যুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্রে সত্যিকার যোদ্ধাদের অভিনয়ের নজির বাংলাদেশ তো বটেই, বিশ্ব চলচ্চিত্রেই খুব কম। বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা ওরা ১১ জন চলচ্চিত্রে মুক্তিযোদ্ধাদের দিয়ে অভিনয় করিয়েছিলেন নির্মাতা-প্রযোজক।
পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ শেষে একাত্তরের ডিসেম্বরে রণাঙ্গন থেকে অস্ত্র হাতে ঘরে ফিরেছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধারা। সেই অস্ত্র নিয়েই ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়েছিলেন খসরু, মুরাদ, হেলাল, বেবি, নান্টু, ওলীন, মঞ্জু, আতা, ফিরোজ, আবু, আলতাফরা। যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের প্রতিকূল পরিবেশে তখন সিনেমা নির্মাণ করা সহজ ছিল না। বলা যায়, দেশের প্রতি ভালোবাসার টানেই সেই অসাধ্য সাধন করেছিলেন দুই বন্ধু—প্রযোজক মাসুদ পারভেজ সোহেল রানা ও পরিচালক চাষী নজরুল ইসলাম।
মুক্তিযুদ্ধে ব্যবহৃত গোলাবারুদও সিনেমার শুটিংয়ে ব্যবহার করা হয়েছিল। সিনেমার প্রয়োজনে কয়েকজন রাজাকারকেও ক্যামেরার সামনে দাঁড় করিয়ে দেওয়া হয়েছিল। এ ছাড়া রাজ্জাক, শাবানা, নূতন, এ টি এম শামসুজ্জামানের মতো শিল্পীরাও অভিনয় করেছিলেন সিনেমায়।
সদ্য স্বাধীন দেশ। সিনেমা তৈরির অবকাঠামো বলতে তেমন কিছু নেই। এমন সময় সিনেমাটি নির্মাণের পরিকল্পনা মাথায় এল কীভাবে? এমন প্রশ্নের উত্তরে ৫০ বছর আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকবাল হলে (বর্তমানে সার্জেন্ট জহুরুল হক হল) ফিরলেন সোহেল রানা। তখন তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র, হলে সক্রিয় রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত।
সোহেল রানা বললেন, ‘যুদ্ধ থেকে ফিরে মনে হলো, যুদ্ধের ছোট ছোট ঘটনা ক্যামেরায় তুলে আনব, যেন যুদ্ধের ঘটনাগুলো ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে তুলে ধরা যায়। মূলত সে চিন্তা থেকেই সিনেমাটি করা। যুদ্ধের ঘটনাগুলো বাস্তবের মতো করে তুলে আনতে সত্যিকারের মুক্তিযোদ্ধাদের দিয়ে অভিনয় করিয়েছি, যুদ্ধের অস্ত্র ব্যবহার করেছি।’
সিনেমার নামকরণ নিয়ে চাষী নজরুল ইসলাম জীবদ্দশায় বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, একাত্তরে ১১টি সেক্টরে মুক্তিযুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছিলেন বাঙালিরা। বিষয়টি মাথায় রেখেই সিনেমার নাম রাখা হয়েছে ওরা ১১ জন। তবে সোহেল রানা বলছেন ভিন্ন কথা। প্রথমে তিনি ‘ওরা’ নামটা রাখতে চেয়েছিলেন। পরে এর সঙ্গে ‘১১’ যোগ করেন। মূলত শ্রুতিমধুর শোনাতেই এমন নামকরণ করা হয়েছে বলে জানালেন তিনি।
স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম এ সিনেমায় ৩০ লাখ শহীদের আত্মত্যাগ, গেরিলাযোদ্ধাদের বীরত্বগাথা তুলে আনা হয়। সেই সঙ্গে দেখানো হয়েছে দেশীয় দালালদের পাকিস্তানিদের পক্ষে কাজ করার ঘৃণ্য ইতিহাস ও তার পরিণতি। এই ছবিতে তুলে আনা হয়েছে নারীদের বীরত্বগাথাও। মুক্তিযুদ্ধে বীরাঙ্গনা নারীর আত্মত্যাগ, যুদ্ধের ময়দানে পুরুষদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াইয়ের চিত্র উঠে এসেছে।
পরিচালক হিসেবে চাষী নজরুল ইসলামের প্রথম সিনেমা ছিল এটি; তার আগে এক যুগ ধরে সহকারী পরিচালক হিসেবে কাজ করেছিলেন তিনি। ওরা ১১ জন সিনেমাটি সেই সময় খ্যাতিমান পরিচালক মুস্তাফিজ বিনা পারিশ্রমিকে করে দিতে চেয়েছিলেন, তবে সোহেল রানা বিনয়ের সঙ্গে তাঁকে ‘না’ করে বলেছিলেন, বন্ধু চাষী নজরুল ইসলামকে তিনি কথা দিয়েছেন।
অর্থের সংস্থান হয়েছিল কীভাবে? এমন প্রশ্নের জবাবে প্রযোজক সোহেল রানা বলেন, ‘নিজের জমানো টাকার সঙ্গে মা–বাবার কাছ থেকে টাকা নিয়ে শুরু করেছিলাম, পরে পরিবেশক প্রতিষ্ঠান স্টার ফিল্মসের সঙ্গে চুক্তির পর শুটিংয়ের টাকা পেয়েছিলাম।’
তখনকার চলচ্চিত্রে অর্থায়নের ধরন একটু আলাদা ছিল। ঢাকায় তখন স্টার ফিল্মসসহ আটটির মতো পরিবেশক প্রতিষ্ঠান ছিল, যেগুলোর মালিক ছিলেন অবাঙালি। কয়েক দিন শুটিং করে ছবি ও গল্প নিয়ে প্রযোজকেরা পরিবেশকদের কাছে যেতেন। গল্প ও সিনেমার শিল্পী পছন্দ হলে তাঁরা প্রযোজকদের সঙ্গে চুক্তি করে অর্থ লগ্নি করতেন। সিনেমা মুক্তির পর লগ্নি করা টাকা তুলে নিতেন পরিবেশকেরা, চুক্তি মোতাবেক নির্ধারিত অঙ্কের লভ্যাংশ পেতেন প্রযোজকেরা।
সোহেল রানা জানালেন, ছবিতে তারকা না থাকলে এখন যেমন প্রযোজক পেতে ঝামেলায় পড়তে হয়, সে অবস্থা তখনো ছিল। স্টার ফিল্মসে অভিনয়শিল্পীদের নাম জমা দেওয়ার পর তারা বলেছিল, ‘কোনো তারকা অভিনেতা নেই? এই সিনেমা তো দেখবে না।’ সোহেল রানা বলেন, ‘শুধু মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়েই সিনেমাটি নির্মাণের পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু স্টার ফিল্মসের আবদারে রাজ্জাক, শাবানাদের মতো তারকাদের সিনেমায় যুক্ত করি।’ স্টার ফিল্মসের সঙ্গে পাঁচ বছরের চুক্তি হয়েছিল সোহেল রানার। মুক্তির আগেই হলমালিকদের কাছ থেকে অগ্রিম অর্থ নিয়ে সিনেমার লগ্নি করা টাকা উঠে এসেছিল বলে জানালেন তিনি।
ওরা ১১ জন-এর শুটিং হয়েছিল জয়দেবপুরে। চিত্রগ্রাহক ছিলেন আবদুস সামাদ। সিনেমায় রাজাকার হত্যার একটি দৃশ্য ছিল। দৃশ্যের প্রয়োজনে ইকবাল হল থেকে কয়েকজন রাজাকারকে ধরে শুটিংয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। তখন রাজাকার, আলবদরদের বিচার হতো ইকবাল হলে। তবে যেভাবে দৃশ্যটি ধারণ করার পরিকল্পনা ছিল, সেভাবে করা যায়নি। পানিতে গুলি করে রাজাকারদের বলা হয়েছিল মৃত্যুর অভিনয় করতে।
সত্যিকারের বীর মুক্তিযোদ্ধাদের দিয়ে অভিনয় করানো কত বড় চ্যালেঞ্জিং ছিল? সোহেল রানা বলেন, ‘ওরা যুদ্ধে যা করেছে, ক্যামেরার সামনেও তা–ই করেছে। ফলে অভিনয় করতে হয়নি। অভিনয়ের যতটুকু দৃশ্য আছে, সেগুলো অভিনয়শিল্পীরা করেছে।’
ছবিটি মুক্তির পর ব্যবসায়িকভাবে যেমন সাফল্য পেয়েছে, তেমনি সমালোচকদের প্রশংসাও পেয়েছিল। ৫০ বছর পর নিজের সিনেমাকে নিয়ে মূল্যায়ন করতে বললে সোহেল রানা বলেন, ‘ওরা ১১ জন স্বাধীনতাযুদ্ধ নিয়ে ভালো ছবি নয়, কিন্তু এটা ওয়ান অব দ্য বেস্ট ডকুমেন্টারি ইন দ্য ওয়ার্ল্ড। মুক্তিযোদ্ধারাই অভিনয় করেছেন, যুদ্ধের আসল গোলাবারুদও ব্যবহার করেছিলেন। ডকুমেন্টারি হিসেবে এটার তুলনা চলে না।’
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানও সিনেমাটি দেখে প্রশংসা করেছিলেন। ছবি মুক্তির পর ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের বাড়িতে সোহেল রানা গেলে তাঁকে জড়িয়ে ধরে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘ভালোই তো করছোস, থেকে (সিনেমায়) যা।’
বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের ইতিহাসে ওরা ১১ জনকে গুরুত্বপূর্ণ সিনেমা হিসেবে মূল্যায়ন করলেন চলচ্চিত্র বিশ্লেষক, নির্মাতা মতিন রহমান। তিনি বলেন, ‘সিনেমার পরিচালক, প্রযোজক, ক্যামেরাম্যান থেকে শুরু করে বেশির ভাগ কলাকুশলী সরাসরি মুক্তিযুদ্ধের অভিজ্ঞতা নিয়েই সিনেমাটি তৈরি করেছেন। তাঁরা মুক্তিযুদ্ধের ভয়াবহতা স্মৃতি থেকে মুছে ফেলেননি, সেগুলো দৃশ্য পরিকল্পনায় রূপান্তর ঘটেছে।’
মতিন রহমান মনে করেন, এ টি এম শামসুজ্জামানসহ সিনেমার আরও কয়েকটি চরিত্রে মেলোড্রামা থাকলেও সেটা বাংলা চলচ্চিত্রের প্রাসঙ্গিক উপাদান হিসেবে এসেছে। তিনি বলেন, ‘এই ছবিকে আমরা একটা ঐতিহাসিক জায়গায় নিতে পারি। নকল আর্মসের কারণে মুক্তিযুদ্ধের সিনেমাগুলো ঠুনকো ও বানানো মনে হয়, সেই হিসেবে রিয়েল বিষয়টি উঠে এসেছে ওরা ১১ জন-এ। তারা মুক্তিযুদ্ধের নতুন জনরা নিয়ে আসতেছে, সেটা চলবে কি না, সেটা তাদের মাথায় ছিল না।’
ওরা ১১ জন সিনেমা শুরু হয় সাইফুল ইসলামের কণ্ঠে রবীন্দ্রসংগীত ‘ও আমার দেশের মাটি’ দিয়ে। শেষ হয় সাবিনা ইয়াসমীনের ‘এক সাগর রক্তের বিনিময়ে’ দিয়ে।