জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠানের আলোঝলমলে সন্ধ্যা। মে ২০১৪। প্রধানমন্ত্রীর হাত থেকে আজীবন সম্মাননা গ্রহণ করলেন খলিলউল্ল্যাহ খান, বাংলা চলচ্চিত্রে যিনি খলিল নামে অতিপরিচিত। তাঁর শরীর ছিল সেদিন অসুস্থ। তবু পুরোনো বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে সাক্ষাৎ আর ফেলে আসা জীবনের স্মৃতিচারণায় তৃপ্তি ও ভালো লাগার অনুভূতিতে মনটা ভরে উঠছিল তাঁর। অনুষ্ঠান যখন প্রায় শেষ, সবার বিদায় নেওয়ার পালা, তখনই এল একটি দুঃসংবাদ! হৃদ্রোগে আক্রান্ত হয়ে কিছুক্ষণ আগে মারা গেছেন তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র তারেক।
‘মৃত্যু ট্র্যাজেডি নয়, জীবদ্দশায় মৃত্যুর উপলব্ধিই ট্র্যাজেডি’—এ কথাই যেন বারবার সত্য হয়েছে খলিলউল্ল্যাহ খানের জীবনে। ২০১৪ সালের সেই সন্ধ্যার ২০ বছর আগে ১৯৯৪ সালের মে মাসেই তিনি ছোট ছেলে হাবিবকে কবরে শায়িত করেছিলেন। পিতার হাতে সন্তানের মরদেহই তো পৃথিবীতে সবচেয়ে ভারী। অভিনয়সাধনার জন্য যে সন্ধ্যায় তাঁর আজীবন সম্মাননাপ্রাপ্তি, সেই সন্ধ্যায়ই চলে গেলেন তাঁর বড় ছেলে।
৭ ডিসেম্বর খলিলউল্ল্যাহ খানের নবম মৃত্যুবার্ষিকীতে তাঁকে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছি। পরিবারের ভেতরে ও বাইরে থেকে তাঁকে নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণের সুযোগ এবং শেষ জীবনে অসুস্থতার দিনগুলোয় তাঁর সঙ্গে সময়ে সময়ে দীর্ঘ আলাপচারিতার সুযোগ আমার হয়েছিল। তারই ভিত্তিতে এই ব্যক্তিগত শ্রদ্ধাঞ্জলি রচনার দুঃসাহস।
স্বাধীনতার আগে নায়ক ও স্বাধীনতা-উত্তর সময়ে খলনায়ক বা গুরুত্বপূর্ণ পার্শ্বচরিত্র—সব ক্ষেত্রেই সমান পারঙ্গমতার স্বাক্ষর রেখেছিলেন খলিলউল্ল্যাহ খান। চরিত্রকে আত্মস্থ করে সহজাত অভিনয় দিয়ে দর্শকের মনে ছাপ ফেলতে তাঁর জুড়ি ছিল না। ‘মিয়ার ব্যাটা’ বললে পুরোনো দর্শকদের মনে আজও ভেসে ওঠে ‘সংশপ্তক’ নাটকের একটি চরিত্রে তাঁর রাশভারী চেহারা ও কণ্ঠ। ‘টাকা আমার চাই, নইলে জমি’—তাঁর এ সংলাপ একসময় মানুষের মুখে মুখে ফিরেছে। সারা বাংলাদেশের দর্শকদের কাছে খলিল আর ছোট পর্দার ‘মিয়ার ব্যাটা’ সমার্থক হয়ে গিয়েছিল পরিচালক আবদুল্লাহ আল মামুনের পরিচালনার মুনশিয়ানায়। শহীদুল্লা কায়সারের অমর উপন্যাস ‘সংশপ্তক’-এর নাট্যরূপ ইতিহাস সৃষ্টি করেছিল চলচ্চিত্রের খলিলসহ আরও বাঘা বাঘা নাট্যশিল্পীর যূথবদ্ধ প্রয়াসে।
স্বাধীনতার আগে নায়ক ও স্বাধীনতা-উত্তর সময়ে খলনায়ক বা গুরুত্বপূর্ণ পার্শ্বচরিত্র—সব ক্ষেত্রেই সমান পারঙ্গমতার স্বাক্ষর রেখেছিলেন খলিলউল্ল্যাহ খান। চরিত্রকে আত্মস্থ করে সহজাত অভিনয় দিয়ে দর্শকের মনে ছাপ ফেলতে তাঁর জুড়ি ছিল না।
একসময়ের পোশাকি ছবির জোয়ারের সময় ‘মিন্টু আমার নাম’, ‘বারুদ’, ‘গুন্ডা’য় (এই ছবিতে পার্শ্বচরিত্রে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারপ্রাপ্ত) খলনায়ক চরিত্রে; চলচ্চিত্রের নায়িকাদের তথাকথিত সম্পদশালী বাবা ‘চৌধুরী সাহেব’ ধরনের চরিত্রে, আবার ঋত্বিক ঘটকের অমর চলচ্চিত্র ‘তিতাস একটি নদীর নাম’-এ মালো যুবক বা নারায়ণ ঘোষ মিতার ‘আলোর মিছিল’-এ আলীমের মতো চরিত্রে তিনি ঢুকে যেতেন অনায়াসে। ‘আলোর মিছিল’ ছবিতে গল্পের শেষে এসে পরিবারের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য বিপথে চলে যাওয়া চরিত্রটি কিংবা আরও আগে জহির রায়হানের পরিচালনা ও খান আতাউর রহমানের সংগীত পরিচালনায় ‘সংগম’ কিংবা সাদেক খানের পরিচালনা ও আলতাফ মাহমুদের সংগীত পরিচালনায় ‘ক্যায়সে কাহুঁ’—এই দুটি উর্দু ছবির নায়ক হিসেবে তাঁর অনবদ্য অভিনয় সুধীমহলে প্রশংসিত হয়েছিল।
মানুষ হিসেবে খলিলউল্ল্যাহ খান ছিলেন অন্য সবার মতো ‘ভালো-মন্দ মিলায়ে সকলই’। সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু তাঁর জীবনযাপন, আচার-আচরণ ও বিশ্বাসে দীর্ঘ সময়ের পরম্পরায় কিছু দিক ভাস্বর হয়ে উঠেছে। সেগুলোর সারসংক্ষেপ করলে খলিলউল্ল্যাহ খানকে মোটা দাগে তাঁরই অভিনীত ছবির ‘ফকির মজনু শাহ’-এর প্রধান চরিত্রের সঙ্গে তুলনা করা যায়। ঘটনাচক্রে ছবিটির নামভূমিকায় তিনিই অভিনয় করেছিলেন। খলিলউল্ল্যাহ খান ছিলেন চলচ্চিত্রের সাধক বা ‘ফকির’, চলচ্চিত্রের প্রেমে পাগল বা ‘মজনু’; আবার চিন্তাচেতনা ও ব্যবহার-চলাফেরায় ছিলেন রাজা বা ‘শাহ’।
তিনিই ফকির, যিনি বৃহত্তর কোনো সাধনার ব্রতে পার্থিব সম্পদের বাসনা থেকে নিজেকে মুক্ত রেখেছেন। খলিল অভিনয়কেই সাধনা হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। ব্যক্তিজীবনে আনসার ও ভিডিপির পদস্থ কর্মকর্তা ছিলেন। বাহিনীটির অ্যাডজুট্যান্ট হিসেবে বিভিন্ন সময়ে কিছু কৌশলগত এলাকার দায়িত্বে ছিলেন। সুনাম ও সততার সঙ্গে দায়িত্ব পালনের কারণে শফিপুরে আনসারের কেন্দ্রীয় কার্যালয় থেকে তাঁর কর্ম-এলাকার লোকজন আজও শ্রদ্ধার সঙ্গে তাঁকে মনে রেখেছেন। কাজের বাইরের পুরো সময়টুকু তিনি অভিনয়ের সাধনায় নিবেদন করেছিলেন। মৃত্যুকালে কোনো স্থাবর সম্পত্তি রেখে যাননি। স্বাধীনতার পর থেকে মোহাম্মদপুরের যে বাড়িতে তিনি ছিলেন, আমৃত্যু সেখানেই বসবাস করে গেছেন চলচ্চিত্রের এই সাধক বা ‘ফকির’।
আরবি থেকে আসা ‘মজনু’ শব্দটির অর্থ দিওয়ানা, বিশেষ করে আত্মভোলা প্রেমিক-প্রবরকে মজনু বলে অভিহিত করা হয়। হ্যাঁ, অভিনয়ের প্রেমে খলিলউল্ল্যাহ খান ছিলেন খাঁটি মজনু। চলচ্চিত্রের ভালোবাসায় তিনি জড়িয়ে ছিলেন আকণ্ঠ।
এলাকার লোকজন আজও শ্রদ্ধার সঙ্গে তাঁকে মনে রেখেছেন। কাজের বাইরের পুরো সময়টুকু তিনি অভিনয়ের সাধনায় নিবেদন করেছিলেন। মৃত্যুকালে কোনো স্থাবর সম্পত্তি রেখে যাননি
বাড়িতে চিত্রনাট্য নিয়ে এসে নিজের কক্ষের দরজা লাগিয়ে বসে পড়াশোনা করে নিজের সঙ্গে ক্রমাগত মহড়া দিতেন, ভোর হতেই হাতে আগের রাতে পাওয়া চিত্রনাট্য নিয়ে বারান্দায় পায়চারি করতে এবং সংলাপ আওড়াতে দেখেছি। পরিচালক ও সহ-অভিনেতাদের সঙ্গে দীর্ঘ আলাপ করেছেন দৃশ্য বা গল্পের পটভূমি ঠিকভাবে চিত্রায়ণের জন্য। অনেক সময়ই বাসা থেকে পোশাক পরে যেতেন শুটিংয়ে। গৃহপরিচারক থেকে এলাকার লন্ড্রি দোকানের মালিকসহ সবার জানা ছিল, বিশেষ করে যখন তাঁকে স্যুট পরতে হতো, তখন তিনি সবকিছু সুচারুভাবে প্রস্তুত করে রাখতে পছন্দ করতেন।
শুনেছি, হুমায়ূন আহমেদের একটি ঈদের কমেডি নাটকের জন্য পুরোনো স্পঞ্জের স্যান্ডেল দরকার ছিল। বাড়ির সবাইকে সেটি বারবার ব্যবহার করে পুরোনো করতে বলেছিলেন খলিলউল্ল্যাহ খান। যেদিন দরকার, সেই সন্ধ্যায় শুটিংয়ে যাওয়ার আগে সেটি আর পাওয়া যাচ্ছিল না। পুরোনো স্যান্ডেল মনে করে কাজের লোক সেটা বাইরে নিয়ে ফেলে দিয়েছে। সারা বাড়ি মাথায় করে সেই স্যান্ডেল খোঁজা হচ্ছে, এটা হলো খলিলউল্ল্যাহ খানের ঈদের কমেডি নাটকে অভিনয়ের আগমুহূর্তের মেজাজ সপ্তমে চড়ার একটি কৌতুকময় পারিবারিক গল্প; অভিনয়কে সামগ্রিকভাবে নেওয়ার ব্যাপারে তাঁর পাগলামির ছোট্ট উদাহরণ। বলা বাহুল্য, সেই ঈদের নাটক খুবই হাস্যরসাত্মক হয়েছিল। নাটকেও ছিল বাসার বাচ্চাদের ওই স্যান্ডল জোড়া চুরি করে নিয়ে যাওয়ার দৃশ্য।
চলচ্চিত্রের জন্য নিবেদিতপ্রাণ খলিলউল্ল্যাহ খান একসময় শিল্পী সমিতির সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন। কীভাবে চলচ্চিত্রশিল্পীদের কল্যাণ হবে এবং প্রাপ্য সম্মান ও নিজস্ব অধিকার নিশ্চিত করা যাবে, সমিতির সদস্য হিসেবে সেটাই ছিল তাঁর প্রধান লক্ষ্য।
চলচ্চিত্রের জন্য নিবেদিতপ্রাণ খলিলউল্ল্যাহ খান একসময় শিল্পী সমিতির সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন। কীভাবে চলচ্চিত্রশিল্পীদের কল্যাণ হবে এবং প্রাপ্য সম্মান ও নিজস্ব অধিকার নিশ্চিত করা যাবে, সমিতির সদস্য হিসেবে সেটাই ছিল তাঁর প্রধান লক্ষ্য।
সমিতির ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করতে তিনি আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন। এফডিসিতে শিল্পী সমিতির বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি, বন্যার্তদের সাহায্য করা—সবই তিনি করেছেন অভিনয় ও বাংলা চলচ্চিত্রের প্রতি তাঁর মজনুসম নিবিড় ভালোবাসা থেকে।
ফারসি ‘শাহ’ শব্দটির অর্থ রাজা বা বাদশাহ। খলিলউল্ল্যাহ খান ছিলেন তাঁর নিজের রাজত্বে রাজা। ছিলেন এক বিশাল বাদশাহি হৃদয়ের অধিকারী। সবাইকে সম্মান করতে জানতেন এবং সম্মান দিতেন। সংবেদনশীল মানুষ হিসেবে অনেকের কাছে তিনি ছিলেন অভিভাবকসম। ভালোবাসতেন সাধারণ মানুষকে। দেখেছি, অবসরের পরও আনসারের সদস্যরা মন থেকে ভালোবেসে প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে তাঁর বাসায় ছুটে এসেছেন। বিমানবন্দর বা রেলস্টেশনে যেখানেই গিয়েছেন, বিশেষ করে আনসারের সদস্যরা ছুটে আসতেন তাঁর কাছে। তিনি তারকা-অভিনেতা ছিলেন বলে নয়, বরং সহজেই মানুষকে আপন করে নিতে পারতেন বলে।
একবার চলচ্চিত্র অভিনেতা রহমান দুর্ঘটনায় আহত হলে রক্তের প্রয়োজন দেখা দিল। খলিলউল্ল্যাহ খান এগিয়ে গেলেন সবার আগে। এ জন্য রহমান তাঁকে বলতেন, ‘মাই ব্লাড ব্রাদার’। প্রয়োজনে সর্বোত্তমটা দেওয়ার ব্যাপারে তাঁকে কখনো পিছিয়ে যেতে দেখিনি।
সম্পূর্ণ নিজের প্রচেষ্টায় খলিলউল্ল্যাহ খান নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। সে কারণেই সম্ভবত তিনি ছিলেন অত্যন্ত প্রখর আত্মসম্মানবোধসম্পন্ন মানুষ। কোনো কাজে কারও কাছে ধরনা দেওয়া একেবারেই তাঁর স্বভাবে ছিল না। চলাফেরায়-চালচলনে ছিলেন অত্যন্ত কেতাদুরস্ত। ছিলেন বন্ধুবৎসল। আড্ডা দিতেন মন খুলে। গল্পগুজব আর দীর্ঘ আড্ডার ব্যাপারে সহকর্মীদের কাছে তাঁর সুনাম ছিল। ভালোবাসতেন খাওয়াতে ও খেতে। খাওয়াদাওয়ায় ছিলেন খুব শৌখিন। বিরিয়ানি, কাবাব, মিষ্টি খেতে ভালোবাসতেন। যেকোনো অজুহাতে বা হঠাৎ খেয়াল চাপলেই সবাইকে নিয়ে করতেন খাওয়াদাওয়ার আয়োজন।
পাড়া-প্রতিবেশী, আনসারের সহকর্মী, আত্মীয়স্বজন—সবাইকে জড়ো করতেন মাঝেমধ্যেই। এত অনুষ্ঠানের কারণে তাঁর বাসায়ই থাকত বড় বড় শামিয়ানা। অনুষ্ঠান হলে প্রথমেই সকালবেলায় ছাদে সেই শামিয়ানা টানানো হতো। বোঝা যেত, আজ এখানে জমজমাট অনুষ্ঠান হবে।
চলচ্চিত্র-পরিবারের কথা তো বলার অপেক্ষাই রাখে না। নানা মতানুসারে, খলিলউল্ল্যাহ খান প্রায় ৮০০ ছবিতে কাজ করেছেন। বাংলা চলচ্চিত্রের প্রথিতযশা সবার সঙ্গেই আন্তরিকভাবে কাজ করেছেন। রহমান, শবনম, রাজ্জাক, ববিতা, আলমগীর—তাঁদের সঙ্গে ছিল বিশেষ ব্যক্তিগত সম্পর্ক। তিনি যখন অসুস্থ, তাঁকে ফিরে আসার প্রার্থনা জানিয়ে সম্ভবত ২০১১ সালে পত্রিকায় খোলা চিঠি লিখেছিলেন অভিনেতা হুমায়ুন ফরীদি। পারস্পরিক ভালোবাসা আর অভিনয়জগতের মেলবন্ধনের কী যে অপূর্ব অভিব্যক্তি ছিল সেই চিঠিতে! সেবার ঠিকই অসুস্থতা থেকে ফিরে এসেছিলেন খলিলউল্ল্যাহ খান। ২০১৪ সালের ৭ ডিসেম্বর তিনি চলে গেলেন চিরতরে।
অভিনয় ও চলচ্চিত্রের ‘ফকির’, ‘মজনু’, ‘শাহ’ খলিলউল্ল্যাহ খান, আপনাকে অসীম মমতা, ভালোবাসা ও শ্রদ্ধায় আমরা স্মরণ করি। আপনি নেই, পরিবারে আমরা সবাই এক গভীর শূন্যতায় নিমজ্জিত। আমাদের মনে সব সময় অনুরণিত হয়, ‘মৃত্যু ট্র্যাজেডি নয়, জীবদ্দশায় মৃত্যুর উপলব্ধিই ট্র্যাজেডি।’
মাহবুব উর রহমান: এইচএসবিসি ব্যাংকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা এবং খলিলউল্ল্যাহ খানের জামাতা