জয়া আহসান। প্রতিনিয়তই নিজেকে ভাঙছেন আর নতুন করে গড়ছেন। তাঁর অভিনয়ে মুগ্ধ দুই বাংলার অগণিত ভক্ত-অনুরাগীরা। বয়সকে কোনো দিনই তোয়াক্কা করেননি জয়া। দর্শক-ভক্তদের মতে, তিনি এখনো সজীব-প্রাণবন্ত। তাঁর সময়ের অভিনেতা-অভিনেত্রীদের এখন অনেকে বিনোদনজগৎ থেকে হারিয়ে গেছেন, কিন্তু তিনি অনবদ্য। একজন অভিনেত্রীর জন্য এর চেয়ে বড় পাওয়া আর কী হতে পারে।
জয়া আহসানের জন্মদিন উপলক্ষে অভিনেত্রীর প্রশংসায় পঞ্চমুখ কলকাতার নির্মাতা ও অভিনেতা অরিন্দম শীলও। জয়াকে নিয়ে তাঁর উপলব্ধির কথা প্রকাশ করেছে ভারতীয় গণমাধ্যম আনন্দবাজার অনলাইন।
অরিন্দম শীল লিখেছেন, ‘সোমবার জয়ার জন্মদিন। অভিনেত্রী হিসেবে ও অনেকটা পথ পেরিয়ে এল। ভেবেই আমার ভালো লাগছে। অনেকেই জানেন, এপার বাংলায় জয়ার প্রথম ছবি (“আবর্ত”) আমার পরিচালনায়। তাই আজ ওর জন্মদিন উপলক্ষে লিখতে বসে অনেক পুরোনো কথা পরপর মনে পড়ছে।
‘অভিনেত্রী জয়া এপার বাংলার দর্শকদের কাছে এখন পরিচিত মুখ। কিন্তু আজকের এই লেখায় আমি ওকে কীভাবে খুঁজে পাই, সেই অজানা গল্প দিয়ে শুরু করতে চাই। আমি শুরু থেকেই তারকা নয়, চরিত্রের কথা ভেবে অভিনেতা নির্বাচনের চেষ্টা করি। সেইভাবেই “আবর্ত’” ছবিতে জয়াকে নির্বাচন করা। এপার বাংলায় তখন “চারু” চরিত্রের জন্য অভিনেত্রীর খোঁজ করছি।
অথচ চরিত্রটির জন্য একাকিত্ব, নিষ্পাপ, শান্ত একটা মুখ কোথাও খুঁজে পাচ্ছি না। তখন বাংলাদেশের আমার কয়েকজন বন্ধু আমাকে জয়ার কথা বলে। সেটি ২০১০ সাল। মনে আছে, আমার বাড়ির বারান্দায় দাঁড়িয়ে জয়াকে ফোন করেছিলাম। তখন মোবাইলে আইএসডি খুব খরচ সাপেক্ষ ছিল। জয়া আমাকে বলল, “দাদা, আমি ঢাকা থেকে অনেক দূরে শুটিং করছি। আপনাকে আমার কাজের কিছু নমুনা পাঠাচ্ছি। আপনি দেখে নিন। তারপর আমরা কথা বলব।” জয়ার সঙ্গে সেই ফোনাফোনির পর বেশ কিছু দিন কেটে গেল। তত দিনে আমি বাংলাদেশে ওর অভিনীত কিছু নাটক দেখে ফেলেছি। ছবিতে ওকে নেওয়ার জন্য আমার সিদ্ধান্ত তখন চূড়ান্ত।’
অরিন্দম শীল লিখেছেন, ‘জয়া আর আমি এরপর নিয়মিত ফোনে “সিন” পড়তাম। আলোচনা করতাম। ও ওর মতামত জানাত। ওই দুই বছরে আমাদের ফোনের আইএসডি খরচ যে কত হয়েছিল! সব হয়ে যাওয়ার পর ঢাকায় ওর সঙ্গে আমার প্রথম দেখা ও আলাপ। ঢাকারই এক প্রযোজক ও পরিচালকের অফিসে বসে জয়াকে ছবির গোটা চিত্রনাট্যটি পড়ে শুনিয়েছিলাম।’
শুধু তা-ই নয়, বাংলাদেশের একজন অভিনেত্রীকে ছবিতে নেওয়া নিয়েও সমালোচনা সহ্য করতে হয়েছিল অরিন্দম শীলকে। পরিচালকের ভাষ্য, ‘তখন ওটিটি ছিল না। কথায় কথায় দুই বাংলার শিল্পীরা একসঙ্গে কাজ করতেন না। সেখানে জয়া নতুন মুখ, কিন্তু আমি আমার “ইনস্টিংক্ট” থেকে কিছু বিষয় বুঝে এগিয়েছিলাম। পরে ছবি মুক্তির পর আমার সিদ্ধান্ত যে সঠিক ছিল, তা প্রমাণিত হয়েছিল।’
পরবর্তী সময়ে জয়াকে নিয়ে আরও কিছু বিতর্কের কথাও স্মরণ করেন অরিন্দম শীল লেখেন, ‘“ঈগলের চোখ” ছবিতে অনির্বাণের (অনির্বাণ ভট্টাচার্য) সঙ্গে ওর চুম্বনদৃশ্য! আমি দেখতাম, জয়া সেসব কিছুকে পাত্তা না দিয়ে অভিনয়ে মন দিতে পারে বারবার।’
এমনকি জয়া আহসানের বাবার মৃত্যুর পর তাঁর অভিনয় চালিয়ে যাওয়ার বিষয়টিও ভাবিয়ে তুলেছে এই পরিচালককে। পুরো ঘটনাটিই বলেছেন তিনি। অরিন্দম শীল লিখেছেন, ‘জয়া প্রসঙ্গে একটি ঘটনা না বললেই নয়। “আবর্ত” ছবির শেষ দিনের শুটিং। লোকেশনের ফ্ল্যাটটি আমার বন্ধু হর্ষ নেওটিয়ার। লাঞ্চ ব্রেকের পর কাজ শুরু হবে। হঠাৎ আমার একজন সহকারী এসে বললেন, “দাদা, জলদি আসুন। জয়াদি খুব কান্নাকাটি করছেন!” আমি ছুটে যেতেই দেখলাম, জয়ার দুচোখ বেয়ে জল পড়ছে। করুণ মুখে বলল, “দাদা, বাবা আর নেই!” আমি সঙ্গে সঙ্গে ওকে ঢাকায় ফিরে যেতে বললাম, কিন্তু জয়া আমাকে যা বলেছিল, আজও আমার স্পষ্ট মনে আছে। ও বলেছিল, “দাদা, আজ শুটিং শেষ করতে না পারলে তো অনেক ক্ষতি হয়ে যাবে। আমি সিনটা করি।” আমি ওর কথা শুনে হতবাক। কী বলব, বুঝতে পারছি না। কিছুক্ষণ চুপ থেকে আমি ওকে তা-ও কাজ করতে বারণ করেছিলাম। তৎক্ষণাৎ ওর ঢাকা ফেরার ব্যবস্থা করলাম। হর্ষকে জানাতেই ও বলল, “বাড়িটা রাখাই থাকবে।” সবকিছু মিটিয়ে জয়া কলকাতায় আসার পর আমরা ছবির শুটিং শেষ করেছিলাম। এই হচ্ছে জয়া আহসান।’
দীর্ঘ স্মৃতিচারণায় এই পরিচালক লেখেন, ‘“আবর্ত”-এর পর টালিপাড়ার প্রায় প্রত্যেক ভালো পরিচালকের সঙ্গে জয়া কাজ করেছে। চরিত্রের জন্য ও প্রচুর পরিশ্রম করতে পারে। আর অভিনয় করতে গিয়ে ওর একটা দৃষ্টিভঙ্গি আমাকে মুগ্ধ করে।
সেটি হলো, সব সময় প্রশ্ন করে। দাদা,“ অভিনয় করিনি তো? ‘বিহেভ’ করেছি তো?” জয়া হলো আক্ষরিক অর্থেই “ডিরেক্টরস অ্যাক্টর”। মন দিয়ে কাজ করে। কাজের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। শুটিং ফ্লোরে থাকলে তখন বাইরের পৃথিবীতে কী চলছে, সেটি ও ভুলে যায়। তখন অভিনয়, অভিনয় এবং অভিনয়ই ওর শেষ কথা!’
বাংলাদেশে এলেও জয়াকে পাশে চাই পরিচালকের। তিনি লিখেছেন, ‘বাংলাদেশে গেলে আমার শপিং গাইড জয়া। কোথায় ভালো শাড়ি ও পোশাক পাওয়া যায়, সেখানে জয়া আমাকে সঙ্গে করে নিয়ে যায়। ওর মায়ের হাতের রান্না অসাধারণ। ও জানে, আমি কী কী খেতে পছন্দ করি। তাই কলকাতায় এলে মায়ের হাতের লঙ্কার আচার ও ভুনা মাংস আমার জন্য নিয়ে আসে জয়া। সে স্বাদ ভোলা কঠিন। জয়ার সঙ্গে মাত্র দুটি কাজ করেছি। প্রায় ১২ বছর হয়ে গেল। আমি ওর সঙ্গে আবার কাজ করতে চাই। জয়াও আমার সঙ্গে আবার কাজ করতে ইচ্ছুক। কিন্তু পরিচালক হিসেবে যত দিন না কোনো শক্তিশালী মুখ্য চরিত্র ওর জন্য তৈরি করতে পারব, তত দিন আমিও অপেক্ষা করতে চাই।’
শেষের দিকে পরিচালক লিখেছেন, ‘জয়াকে নিয়ে আমি খুবই গর্বিত। অভিনেত্রী হিসেবে ও বারবার আমাদের চমকে দিয়েছে। আরও অনেকটা পথ ওকে অতিক্রম করত হবে। জন্মদিনে আমার কামনা, জয়া যেন ওর পারিবারিক জীবনে সুখে-শান্তিতে থাকে। ভবিষ্যতে যেন ও আরও ভালো কাজ করে, সেটাই চাই। ওর সঙ্গেও খুব দ্রুত একটা নতুন কাজ শুরু করার অপেক্ষায় রয়েছি।’