২০২২ সালের ১০ জুলাই মুক্তি পায় ‘পরাণ’। ব্যাপক ব্যবসায়িক সাফল্য পায় ছবিটি। এই ঈদে মুক্তি পাওয়া রায়হান রাফীর আরেক সিনেমা ‘সুড়ঙ্গ’ও হাঁটছে একই পথে। ‘পরাণ’-এর বর্ষপূর্তি, ‘সুড়ঙ্গ’-এর সাফল্য নিয়ে কথা বলেছেন পরিচালক।
‘“পরাণ” আমার আত্মবিশ্বাস বাড়িয়ে দিয়েছে,’ গত বছর মুক্তি পাওয়া আলোচিত ছবিটিকে কীভাবে মনে রাখবেন, প্রশ্ন করতেই এক লাইনে এই উত্তর দিলেন রায়হান রাফী। কারণটাও পরে ব্যাখ্যা করলেন। প্রথম ছবি ‘পোড়ামন টু’ হিট হওয়ার পরও নিজের মতো করে কাজ করতে পারছিলেন না। এর মধ্যে খুব কম বাজেটে ‘পরাণ’ তৈরির পরই শুরু হলো করোনা। দুই বছর সব প্রায় বন্ধ। পরিচালকের আত্মবিশ্বাসও তলানিতে, ‘একটা সিনেমা পুরোনো হয়ে গেলে সেটার মেরিটও কিছুটা কমে যায়। কারণ, সবকিছুর তো একটা সময় থাকে। এর মধ্যে ওটিটির অনেক কাজ করলাম। নিজের মধ্যেও দ্বিধা তৈরি হলো—আমার পুরোনো কাজ কি মানুষের ভালো লাগবে?’ কিন্তু মুক্তির পর ছবিটি মানুষ যখন পছন্দ করল, আত্মবিশ্বাস ফিরে পেলেন রাফী।
শুভর জায়গায় রাজ আর অন্য মিম
‘পরাণ’-এ শরীফুল রাজের অভিনীত চরিত্রটির জন্য আরিফিন শুভকে ভেবেছিলেন পরিচালক। চিত্রনাট্য পড়ে শুভ পছন্দও করেছিলেন। কিন্তু তাঁর অন্য কাজের সঙ্গে ‘পরাণ’-এর শুটিংয়ের সময় পড়ায় ছবিটি করতে পারেননি তিনি। এরপরই যুক্ত হন রাজ। রাফীর ভাষ্যে, ‘মনে হলো নতুন কাউকে নিয়ে কাজ করব। রাজকে খুঁজে বের করলাম। ও তখন একেবারে নতুন, “ন ডড়াই”-এর প্রস্তুতি নিচ্ছে। প্রযোজনা সংস্থা চাইছিল কোনো তারকা। অনেক কষ্ট করে ওদের রাজি করাতে হয়েছে।’ ছবিটি দিয়েই বিদ্যা সিনহা মিমের ক্যারিয়ার নতুন গতি পায়। চরিত্রটির জন্য লম্বা কাউকে দরকার ছিল, তাই মিমের কথা আগেই ভেবে রেখেছিলেন পরিচালক। এ ছাড়া মিমকে বারবারই গ্লামারাস চরিত্রে ভাবা হয়। এটা ভেঙে অভিনেত্রী হিসেবে তাঁকে তুলে ধরতে চেয়েছিলেন তিনি।
রুদ্ধশ্বাস এক সপ্তাহ
‘পরাণ’ সম্পর্কে বলতে গিয়ে পরিচালক জানালেন ছবিটি নিয়ে আরেকটি অজানা তথ্য—ছবিটির আট দিনের শুটিংয়ের ফুটেজ হারিয়ে গিয়েছিল! শুটিং শেষে ভারতে সম্পাদনার কাজ শুরু হয়েছিল। কোভিড বিধিনিষেধ শুরু হওয়ার পর আর ভারতে যাওয়ার উপায় রইল না। ফুটেজ দেশে ফিরিয়ে আনলেন পরিচালক। পরে জানা গেল, ৩০ দিনের মধ্যে ৮ দিনের শুটিংয়ের ফুটেজই গায়েব!
‘শুটিংয়ের দেড় বছর পর আট দিনের ফুটেজ হারিয়ে টেনশনে পড়ে গেলাম। কারণ, এত দিন পর নতুন করে শুটিং করলে চেহারা তো মিলবে না। ভারতে, বাংলাদেশে বারবার খোঁজ নিয়েও ফুটেজের হদিস পাচ্ছিলাম না। প্রায় অলৌকিকভাবে এক সপ্তাহ পর পুরোনো একটা হার্ডডিস্কে ফুটেজটা খুঁজে পাই,’ বলছিলেন রাফী।
‘সুড়ঙ্গ’–এর সাফল্যের পর
‘পরাণ’–এর মতো সুড়ঙ্গও যে মানুষের মুখে মুখে ছড়িয়েছে, এতে দারুণ খুশি পরিচালক। বিশেষ করে ঢাকার বাইরের হলমালিকেরা যেভাবে ছবিটি নিয়ে নারী দর্শকের আগ্রহের কথা জানাচ্ছেন, সেটা রাফীকে আরও আনন্দিত করেছে। তিনি বললেন, ‘এবার ঈদের সিনেমার জোয়ারে অন্য সবকিছু আড়ালে পড়ে গেছে। যে ইন্ডাস্ট্রিকে এত দিন আমরা মৃত বলতাম; অভিনয়শিল্পীদের ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে বিতর্ক, নির্বাচন নিয়ে আলোচনা—এসবই চলছিল। এ অবস্থায় এমন একটা ঈদ যে এল, এটা অনেক বড় ব্যাপার। আজকে (গতকাল) শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে গেছে। এরপরও কোথাও সিট ফাঁকা নেই। এটা একটা ইন্ডাস্ট্রির সাফল্য। “পরাণ”-এর পর মানুষ অনেক আশা নিয়ে আমার সিনেমা দেখতে গেছেন, আমি যে তাঁদের আশাটা আরও বড় করতে পেরেছি, এটা আমার জন্য বড় ব্যাপার। “পোড়ামন টু” থেকে ধরলে তিনটি ঈদে আমার ছবি মুক্তি পেল। হ্যাটট্রিক সাফল্য বলা যায়। প্রথমটির চেয়ে “পরাণ”-এর মান ভালো। আবার “সুড়ঙ্গ” আগেরটির চেয়েও অনেক উন্নত মানের। সব মিলিয়ে নিজেকে ছাড়িয়ে যাওয়ার মধ্যে একটা আনন্দ আছে। এখন নিজের ওপর বিশ্বাস তৈরি হয়েছে, যেকোনো ধরনের নিরীক্ষাধর্মী গল্প নিয়ে আমি সিনেমা বানাতে পারব।’
পরিচালক মনে করেন, গল্প, দর্শন, সেট, লুক মিলিয়ে ‘সুড়ঙ্গ’ এমন ধরনের সিনেমা, যেটা কেউ নাকচ করে দিতে পারবে না। ছবিটি নিয়ে আক্ষেপ নেই, এটাই তাঁর গর্বের জায়গা। ২১ জুলাই পশ্চিমবঙ্গে ছবিটি মুক্তি পাচ্ছে। সাফটা চুক্তির আওতায় নয়, শ্রী ভেঙ্কটেশ ফিল্মস আগ্রহী হয়ে বাংলাদেশি সিনেমাটি আমদানি করছে। এটাও পরিচালকের কাছে অনেক বড় ঘটনা।
বাণিজ্য আর শিল্পের মিশেল
প্রয়াত নির্মাতা তারেক মাসুদকে ওস্তাদ মানেন রায়হান রাফী। কিন্তু তাঁর নিজের সিনেমা ‘মাটির ময়না’র নির্মাতার ঘরানার না। পর্দায় রাফী চেষ্টা করেন বাণিজ্যিক আর শৈল্পিক ঘরানার মাঝামাঝি থাকা। নিজের সিনেমা-দর্শন সম্পর্কে রাফী বলেন, ‘আমার ইচ্ছা ছিল নিজেকে আগে প্রতিষ্ঠিত করব, এরপর ভিন্ন ভিন্ন ঘরানার সিনেমা বানাব। এখন যদি আমি একটা আর্ট ফিল্মও বানাই, সেটাও চলবে। কারণ, মানুষ আমাকে বিশ্বাস করা শুরু করেছে। এই আস্থাটা ধীরে ধীরে অর্জন করার চেষ্টা করেছি।’
রাফী চেষ্টা করেন বাস্তবেঘেঁষা সিনেমা নির্মাণ করতে। তাঁর প্রযোজককে যেন বিনিয়োগের অর্থ ফেরত দিতে পারেন, সেটাও মাথায় থাকে। ‘সুড়ঙ্গ’-এর সাফল্যের একটি ভিন্ন দিকের ওপরও আলো ফেললেন পরিচালক, ‘আমাকে এফডিসি বা এফডিসি ঘরানার বাইরের অনেকেই ফোন করে বলেছে, “তুমি আমাদের সাহস ফিরিয়ে দিয়েছ।” দেখুন, শাকিব খানের সিনেমা সুপারহিট হলে কিন্তু ইন্ডাস্ট্রি সাহস পায় না। কারণ, ওনার সিনেমা তো এমনিতেই হিট হয়। তাই একজন শরীফুল রাজ বা একজন আফরান নিশো বা সিয়ামের সিনেমা যখন হিট হয়, তখন সাধারণ প্রযোজকেরা সাহস পান।’
প্রসঙ্গ যখন নারী চরিত্র
‘রাফীর সিনেমায় নারী চরিত্র শক্তিশালী হয় কিন্তু তিনি নারী চরিত্র বারবারই নেতিবাচকভাবে উপস্থাপন করেন’—‘সুড়ঙ্গ’ দেখার পর এমন সমালোচনা করেছেন কোনো কোনো দর্শক। তিনি কি ‘নারীবিদ্বেষী’ পরিচালক?
এ প্রশ্নের উত্তরে নিজের ব্যাখ্যা দিলেন রাফী, ‘এটা আসলে দৃষ্টিভঙ্গির বিষয়। “পরাণ” বা “সুড়ঙ্গ”-এ কিন্তু খলনায়ক নারী না। খলনায়ক সমাজ অথবা অন্য কোনো চরিত্র (স্পয়লার হতে পারে, তাই চরিত্রের নাম প্রকাশ করতে চাননি পরিচালক)। অনেক নারীও কিন্তু “সুড়ঙ্গ” পছন্দ করেছেন। আমি কোনো লিঙ্গবিদ্বেষ নিয়ে সিনেমা বানাই না। আমার সব সিনেমা বিবেচনায় নিলেই সেটা বোঝা যাবে। এরপরও সামনে আরও সচেতন হব।’
অন্য রকম পুলিশের গল্প
রায়হান রাফীর সিনেমা পুলিশ চরিত্রগুলো বরাবরই আলোচিত হয়। আগে ‘পরাণ’-এ নাসির উদ্দিন খান, ‘সুড়ঙ্গ’-এ শহীদুজ্জামান সেলিমের অভিনয় পছন্দ করেছেন দর্শক। এটা নিয়ে পরিচালক বললেন, বাংলা সিনেমায় পুলিশ চরিত্রকে যেভাবে ‘টাইপড’ দেখানো হয়, সেটা ভাঙতে চান তিনি। পুলিশের পেশায় যাঁরা আছেন, তাঁরাও যে সাধারণ মানুষের মতো মজা করেন, হতাশ হন, কাজকে উপভোগ করেন, কখনো বিরক্ত হন—বাস্তবের এই প্রেক্ষাপটকে পর্দায় হাজির করেছেন তিনি। পুলিশ মানেই যে গুরুগম্ভীর হয়ে থাকবেন, এমন ধারণা বদলাতে চেয়েছেন।
‘সুড়ঙ্গ’-এর পর কী
ঈদে মুক্তি পাওয়া ‘সুড়ঙ্গ’-এর সাফল্যের খবর উপভোগ করছেন পরিচালক। এর মধ্যেই তাঁর কাছে জানতে চাওয়া হয় পরের সিনেমা নিয়ে। রাফী জানালেন, পরের ছবির প্রস্তুতি চলছে। শিগগিরই ঘোষণা আসবে। মুক্তি পাবে আগামী রোজার ঈদে।