কারও কাছে এই পুরস্কার স্বপ্নপূরণের নাম। কেউ আবার পুরস্কারের ট্রফি কোথায় রাখবে, তা নিয়েই চিন্তিত। এক শিশুশিল্পী বুঝতেই পারছে না, জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারের অর্থ কী? জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার ২০২২-এ শ্রেষ্ঠ শিশুশিল্পী হিসেবে যৌথভাবে পুরস্কার পেয়েছে বৃষ্টি আক্তার ও মুনতাহা এমিলিয়া। এ ছাড়া শিশুশিল্পী শাখায় বিশেষ পুরস্কার পেয়েছে ফারজিনা আক্তার। তাদের গল্প জানাচ্ছেন মনজুরুল আলম
টেলিভিশন দেখার শুরু থেকে বাংলা সিনেমার ভক্ত বনে যায় বৃষ্টি আক্তার। সিনেমা দেখে ঘরে নাচ-গানের চর্চা চলত। একটা সময় মনে হয়, টেলিভিশনের অভিনেত্রীদের মতো সে–ও অভিনয় করবে। পরিবারের কাছে বায়না ধরে। কিন্তু বললেই তো আর অভিনেত্রী হওয়া যায় না। প্রস্তুতি হিসেবে মা-বাবা তাকে মোহাম্মদপুরের টোকাই নাট্যদলে ভর্তি করিয়ে দেন। চলে অভিনয়, নাচ, গান শেখা। পরে অভিনয়ের প্রস্তাব পায়। এভাবেই ষষ্ঠ শ্রেণির শিক্ষার্থী থাকতে সুযোগ মেলে ‘রোহিঙ্গা’ সিনেমায়। টেকনাফে শুটিং হয়। ওর অভিনয় সবাই পছন্দ করেন। অভিনয় অঙ্গনে তেমন কারও সঙ্গে পরিচয় না থাকায় পরে অভিনয়ের খুব একটা সুযোগ পায়নি।
শুটিং শেষে ডাবিংয়ের সময় পাশে থাকা সবাই একটি কথাই বলে, ‘তুমি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পাবে।’ একসময় বৃষ্টিও স্বপ্ন দেখে। পুরস্কার ঘোষণার পর নিজের নাম দেখে কিছু সময় চুপচাপ বসে থাকে। পরে মা-বাবাকে জানায়। শুনেই তাঁরা কাঁদতে থাকেন। কাঁদে বৃষ্টিও। সে বলল, ‘আমি এত খুশি হয়েছি যে বলে বোঝাতে পারব না। জীবনের বড় স্বপ্ন ছিল। এখন আরও ভালো কাজ করব। আমার একমাত্র ইচ্ছা অভিনেত্রী হওয়া।’ বৃষ্টি এখন নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী। মাঝে অভিনয়ে অনিয়মিত ছিল। জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার তার জন্য প্রেরণা। এখন পড়াশোনার পাশাপাশি অভিনয় করতে চায়। এর আগে বৃষ্টি ‘কুড়া পক্ষীর শূন্যে উড়া’, ‘অভাগীর মা’ সিনেমায় অভিনয় করেছে।
‘জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার কী’
জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পাওয়ার খবর খালাদের কাছ শুনেছে খুদে মুনতাহা এমিলিয়া। সাত বছর বয়সী এই শিশুশিল্পী ‘বীরত্ব’ সিনেমায় অভিনয় করে পুরস্কার পেয়েছে।
প্রজ্ঞাপন জারি হলে একের পর এক তাকে শুভকামনা জানাতে থাকেন পরিচিতিজনেরা। কেউ বলেছেন, ‘অভিনন্দন, তোমার জন্য শুভকামনা, মামণি।’ সবাইকে হাসিমুখে ধন্যবাদ জানায় মুনতাহা। এরপর কৌতূহলী হয়ে মা–বাবার কাছে জানতে চায়, ‘আচ্ছা, জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার কী?’ মেয়ের মুখে এই প্রশ্নে শুনে মা-বাবা বোঝাতে থাকেন, এটা অনেক সম্মানজনক একটি পুরস্কার, ভালো অভিনয়ের জন্য দেওয়া হয়। পরে মুনতাহা জানতে চায়, ‘জাতীয় ফুলের মতো?’ তখন বোঝানো হয়, জাতীয় ফুল, ফল, মাছ, পাখি যেমন খুবই গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি জাতীয় পুরস্কারও গুরুত্বপূর্ণ। এভাবে একসময় ছোট মুনতাহা বুঝে যায়, জাতীয় পুরস্কার অর্থ অনেক বড় কিছু।
মা-বাবার কাছে বায়না ছিল, পরির মতো সেজে অনুষ্ঠানে যাবে। সেভাবেই অংশ নিয়েছে। মুনতাহা বলে, ‘আমি খুবই খুশি। আমার বন্ধুরাও অনেক খুশি হয়েছে। ভবিষ্যতে ভালো অভিনয় করতে চাই।’ তার মা-বাবা অভিনয় করেন। বাবা আরমান সিদ্দিকীর একটি প্রযোজনা সংস্থাও আছে। সে বিভিন্ন সময় মা-বাবার সঙ্গে শুটিংয়ে যেত। এভাবেই তাকে পরিচালকেরা অভিনয়ের জন্য পছন্দ করেন। ২০২১ সালে ‘ভুল এই শহরের মধ্যবিত্তদেরই’ ছিল নাটক দিয়ে আলোচনায় আসে।
‘পুরস্কারের টাকা দিয়ে ঘর তুলব’
‘কুড়া পক্ষীর শূন্যে উড়া’ সিনেমার জন্য শিশুশিল্পী শাখায় বিশেষ পুরস্কার পেয়েছে ফারজিনা আক্তার। এখন তার বয়স আট বছর। শুটিংয়ের সময় ছিল চার বছর। সেই কথা তেমন একটা মনে নেই। শুধু জানিয়েছে, যেভাবে তাকে বলে দেওয়া হতো, সেভাবেই সে অভিনয় করত। অনেক সময় ভয় ও লজ্জা লাগত। পুরস্কার পাচ্ছে শুনে কেমন লাগছে জানতে চাইলে শুধু বলল, ‘ভালো। সবাই আমাকে অনেক আদর করতেছে। পুরস্কার নেব, টাকা পাব। আমরা এই টাকা দিয়ে একটা ঘর তুলব। আমাদের থাকার জায়গা নেই।’ ফারজিনাদের বাড়ি সুনামগঞ্জের তাহিরপুরের টাঙ্গুয়ার হাওর এলাকায়। সেখানে শুটিং লোকেশন দেখতে যান পরিচালক মুহাম্মদ আব্দুল কাইউম। একটা বাড়ি শুটিংয়ের জন্য পছন্দ করেন, যেটি ফারজিনাদের। তখন ছোট এই মেয়েকে খেলতে দেখে পরিচালক তাকে শিশু চরিত্রের জন্য পছন্দ করেন। শুরুতে সে রাজি না হলেও পরে সবাইকে অভিনয় দিয়ে চমকে দেয়। তবে শুটিংয়ের সময় অনেক মানুষ থাকায় প্রথম দিকে সে অভিনয় করতে চাইত না। কিন্তু যা বুঝিয়ে দিত, তা–ই করত। ফারজিনার বাবা মোহাম্মদ সায়েম মূলত কৃষক।