স্থায়ীভাবে নয়, সাময়িক সময়ের জন্য কার্যক্রম চালিয়ে নিতে সেন্সর বোর্ড পুনর্গঠন করা হয়েছে বলে জানিয়েছে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়।
স্থায়ীভাবে নয়, সাময়িক সময়ের জন্য কার্যক্রম চালিয়ে নিতে সেন্সর বোর্ড পুনর্গঠন করা হয়েছে বলে জানিয়েছে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়।

সেন্সর বোর্ড পুনর্গঠন নিয়ে আলোচনা

বিদ্যমান ‘ বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সার্টিফিকেশন আইন, ২০২৩’–এ ‘সার্টিফিকেশন বোর্ড’ না করে রহিত হওয়া ১৯৬৩ সালের ‘সেন্সরশিপ অব ফিল্মস অ্যাক্ট’–এ ‘সেন্সর বোর্ড’ পুনর্গঠন নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন নির্মাতা, চলচ্চিত্র সংগঠকেরা।

দীর্ঘদিন ধরেই সেন্সর বোর্ড বাতিলের দাবিতে সোচ্চার ছিলেন নির্মাতা আশফাক নিপুন। সেন্সর বোর্ডের বদলে সার্টিফিকেশন বোর্ড চান তিনি।

১৯৬৩ সালের ‘সেন্সরশিপ অব ফিল্মস অ্যাক্ট’ রহিত করে গত বছরের ১৩ নভেম্বর ‘বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সার্টিফিকেশন আইন’ গেজেট আকারে প্রকাশিত হয়। বিদ্যমান সার্টিফিকেশন আইনে সেন্সর বোর্ড নয়, সার্টিফিকেশন বোর্ড গঠনের কথা বলা আছে।

গত রোববার সেন্সরশিপ অব ফিল্মস অ্যাক্টে সেন্সর বোর্ড পুনর্গঠন করে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে সরকার। ১৫ সদস্যের সেন্সর বোর্ডে সেন্সর প্রথা বাতিল চাওয়া আশফাক নিপুনও ছিলেন। সার্টিফিকেশন বোর্ড চেয়ে রোববার রাতেই সেন্সর বোর্ডের সদস্যপদ ফিরিয়ে দিয়েছেন মহানগর নির্মাতা।

বর্তমান সেন্সর বোর্ডে জায়গা পাওয়া নির্মাতা, গবেষক জাকির হোসেন রাজু, নির্মাতা খিজির হায়াত খান, অভিনেত্রী নওশাবা আহমেদসহ আরও কয়েকজন সদস্যও সেন্সর বোর্ডের বিপক্ষে সোচ্চার ছিলেন।

রোববার রাতেই সেন্সর বোর্ডের সদস্যপদ ফিরিয়ে দিয়েছেন ‘মহানগর’ নির্মাতা আশফাক নিপুন

প্রজ্ঞাপন জারির পর সেন্সর বোর্ডের সদস্য, নির্মাতা খিজির হায়াত খান রোববার এক ফেসবুক পোস্টে লিখেছেন, ‘সেন্সর বোর্ড নয়, সার্টিফিকেশন চাই। এটাই চলচ্চিত্র সেন্সর বোর্ডের সদস্য হিসেবে আমার এবং বাংলাদেশের প্রথম দাবি, চলেন আগে বাড়ি।’

সেন্সর বোর্ড পুনর্গঠনের খবর প্রকাশ্যে আসার পর সার্টিফিকেশন বোর্ডকে সামনে আনছেন নির্মাতারা। কেউ কেউ লিখছেন, এখনো সেন্সর বোর্ড কেন?

‘ঊনপঞ্চাশ বাতাস’ নির্মাতা মাসুদ হাসান উজ্জ্বল ফেসবুকে লিখেছেন, ‘আমার সব প্রতিবাদী সহকর্মী চলচ্চিত্র সেন্সর বোর্ডের সদস্য হয়েছেন। আমার আনন্দিত হয়ে সবাইকে শুভেচ্ছা জানানো উচিত। কিন্তু কথা হলো, সবাই মিলে না একসঙ্গে এতগুলো বছর ধরে বলে চলেছি—সেন্সর প্রথা বাতিল হোক, সার্টিফিকেশন প্রথা চালু হোক।’

সবাই মিলে না একসঙ্গে এতগুলো বছর ধরে বলে চলেছি—সেন্সর প্রথা বাতিল হোক, সার্টিফিকেশন প্রথা চালু হোক।
মাসুদ হাসান উজ্জ্বল, নির্মাতা

এখনো সেন্সর বোর্ড কেন

চলচ্চিত্রকর্মীদের দীর্ঘদিনের দাবির মুখে সেন্সরশিপ অব ফিল্মস অ্যাক্ট, ১৯৬৩ রহিত করে সার্টিফিকেশন আইন করেছে বিগত সরকার। এ আইনে সার্টিফিকেশন বোর্ড গঠনের সুযোগ রয়েছে। তবে সেটা না করে সেন্সরশিপ অব ফিল্মস অ্যাক্ট, ১৯৬৩ অনুসারে সেন্সর বোর্ড পুনর্গঠন নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন নির্মাতা, চলচ্চিত্র বিশ্লেষকেরা।

চলচ্চিত্র নির্মাতা ও সংগঠক বেলায়াত হোসেন মামুন মনে করেন, ‘বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সার্টিফিকেশন আইন, ২০২৩’–কে ‘পাশ কাটিয়ে’ আগের আইনে সেন্সর বোর্ড পুনর্গঠন করা সমীচীন হয়নি।

সোমবার বেলায়াত হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘২০২৩ সালের নভেম্বরে আইনটি গেজেট আকারে প্রকাশের পরপরই এটি কার্যকরের কথা ছিল। কেন এটা হয়নি, এটা আশ্চর্যজনক ঘটনা। আইন পাস হয়ে গেছে। আইন পাস হওয়ার পর তা অবিলম্বে কার্যকর করার দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের। কিন্তু আমরা দেখতে পাচ্ছি, ওনারা তা করেননি।’

এ নিয়ে আলোচনার মধ্যে গতকাল মঙ্গলবার বিকেলে এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে ব্যাখ্যা দিয়েছে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয়ের উপসচিব সাইফুল ইসলাম স্বাক্ষরিত বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সার্টিফিকেশন আইন, ২০২৩ গেজেট আকারে প্রকাশিত হলেও আইনের অধীন এখনো বিধিমালা প্রণয়ন করা যায়নি। ফলে আইনটি এখনো কার্যকর হয়নি।

বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, সেন্সর বোর্ডের নিয়মিত কার্যক্রম চালিয়ে নিতে সেন্সরশিপ অব ফিল্মস অ্যাক্ট, ১৯৬৩ ও দ্য বাংলাদেশ সেন্সরশিপ অব ফিল্ম রুলস, ১৯৭৭ অনুযায়ী সেন্সর বোর্ড পুনর্গঠন করা হয়েছে। দ্রুততার সঙ্গে চলচ্চিত্র সার্টিফিকেশন আইনের বিধিমালা প্রণয়নের কাজ চলছে। বিধিমালা প্রণয়ন হলেই আইনের যথাযথ বাস্তবায়ন শুরু হবে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের এক দায়িত্বশীল কর্মকর্তা সোমবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘মাসখানেক ধরে কোনো সিনেমা ছাড়পত্র পায়নি। বিধিমালা প্রণয়নের পর সার্টিফিকেশন বোর্ড গঠনে আরও সময় লাগবে। আপাতত রুটিন কার্যক্রম চালিয়ে নিতে সেন্সর বোর্ড পুনর্গঠন করা হয়েছে।’

বিধিমালা প্রণয়ন হলেই সার্টিফিকেশন বোর্ড গঠন করা হবে বলে জানান তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের আরেক দায়িত্বশীল কর্মকর্তা।

এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আলোচনার মধ্যে গতকাল মঙ্গলবার বিকেলে এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে ব্যাখ্যা দিয়েছে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়

সার্টিফিকেশন বোর্ড কবে?

নাম প্রকাশ না করার শর্তে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের এক দায়িত্বশীল কর্মকর্তা সোমবার প্রথম আলোকে জানান, সার্টিফিকেশন আইনের অধীন খসড়া বিধিমালা তৈরি করা হয়েছে। সেটি চূড়ান্ত হতে অন্তত ছয় মাস লাগতে পারে। বিধিমালা চূড়ান্ত হলেই সার্টিফিকেশন বোর্ড গঠন করা হবে।

গেটেজ প্রকাশের এক বছরেও কেন বিধিমালা চূড়ান্ত হয়নি, তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।

ফেডারেশন অব ফিল্ম সোসাইটিজ অব বাংলাদেশের সাধারণ সম্পাদক বেলায়াত হোসেন মামুন বলছেন, ‘বিধিমালা মন্ত্রণালয়ের অভ্যন্তরীণ বিষয়। তারা এই অভ্যন্তরীণ বিষয়টি গত নভেম্বর থেকে এখন সেপ্টেম্বর পর্যন্ত করতে পারল না কেন?’

দ্রুততম সময়ের মধ্যে বিধিমালা প্রণয়নের পর সার্টিফিকেশন বোর্ড গঠনের দাবি তুলেছেন নির্মাতারা।

দ্রুততম সময়ের মধ্যে বিধিমালা প্রণয়নের পর সার্টিফিকেশন বোর্ড গঠনের দাবি তুলেছেন নির্মাতারা।

সার্টিফিকেশন বোর্ড নিয়ে আলোচনার মধ্যে প্রশ্ন উঠেছে, সার্টিফিকেশন বোর্ড গঠনের পর বর্তমান সেন্সর বোর্ডের কী হবে? সেন্সর বোর্ডের সদস্যদের নিয়েই সার্টিফিকেশন বোর্ড গঠন করা হতে পারে বলে ইঙ্গিত দিয়েছেন তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা।

তবে চলচ্চিত্র বিশ্লেষকেরা বলছেন, আগে সেন্সর বোর্ড বাতিল করতে হবে। তারপর সার্টিফিকেশন আইন অনুসারে সার্টিফিকেশন বোর্ড গঠন করা যেতে পারে।

সেন্সর বোর্ড থেকে সার্টিফিকেশন বোর্ডে রূপান্তর কীভাবে হতে পারে, তার ধারণাও দিলেন বেলায়াত হোসেন মামুন। তিনি বলেন, ‘আইনের শেষ দিকে বলা হয়েছে, এতকাল ধরে সেন্সর বোর্ড ছিল। সার্টিফিকেশন বোর্ড হওয়ার পর সেন্সর বোর্ডের কাগজপত্র সার্টিফিকেশন বোর্ডের কাছে হস্তান্তর করতে হবে। কাগজপত্রে সেন্সর বোর্ডের স্থলে সার্টিফিকেশন বোর্ড লেখা হবে।’

সার্টিফিকেশন আইন কার্যকর হলে চলচ্চিত্র সেন্সর বোর্ডের নাম চলচ্চিত্র সার্টিফিকেশন বোর্ড হবে। সার্টিফিকেশন আইন অনুসারে একজন চেয়ারম্যান ও অনধিক ১৪ সদস্যের সার্টিফিকেশন বোর্ড গঠনের কথা বলা হয়েছে।

সার্টিফিকেশন বোর্ডের কাজ কী

সার্টিফিকেশন আইন কার্যকর হলে চলচ্চিত্র সেন্সর বোর্ডের নাম বদলে চলচ্চিত্র সার্টিফিকেশন বোর্ড হবে। সার্টিফিকেশন আইন অনুসারে একজন চেয়ারম্যান ও অনধিক ১৪ সদস্যের সার্টিফিকেশন বোর্ড গঠনের কথা বলা হয়েছে।

বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সার্টিফিকেশন আইনের বেশির ভাগ ধারা সেন্সরশিপ অব ফিল্মস অ্যাক্ট থেকে নেওয়া হয়েছে। খসড়া প্রণয়নের পর দফায় দফায় আইনটি নিয়ে আপত্তি তুলেছিলেন চলচ্চিত্রকর্মীরা। কয়েকটি ধারার সঙ্গে সার্টিফিকেশন আইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিকও।

সার্টিফিকেশন আইন কার্যকর হলে চলচ্চিত্র সেন্সর বোর্ডের নাম চলচ্চিত্র সার্টিফিকেশন বোর্ড হবে

চলচ্চিত্র নির্মাতা, চলচ্চিত্র শিক্ষক, চলচ্চিত্র গবেষক ও চলচ্চিত্রকর্মীদের আপত্তি আমলে না নিয়েই আইনটি পাস করেছে বিগত সরকার। সার্টিফিকেশন আইনেও কোনো চলচ্চিত্রের সার্টিফিকেশন সাময়িত স্থগিত বা বাতিলের অধিকার রাখা হয়েছে।

চলচ্চিত্র বিশ্লেষকেরা বলছেন, সার্টিফিকেশন আইনের বেশ কিছু ধারা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। আইনটি কার্যকর হওয়ার পর তাঁরা সংস্কার চাইবেন। আইনের গ্রেডিং প্রথাকে ইতিবাচকভাবে দেখছেন তাঁরা।

বেলায়াত হোসেন মামুন বলেন, ‘সার্টিফিকেশন বোর্ডও সেন্সর বোর্ডের মতোই ছবি দেখবে। তবে সার্টিফিকেশন বোর্ড কোনো ছবি আটকানোর জন্য দেখবে না। ছবিটি কোন বয়সের মানুষ দেখতে পারবে, কোন বয়সের মানুষ দেখতে পারবে না, সেটা নির্দিষ্ট করবে সার্টিফিকেশন বোর্ড।’