টিকিট বিক্রির টাকার অসমবণ্টন নিয়ে অনেক দিন থেকেই পরস্পরের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে আসছেন হলমালিক ও প্রযোজক। দুই পক্ষের সঙ্গেই কথা বললেন মনজুর কাদের
দেশে ৪০০ টাকায় সিনেমার টিকিট থেকে যাবতীয় খরচ বাদে প্রযোজক পান ৮৮ টাকা ৫০ পয়সা। পরের সপ্তাহে এটা ৭৯ টাকা ৬৫ পয়সা। তৃতীয় সপ্তাহে ৭০ টাকা ৮০ পয়সা। আর প্রেক্ষাগৃহের মালিক পাচ্ছেন ৩১২ টাকা, যেখানে থাকছে এসি রক্ষণাবেক্ষণ ১৩৪ টাকা ৩৭ পয়সা, ভ্যাট ২৭ টাকা ৮৮ পয়সা, পৌর কর ২১ টাকা ৬৬ পয়সা, গৃহকর ২১ টাকা ৬৬ পয়সা। অন্যদিকে পাশের দেশ ভারতে ৪০০ রুপির (৫৬৯ টাকা) টিকিট বিক্রিতে ১৮ শতাংশ পণ্য ও পরিষেবা কর বাদ দিয়ে প্রযোজক পান ১৬৪ রুপি (২৩৩ টাকা)। জনপ্রিয় তারকার ছবির ক্ষেত্রে তা ৫২ দশমিক ৫ শতাংশ।
এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, ইউরোপের বিভিন্ন দেশে চলচ্চিত্র পরিবেশনা ও ব্যবসার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বেশির ভাগ দেশের কোথাও মোট বিক্রির ওপর প্রযোজক ও হলমালিক ফিফটি ফিফটি ভাগাভাগি হয়। আবার কখনো হলমালিক-প্রযোজক ৬০-৪০ ভাগাভাগি হয়। একমাত্র বাংলাদেশ চলছে উল্টো পথে। টাকা ভাগাভাগি কখনোই ঠিকঠাক হয়নি, প্রযোজকদের এমনটাই অভিযোগ।
প্রযোজককেই বলা যায় সিনেমার প্রাণ। তাঁদের লগ্নি করা টাকা থেকেই আয় করেন সিনেমাসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। কিন্তু প্রেক্ষাগৃহ থেকে পাওয়া টিকিটের মূল্য থেকে প্রযোজকেরা আদৌ কত টাকা আয় করেন, এ নিয়ে রয়েছে বিস্ময়।
দেশের মাল্টিপ্লেক্সগুলোতে ৩৫০, ৪০০, ৪৫০, ৫০০ থেকে শুরু করে ১ হাজার ৫০০ টাকার টিকিট রয়েছে। ৩৫০ টাকার কার্ড থেকে দেখা গেছে, প্রবেশমূল্য ১৪৪ দশমিক ৪৩ টাকা, এসি রক্ষণাবেক্ষণ ১৩৪ টাকা ৩৭ পয়সা, ভ্যাট ২৭ টাকা ৮৮ পয়সা, পৌর কর ২১ টাকা ৬৬ পয়সা, গৃহকর ২১ টাকা ৬৬ পয়সা। এর মধ্যে শুধু প্রবেশমূল্যের ১৪৪ টাকা ৪৩ পয়সার ফিফটি ফিফটি ভাগাভাগি হয় প্রযোজক ও হলমালিকের মধ্যে।
বছরের সবচেয়ে আলোচিত সিনেমা ‘তুফান’ প্রযোজনায় ছিল এসভিএফ-আলফা আই এন্টারটেইনমেন্ট। প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক শাহরিয়ার শাকিল জানালেন, দেশে ১০ কোটি বাজেটে তৈরি ছবির টাকা ওঠাতে হলে কমপক্ষে ৫০ কোটি টাকার টিকিট বিক্রি করতে হবে। তা ছাড়া লাভ সম্ভব নয়।
মাল্টিপ্লেক্স ও সিঙ্গেল স্ক্রিনের সঙ্গে ব্যবসায়িক অভিজ্ঞতা কথা এই প্রযোজক জানালেন এভাবে, ‘টিকিট বিক্রিতে সরকারকে যে টাকা দিতে হয়, সেটা বাদে শেয়ারিং ফিফটি ফিফটি হওয়া উচিত। আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, ইউরোপেও কিন্তু তা–ই, টিকিট বিক্রির টাকা প্রযোজক ও হলমালিকের মধ্যে সমানভাবেই ভাগাভাগি হয়।’
৪০০ টাকার টিকিটে এসি বিলই ১৫৪ টাকা!
গেল কয়েক বছরে ব্যবসাসফল ছবির তালিকায় আছে ঢাকা অ্যাটাক, আয়নাবাজি, দেবী, প্রিয়তমা, হাওয়া, পরাণ, রাজকুমার, তুফান। বেশির ভাগ প্রযোজকের ভাষ্য, স্টার সিনেপ্লেক্স যেটা করে, ব্লকবাস্টার, মধুমিতা, শ্যামলীসহ সব প্রেক্ষাগৃহ কর্তৃপক্ষ একই পদ্ধতিতে টাকা ভাগাভাগি করে, যা কোনোভাবেই ন্যায়সংগত নয়।
শাহরিয়ার শাকিল বলেন, ‘১০০ টাকায় আমরা গড়ে ২০ টাকা পাচ্ছি। সিঙ্গেল স্ক্রিনে একটু বেশি পাচ্ছি বলে গড়ে ২০ শতাংশ বলতে পারছি। ৪০০ টাকার একটা টিকিটে প্রথমে ভ্যাট, পৌর কর, শীতাতপনিয়ন্ত্রণ যন্ত্র বাবদ ২২৩ টাকা নেই। এরপর বাকি টাকার ফিফটি ফিফটি হিসাব! সবচেয়ে অবাক করা ব্যাপার হচ্ছে, ৪০০ টাকার টিকিটে এসির বিল ১৫৪ টাকা, ১ হাজার ৫০০ টাকার টিকিটে ৬৯০ টাকা! এটা একটা অরাজকতা।’
ঢাকার বাইরে বগুড়ার মধুবন সিনেপ্লেক্স কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ৩০০ টাকার টিকিটে প্রবেশমূল্য ধরা হয়েছে ১২০ টাকা। এই টাকার ফিফটি ফিফটি শেয়ারিং হয় প্রযোজক ও হলমালিকের সঙ্গে। বাকি ১৮০ টাকার মধ্যে শীতাতপনিয়ন্ত্রণ যন্ত্রের ফি ৯৪ টাকা, রক্ষণাবেক্ষণ ফি ৫৩ টাকা, ভ্যাট ২৭ টাকা ও পৌর কর ৬ টাকা হলমালিক কেটে রাখেন।
যৌথ প্রযোজনার ছবি ‘স্বামী কেন আসামী’ দিয়ে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের বাজারে প্রবেশ করে ভারতের প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান এস কে মুভিজ। শিগগিরই এই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যৌথ প্রযোজনায় দেশে ‘দরদ’ মুক্তি পাবে।
এস কে মুভিজের কর্ণধার অশোক ধানুকা গতকাল মঙ্গলবার তাঁর দেশের টিকিটের টাকা ভাগাভাগির বিষয়টি বললেন, ‘আমাদের এখানে নতুন ছবি, সেটা যদি গড়পড়তা ছবিও হয়, মনে করা হয়, বড় কোনো কালেকশন হবে না, তারকা ভ্যালু কম থাকে, তাহলেও সেসব ছবির ক্ষেত্রে জিএসটি ১৮ শতাংশ বাদ দিয়ে শুধু প্রযোজক ও হলমালিকের শেয়ারিং হয় ফিফটি ফিফটি। ২৫০ রুপির টিকিটে ৪৫ রুপি জিএসটি বাদ দিয়ে ২০৫ রুপির ফিফটি ফিফটি প্রযোজক ও হলমালিক পায়। দেখা গেল শাহরুখ ও সালমান খানের ছবি মুক্তি পেল, এ রকম বড় তারকার ছবি হলে এই ভাগাভাগিতে প্রযোজক-পরিবেশক পায় ৫২.৫ শতাংশ আর হলমালিক ৪৭.৫ শতাংশ। হলমালিক যা পায়, সেখান থেকে বিদ্যুৎ বিল, এসি বিলসহ সব সে পরিশোধ করে। পুরো পৃথিবীতে এই নিয়ম আছে, শুধু বাংলাদেশে নেই। আমি ওখানে যখন পরিবেশনার কাজ করেছি, ২০০ টাকার টিকিট বিক্রি করে হলমালিকের কাছ থেকে ৩০ টাকা পেয়েছি!’
বিষয়টি নিয়ে প্রযোজনা ও পরিবেশনা প্রতিষ্ঠান দি অভি কথাচিত্রের প্রধান নির্বাহী জাহিদ হাসান বলেন, ‘নিয়মিত প্রেক্ষাগৃহে ভালো সিনেমা নেই। যে কারণে সিনেমা হলগুলোও সেভাবে ব্যবসা করতে পারে না। এমন পরিস্থিতিতে টিকিটের শেয়ারকৃত টাকা নিয়ে তেমন বলার জায়গা নেই। যদি অবস্থার পরিবর্তন হয়, তখন যাঁরা নীতিনির্ধারক আছেন, তাঁরা হয়তো বিষয়টি দেখবেন।’
মধুমিতা প্রেক্ষাগৃহের কর্ণধার ইফতেখারউদ্দিন নওশাদ বলেন, ‘এখন তো সিনেমাই নেই। দু–একটা সিনেমা যা–ও ভালো যাচ্ছে, তা–ও খুব কম। আমরা আগের নিয়ম মেনেই টিকিট থেকে লভ্যাংশ দিয়ে থাকি।’
স্টার সিনেপ্লেক্সের দায়িত্বশীল একজন কর্মকর্তা এ বিষয়ে কোনো কথা বলতে চাননি। তিনি বললেন, এটা আসলে মালিকপক্ষের বিষয়।
তাহলে সমাধান কী
শাহরিয়ার শাকিল বললেন, ‘আমাদের পরিষ্কার কথা, ভ্যাট–ট্যাক্স বাদ দিয়ে বাকি টাকা প্রযোজক ও হলমালিকে যেন ভাগাভাগি হয়।’
সমাধানের উপায় হিসেবে শাকিল বললেন, ‘প্রদর্শক ও হলমালিকদের নমনীয় হতে হবে। শুধু নমনীয় নয়, ব্যবসায়িক উপায়ও বের করতে হবে। এখন হয়তো হলমালিকেরা পারেন না, বছরে যদি আমরা ১২টি ছবি দিতে পারতাম, তাহলে ভালো হতো। আমরাও তো দিই না। আমরাও পর্যাপ্ত সিনেমা দিলে তখন তাঁরা পোষাতে পারবেন। আমরা একে অপরের পরিপূরক। দুই পক্ষ যদি দুই পক্ষকে নিয়ে উদ্যোগ নেয়, আন্তরিক হয়, তাহলে সম্ভব। হলমালিক নিয়মিত দেশি কনটেন্ট না পেলেও আমাদের মোট বিক্রি থেকে ৪০ শতাংশ পাওয়া লাগবেই। না হলে আমরা কীভাবে ব্যবসা করব! তারা নাহয় ৬০ শতাংশ নিক, তাতেই আমরা খুশি।’
অশোক ধানুকার মতে, ‘হলমালিকেরা শুধু প্রযোজকদেরই মারছে না, নিজেরাও পড়ে যাচ্ছে। কালকে যদি প্রযোজকদের কাছ থেকে ৪০টি ছবি আসে, তাদেরও তো ব্যবসা বাড়বে। এটা তো নয় যে ওদের ব্যবসা বাড়বে না। তাদের ভাবনাটা এমন, সবটাই নিজে খেয়ে নিই, বাদবাকি আর কাউকে কিছু দেব না। প্রযোজক যদি টাকা না পায়, সে তো প্রযোজনা করবে না। ছবি প্রযোজনা প্রযোজক না করলে হলমালিক ছবি পাবে না। মাল্টিপ্লেক্স কেন ইংরেজি ছবির ওপর নির্ভরশীল, ওরা কিনে নিয়ে আসে। এতে পার্সেন্টেজের তো গল্প নেই। কিন্তু কথা হচ্ছে, যে দেশের যে ভাষা, সেখানে সে দেশেরই ছবি কিন্তু বেশি চলবে।’
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সিনেমা ডিস্ট্রিবিউশনে জড়িত আছে স্বপ্ন স্কোয়ারক্রো। এই প্রতিষ্ঠানের বাংলাদেশ অংশের প্রধান নির্বাহী সৈকত সালাহউদ্দীন মনে করছেন, প্রযোজক ও হলমালিকের শেয়ারিং ফিফটি ফিফটি হওয়া উচিত।
তিনি বললেন, ‘আন্তর্জাতিক নিয়মে ১০০ টাকা মূল্যের টিকিট থেকে ৫৫ শতাংশ টাকা পায় মাল্টিপ্লেক্স, বাকি ৪৫ শতাংশের ২৩ শতাংশ প্রযোজক ও ২২ শতাংশ পরিবেশক। তবে বিদেশে সিনেমা প্রদর্শন থেকে শুরু করে সব খরচ বহন করেন পরিবেশক। আমার মতে, এটা সরাসরি ফিফটি ফিফটিতে চলে আসা উচিত। যদিও হলমালিক খরচের কথা বলে থাকেন, তাই ৬০ আর ৪০ হতে পারে। মোটেও এর নিচে নয়। বাইরের দুনিয়াটা আদর্শ ধরে আগানো যেতে পারে। তবে মোট বিক্রির ওপর ৫৫ শতাংশ হলমালিক আর ৪৫ শতাংশ প্রযোজক পাবেন, এমনটা হলে উভয় পক্ষের জন্য ভালো মনে করি।’