‘লেট দেয়ার বি লাইট’ সিনেমাকে নিজের স্বপ্নের সিনেমা বলতেন চলচ্চিত্রকার জহির রায়হান
‘লেট দেয়ার বি লাইট’ সিনেমাকে নিজের স্বপ্নের সিনেমা বলতেন চলচ্চিত্রকার জহির রায়হান

আসছে ফাল্গুনে আমরা কিন্তু দ্বিগুণ হব...সেই উক্তির স্রষ্টার জন্মদিন আজ

‘আসছে ফাল্গুনে আমরা কিন্তু দ্বিগুণ হব’ কথাটা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়েছে। উক্তিটি ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে রচিত উপন্যাস ‘আরেক ফাল্গুনে’র। উপন্যাসের একেবারে শেষ দিকে ছাত্রদের নাম ধরে ধরে জেলখানায় ঢোকানোর সময় ডেপুটি জেলার সাহেব হাঁপিয়ে ওঠেন; এবং বিরিক্তর সঙ্গে বলেন, ‘উহু, এত ছেলেকে জায়গা দেব কোথায়। জেলখানা তো এমনিতে ভর্তি হয়ে আসছে।’ প্রত্যুত্তরে পাশ থেকে ছাত্রদের মধ্য থেকে একজন চিৎকার করে বলেন, ‘এতেই ঘাবড়ে গেলেন নাকি? আসছে ফাল্গুনে আমরা কিন্তু দ্বিগুণ হব।’ সংগ্রামে, দ্রোহে অনুপ্রেরণা জোগানো এই উক্তিটির স্রষ্টা জহির রায়হান।  

তিনি একাধারে সাংবাদিক, গল্পকার, ঔপন্যাসিক, চলচিত্র পরিচালক ও প্রযোজক। পারিবারিক নাম আবু আবদাল মোহাম্মদ জহিরুল্লাহ। পরবর্তী সময়ে তাঁকে জহির রায়হান নাম দিয়েছিলেন মণি সিংহ। আর এ নামেই তিনি পরিচিত হয়ে ওঠেন । আজ ১৯ আগস্ট, জহির রায়হানের জন্মদিন।

১৯৩৫ সালের ১৯ আগস্ট ফেনীর সোনাগাজী উপজেলার মজুপুর গ্রামে জহির রায়হানের জন্ম। বাবার চাকরি সূত্রে ছেলেবেলার অনেকটা সময় তিনি কাটিয়েছেন কলকাতায়। পড়ালেখা করেছেন কলকাতা মডেল স্কুল এবং মিত্র ইনস্টিটিউটে। তারপর দেশে ফিরে আমিরাবাদ স্কুল থেকে ম্যাট্রিক এবং ঢাকা কলেজ থেকে আইএ পাস করেন তিনি। উচ্চতর পড়ালেখার জন্য ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। বিশ্ববিদ্যালয় জীবন থেকেই শুরু করেন সাংবাদিকতা, যোগ দেন ‘যুগের আলো’ পত্রিকায়।

এবারের আন্দোলনে মিশে গিয়েছে জহির রায়হান নাম। কোলাজ

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় স্নাতক ও স্নাতকোত্তর করা জহির রায়হান বাংলা সাহিত্য তো বটেই চলচ্চিত্রেও সমানভাবে প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন। মাত্র ৩৭ বছরের জীবন পরিধি দিয়েই হয়ে উঠেছেন কালজয়ী। এত অল্প সময়ে এত বিপুল খ্যাতি অর্জনের কৃতিত্ব খুব কম মানুষেরই আছে।
১৯৫৭ সালে ‘জাগো হুয়া সাভেরা’ সিনেমায় সহকারী হিসেবে কাজ করার মধ্য সিনেমা নির্মাণের কাজে যুক্ত হন তিনি। পরিচালক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন ‘কখনো আসেনি’ সিনেমার মাধ্যমে। পাকিস্তানের প্রথম রঙিন চলচ্চিত্র ‘সঙ্গম’–এর (উর্দু) পরিচালক ছিলেন জহির রায়হান। ‘বেহুলা’, ‘সুতপার ঈশ্বর’ জহির রায়হান নির্মিত চলচ্চিত্র। বাঙালির ওপর পাকিস্তানিদের নির্মম অত্যাচারের প্রমাণ তুলে ধরেতে তিনি নির্মাণ করেছিলেন ‘স্টপ জেনোসাইড’ তথ্যচিত্র।

কালজয়ী ঔপন্যাসিক ও চলচ্চিত্রকার জহির রায়হান সমগ্র সৃষ্টিতেই মানুষের জয়গান করেছেন। শোষণ–বঞ্চনার কথা তুলে ধরেছেন গল্পে, উপন্যাস ও চলচ্চিত্রে।
মুক্তিযুদ্ধের আগে নির্মিত চলচ্চিত্র ‘কাঁচের দেয়াল’। ১৮ জানুয়ারি ১৯৬৩ সালে সিনেমাটি মুক্তি পায়। সহজ স্বাভাবিক জীবনে আষ্টেপৃষ্ঠে থাকে লোভ, লালসা ও স্বার্থপরতার মতো প্রবৃত্তিগুলো। আর এ প্রবৃত্তি নিয়ন্ত্রণের মধ্য দিয়েই ব্যক্তি উত্তম হয়ে ওঠেন। আবার কেউ কেউ নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন না। সেই কথা যেন কাঁচের দেয়াল চলচ্চিত্রে বলতে চেয়েছেন জহির রায়হান। দেখা যায়, মামার বাড়িতে লালিত–পালিত এক তরুণী, যাঁর মা মারা যাওয়ার পর বাবা সংসারবিরাগী হয়ে যান। মামাবাড়িতে লাঞ্ছনা-গঞ্জনার মধে৵ জীবন অতিবাহিত হতে থাকে তাঁর। মামাবাড়ির দু-একজন তাঁকে ভালোবাসলেও কষ্টের উপশম মেলে না। আর মেয়েটির লটারি জেতার খবর চাউর হতেই সবাই তাঁকে মাথায় তুলে যত্নআত্তি করতে শুরু করেন। কিন্তু পরে যখন জানতে পারেন, লটারি জেতার খবরটি মিথ্যা তখন আবার আগের মতোই অত্যাচার শুরু হয় তাঁর ওপর; কিন্তু মেয়েটি আর অন্যায়, শোষণ সহ্য করে না। সব বঞ্চনার মুখে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে কাচের দেয়াল ভেঙে বেরিয়ে  পড়ে।

বাংলা চলচ্চিত্র তো বটেই জহির রায়হানেরও অন্যতম শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র ‘জীবন থেকে নেয়া’। জহির রায়হানের পরিচালনায় আনিস ফিল্মস করপোরেশনের পরিবেশনায় ১৯৭০ সালে মুক্তি পেয়েছিল ছবিটি। মুক্তির প্রথম দিনেই নিষিদ্ধ হয়েছিল ছবির প্রদর্শনী। সব সিনেমা হল থেকে জব্দ করা হয়েছিল সিনেমার রিল।

জীবন থেকে নেয়া ছবিতে অভিনয় করেছেন খান আতাউর রহমান ও রওশন জামিল

‘জীবন থেকে নেয়া’র গল্প হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের পটভূমির গল্প। ছবির পোস্টার দেখে পারিবারিক গল্প বলে ভ্রম হলেও ‘জীবন থেকে নেয়া’ মূলত রাষ্ট্রের অধিকার আদায়ের গল্প। ছবিটি তৈরির গল্প প্রসঙ্গে জানা যায়, অবাঙালি প্রযোজক আনিস দোসানি অনুজ পরিচালক জহির রায়হানকে ১৯৬৯-৭০ সালে একটি ছবি বানানোর প্রস্তাব দেন। প্রস্তাব পেয়ে কাহিনি ও চিত্রনাট্যের জন্য অভিনেতা ও নির্মাতা আমজাদ হোসেনকে ডাকেন জহির রায়হান। বলেন, ‘এমন একটা গল্প হবে, যেখানে এক বোন আরেক বোনকে বিষ খাওয়াবে।’ জবাবে আমজাদ বলেন, ‘বোন বোনকে বিষ খাওয়াবে! দর্শক কি ব্যাপারটা গ্রহণ করবে?’

ছবির প্রথম দৃশ্য লিখে ফেললেন আমজাদ; কিন্তু জহিরের নির্দেশনার উল্টো। এক বোন আরেক বোনকে দুধ-ভাত খাওয়ানোর দৃশ্য। জহির স্ক্রিপ্ট দেখলেন। দেখে বলেন, ‘খাওয়াতে বললাম বিষ, আর খাওয়াচ্ছেন দুধ!’ ‘দুধ না খাওয়ালে বিষ খাওয়াব কীভাবে!’ আমজাদের জবাব। পরবর্তী সময়ে সিনেমার গল্প পারিবারিক থেকে রাজনৈতিক হয়ে ওঠে।

প্রদর্শন বন্ধের পরে হলের সামনে দর্শকের বিক্ষোভ এবং পরিস্থিতির অবতারণায় পুনরায় সেন্সর বোর্ড বসে। প্রসঙ্গক্রমে তৎকালীন জেনারেল রাও ফরমান আলী জহির রায়হানের উদ্দেশে বলেছিলেন, ‘ছবিটি ছেড়ে দিলাম, তবে আমি তোমাকে দেখে নেব।’