তিনি বলতেন, পরী আমার পৃথিবী; তাঁকে হারিয়ে একা হয়ে গেলেন পরীমনি

নানা শামসুল হক গাজীর সঙ্গে চিত্রনায়িকা পরীমনি
ছবি : ফেসবুক

পরীমনির জীবনে অনেক ওঠা–নামা। তাঁর জীবন ঘিরেও রহস্যের শেষ নেই যেন। তাঁর হেন বিষয় নেই, যা নিয়ে মানুষের কৌতূহল নেই। অবশ্য তাঁকে নিয়ে মানুষের ভাবনা নিয়ে মোটেও চিন্তিত নন পরী। খেয়ালখুশিমতো চলাতেই যেন তাঁর আনন্দ। শুধু একটি জায়গায় পরীমনিকে থমকে যেতে দেখা যেত। শতবর্ষী সেই মানুষটিকে নিয়েই ছিল তাঁর যত উৎকণ্ঠা। নিজের কঠিনতম সমস্যায় যে বিন্দু পরিমাণ ভেঙে পড়তেন না, সেই পরীমনি শুধু এই মানুষটার হাসপাতালে ভর্তির খবরে ভেঙে পড়েছিলেন। কয়েক দফা হাসপাতালে যাওয়া–আসায় ঘাবড়ে যান। তিনি অবসরপ্রাপ্ত স্কুলশিক্ষক নানা শামসুল হক গাজী, বিনোদন অঙ্গনের সবাই যাঁকে পরীমনির নানা হিসেবেই চিনে থাকেন।

সব বন্ধন ছিন্ন করে গতকাল বৃহস্পতিবার দিবগাত রাত দুইটার পর চিরঘুমের দেশে পাড়ি জমিয়েছেন পরীমনির নানা শামসুল হক গাজী। নিঃস্বার্থভাবে ভালোবাসার মানুষটিকে হারিয়ে দিশাহারা, বিপর্যস্ত ঢালিউডের আলোচিত এই তারকা। কণ্ঠ তাঁর স্তব্ধ। কাঁদতে কাঁদতে মূর্ছা যাচ্ছেন। ১৫ মাস বয়সী সন্তান রাজ্যের কারণে নিজেকে সামলেও নিচ্ছেন। পরীমনি ভেতরে–ভেতরে বিপর্যস্ত হলেও তা বুঝতে দিতে চাইছেন না। যে মানুষটি তাঁকে নির্মোহ ও নিঃস্বার্থভাবে ভালোবাসা শিখিয়েছেন। পরিচয় করিয়েছেন মায়ার পৃথিবীর সঙ্গে, পরীমনির সেই পৃথিবী এখন অন্য পৃথিবীতে।

পরীমনির নানা শামসুল হক গাজী পিরোজপুরের মঠবাড়িয়ার মানুষ। স্কুলশিক্ষক এই মানুষটি এলাকার সবার কাছে সমাজসেবক হিসেবে পরিচিত। নিজের প্রতিষ্ঠা করা স্কুলে আজ শুক্রবার বাদ জুমা তাঁর জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। এই স্কুলের তিনি প্রধান শিক্ষক ছিলেন। বেশ কয়েক বছর আগে অবসর নিলেও স্কুলের যেকোনো প্রয়োজনে পরীমনির নানাকে ঠিকই পাওয়া যেত।

নানা শামসুল হক গাজীর সঙ্গে চিত্রনায়িকা পরীমনি

মঠবাড়িয়ার ভগীরথপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সেই মাঠে আজ শেষবারের মতো গিয়েছেন তিনি, তবে সবার কাঁধে চড়ে। সবাই তাঁকে ঘিরে নানা আলোচনায় মেতে থাকলেও তিনি ছিলেন নিথর। তাঁর স্ত্রী, অর্থাৎ পরীমনির নানি শেফালি হাওলাদার এক যুগ আগে মারা যান। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রয়াত প্রধান শিক্ষক নানির পাশেই সমাহিত করা হয়েছে নানাকেও। পরীমনি বিলাপ করতে করতে বলছিলেন, ‘এই পৃথিবীতে আমার তো আর কেউ রইল না। কী হবে আমার। কী লাভ এই জীবনের। আমার পৃথিবীটাই তো এখন অন্ধকার হয়ে গেল। এই নানা ছিলেন আমার আলো, যিনি অন্ধকারে আলোর পথ দেখিয়েছেন। নানা ছাড়া কীভাবে থাকব আমি!’

নানা শামসুল হক গাজীর সঙ্গে পরীমনি, এই ছবি এখন স্মৃতি

যাঁরা চিত্রনায়িকা পরীমনিকে চেনেন, তাঁরা এই নায়িকার শতবর্ষী নানা শামসুল হক গাজী সম্পর্কেও জানেন। এই নানাই ছিলেন তাঁর শক্তি, সাহস, চলার পথের অনুপ্রেরণা। যেকোনো বিপদ-আপদে নানাই ছিলেন তাঁর একমাত্র আস্থার জায়গা। সেই নানা বেশ কিছুদিন ধরে ঢাকার একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। এর আগে এ রকম পরিস্থিতিতে কিছুটা সুস্থ হলে বাসায় নিয়ে আসো হতো তাঁকে। কিন্তু এবার চিরদিনের জন্য পরীমনিকে ছেড়ে চলে গেলেন তাঁর নানা।

নানাকে হাসপাতালে ভর্তি করানোর পর থেকেই পরীমনি ভীষণ উদ্বিগ্ন ছিলেন। মাত্র তিন বছর বয়সে মা হারানোর পর পিরোজপুরে নানা শামসুল হক গাজীর কাছেই বেড়ে ওঠেন পরীমনি। নানার তত্ত্বাবধানে থেকেই তিনি এসএসসি ও এইচএসসি পাস করেছিলেন। মা-বাবার স্নেহ পরীমনি তাঁর নানার কাছেই পেয়েছেন।

নানা শামসুল হক গাজীর কোলে পরীমনির সন্তান রাজ্য, পাশে মা পরীমনি

সম্পর্কে নানা হলে তাঁকে বাবাও বলতেন পরীমনি। বিভিন্ন সময় আলাপে এমনটা বলেছিলেনও। ২০১৭ সালের ১৮ জুন বাবা দিবসে পরীমনি ফেসবুকে একটি পোস্ট দিয়েছিলেন। ওই পোস্টে তিনি লেখেন, শামসুল হক গাজী তাঁকে জন্ম দেননি, তবে তিনিই তাঁর বাবা। সেদিন পরীমনি এ–ও লিখেছিলেন, ‘আজ সত্যি যদি বলি, আমার বাবা হলেন আমার নানুভাই শামসুল হক গাজী। ওহ, একটা মজার বিষয় বলি, অনেকের আমার নাম নিয়ে কৌতূহল দেখেছি। আসল নাম, ডাকনাম, কে রেখেছে ইত্যাদি ইত্যাদি...আমার সার্টিফিকেট নাম শামসুন্নাহার স্মৃতি। শামসুন মানে সূর্যের আলো। নানুভাইয়ের নামের সঙ্গে মিল করে এই নাম।’

চলচ্চিত্রের শুটিং কিংবা অন্য কোথাও শামসুল হক গাজীকে সেভাবে দেখা যেত না বটে, তবে পারিবারিক যেকোনো আয়োজনে নানার হাত ধরেই পরীমনি আসতেন। বিভিন্ন সময়ে তাঁকে নিয়ে ঘুরে বেড়াতে যেতেও দেখা গেছে। নানাকে নিয়েই থাকতেন ঢাকার বাসায়। বিয়ের পরও তাঁকে নিজের কাছে রাখতেন। নানার যত্নআত্মির জন্য সার্বক্ষণিক লোক রেখেছিলেন নাতনি। এই নানাকে আদালতপাড়ায় দেখা গেছে, যেদিন তাঁকে কারাগার থেকে আদালতে হাজির করা হয়। সেদিনই প্রকাশ্যে নাতনি পরীমনিকে নিয়ে কথা বলেন নানা।

শামসুল হক গাজী বলেছিলেন, ‘আমার কাছে একদিকে পৃথিবী, আরেক দিকে পরী। ও-ই আমার পৃথিবী। আমার নাতনি যত উপার্জন করেছে, সবটাই ব্যয় করেছে জনহিতকর কাজে। প্রতিবছর এফডিসিতে দুস্থ শিল্পীদের জন্য কোরবানি দেয় পরীমনি। অনাথাশ্রমে জন্মদিন পালন করে। নিজের ঘরবাড়ি নেই। থাকে ভাড়া বাসায়। তারপরও মানুষের জন্যই শুধু তার মনটা কাঁদে।’

পরীমনি কষ্ট লুকিয়ে রাখা মানুষ। নিজের কষ্ট কাউকে সেভাবে বুঝতে দিতেন না। তবে নানা ঠিকই বুঝে ফেলতেন। ২০২১ সালে যখন মামলায় বিপর্যস্ত, আদালতে তোলা হলো তাঁকে, তখন নানার সঙ্গে কিছু সময়ের জন্য কথা হয়। নিজেকে নিয়ে কিছু না বলে উদ্বিগ্ন নানাকে নিয়ে বলেছিলেন, ‘নানুভাই, তুমি কোনো দুশ্চিন্তা কোরো না। ঠিকমতো খাওয়াদাওয়া করো।’

নানার মৃত্যুর পর আক্ষরিক অর্থেই একা হয়ে গেলেন পরী। স্বামী শরীফুল রাজের সঙ্গে তাঁর দূরত্ব, নানাও চলে গেলেন; রাজ্যকে নিয়ে পরীমনির লড়াইটা আরও কঠিন হয়ে গেল। তবে পরীকে যাঁরা চেনেন, তাঁরা জানেন, এমন পরিস্থিতিতে শোক সামলে আরও শক্তিশালী হয়ে ওঠেন তিনি।

নানা বুঝতে পেরেছিলেন, কষ্ট লুকিয়ে রাখার চেষ্টা নাতনির। তাই তো তিনি তখন বলেছিলেন, ‘কষ্ট হলেও নানার কাছে লুকাবে। কারণ, সে সব সময় নানার সুস্থতার কথা চিন্তা করে।’ কষ্ট লুকানোর সেই মানুষটি নেই। পরীমনিকে কষ্টের সাগরে ভাসিয়ে আজ তিনি চিরঘুমের দেশে পাড়ি জমিয়েছেন। চলে গেল পরীমনির শেষ আশ্রয়।

নানার মৃত্যুর পর আক্ষরিক অর্থেই একা হয়ে গেলেন পরী। স্বামী শরীফুল রাজের সঙ্গে তাঁর দূরত্ব, নানাও চলে গেলেন; রাজ্যকে নিয়ে পরীমনির লড়াইটা আরও কঠিন হয়ে গেল। তবে পরীকে যাঁরা চেনেন, তাঁরা জানেন, এমন পরিস্থিতিতে শোক সামলে আরও শক্তিশালী হয়ে ওঠেন তিনি।