমস্যা হয়ে গেছে এফডিসিকেন্দ্রিক পরিচালকদের।’
ছোট পর্দা থেকে চলচ্চিত্রে আসা সফল পরিচালকদের একজন এস এ হক অলীক। ‘হৃদয়ের কথা’, ‘আরও ভালো বাসব তোমায়’, ‘আকাশছোঁয়া ভালোবাসা’, ‘এক পৃথিবী প্রেম’ এবং সব৴শেষ গত বছর মুক্তি পাওয়া তাঁর ‘গলুই’ বানিয়েছেন তিনি।
এফডিসিকেন্দ্রিক পরিচালকেরা কেন পারছেন না, এ প্রসঙ্গে অলীক জানান নিজের মত, ‘সময়ের সঙ্গে তাঁরা হয়তো নিজেকে খাপ খাওয়াতে পারছেন না। এতে করে তাঁদের সিনেমা পিছিয়ে পড়ছে। ফলে তাঁদের দর্শকপ্রিয় সিনেমার শূন্যতা তৈরি হয়েছে। যেটি এখন ছোট পর্দার পরিচালকেরা পূরণ করছে।’