জরির পেটে খিদে, ভাত খাবে। বারবার মায়ের কাছে ভাত চাইছে। আঁচলে মুখ ঢেকে আছেন মা। ঘরে চাল বাড়ন্ত, কী করবেন, জরিকে ভাত দেবেন কী করে? খিদের যন্ত্রণা সহ্য করতে পারছে না জরি। মাকে বারবার বলে চলেছে, ‘মা, ভাত দে, ভাত দে মা’। বিরক্ত হয়ে মা জরিকে ঠেলা দিয়ে কাছ থেকে দূরে সরিয়ে দেন। জরি পড়ে গিয়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। কান্নায় বুক ভেঙে যায় মায়ের। মা গগনবিদারী কণ্ঠে কাঁদতে শুরু করেন। তারপরই ছুটে যান পাশের বাড়িতে। ‘ভাত নেবেন’, কিন্তু চাইলে কি দেবে? ইত্যাদি ভেবে কাউকে না বলে রান্নাঘরের হাঁড়ি থেকে ভাত নেন। তখনই বাড়ির গৃহকর্ত্রী চলে আসেন। ভাত চুরির অপরাধে জরির মায়ের গায়ে হাত তোলেন। চিৎকার করে আশপাশের বাড়ি থেকে লোকজন জড়ো করেন। সবার সামনে জরির মা বলেন, ‘আপনেরা আমারে মারেন কাটেন, বিচার–আচার যায় করেন, আমি স্বীকার করতেছি আমি চুরি করছি। চারডে ভাতের লাইগা আমার মায়াডা মরে যায়তেছে। এই ভাত চারডা আপনেরা আমারে দেন। আমার মায়াডারে বাঁচাই।’
‘ভাত দে’ সিনেমার শুরুর এ দৃশ্য চোখে জল আনে। একজন নারীর জীবনসংগ্রামের গল্পে নির্মিত এই সিনেমা ১৯৮৪ সালে মুক্তি পায়। দর্শকপ্রিয়তা অর্জনের পাশাপাশি ৯টি ক্যাটাগরিতে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পায় ছবিটি।
জীবনঘনিষ্ঠ সামাজিক কাহিনির প্রেক্ষাপটে নির্মিত এ সিনেমায় বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করেছেন শাবানা, আলমগীর, রাজীব, আনোয়ার হোসেন, আনোয়ারা, আঁখি আলমগীর, জাহানারা ভূঁইয়া, টেলি সামাদ, আখতার হোসেন প্রমুখ। কালজয়ী সিনেমাটি মুক্তির চার দশক পূর্ণ করছে এ বছর। ছবিটির নির্মাতা আমজাদ হোসেন। সিনেমার কাহিনি, সংলাপ, চিত্রনাট্যও তাঁর।
হঠাৎ করে সিনেমা থেকে স্মৃতিচারণার কারণও কিন্তু তিনি। আজ কিংবদন্তি এই পরিচালকের প্রয়াণদিবস। ২০১৮ সালের ১৪ ডিসেম্বর ৭৬ বছর বয়সে ব্যাংককে চিকিৎসাধীন অবস্থায় না–ফেরার দেশে পাড়ি দেন তিনি।
১৯৪২ সালের ১৪ আগস্ট জামালপুরে আমজাদ হোসেনের জন্ম। নানা পরিচয় তাঁর। একাধারে চলচ্চিত্রকার, কাহিনিকার, সংলাপ রচয়িতা, চিত্রনাট্যকারের পাশাপাশি অভিনেতা, লেখক, সুবক্তাসহ আরও অনেক কিছু।
অনেকের মতো সৃষ্টির জগতে তাঁর পদার্পণের শুরুটাও ছড়া–কবিতা দিয়ে। ছোটবেলা থেকেই গল্প, কবিতার প্রতি ভালো লাগা ছিল। সাহিত্য ভালোবাসতেন। চর্চাও শুরু করেছিলেন একেবারে ছোট বয়সেই। তৃতীয় শ্রেণিতে থাকতেই ‘আজাদ’ পত্রিকার শিশুদের পাতায় তাঁর ছড়া ছাপা হয়েছিল। স্কুল পাস দিয়ে কলেজে ভর্তি হয়েছেন সবে। চারদিকে ‘দেশ’ পত্রিকার জয়জয়কার। বড় ইচ্ছা ‘দেশ’ পত্রিকায় লেখা ছাপা হবে। কী আর করা? ইচ্ছা পূরণ করতে কাউকে না জানিয়ে কবিতা লিখে ‘দেশ’ পত্রিকায় পাঠিয়ে দেন। কবিতা প্রকাশের আগেই ‘দেশ’ পত্রিকার সম্পাদকের তরফ থেকে চিঠি পেয়েছিলেন কলেজ পড়ুয়া আমজাদ হোসেন।
ঢাকায় পাড়ি জমান পঞ্চাশের দশকে। যুক্ত হন সাহিত্যচর্চা ও নাট্যচর্চার সঙ্গে। ‘তোমার আমার’ চলচ্চিত্রে কাজ করার মধ্য দিয়ে প্রথম ক্যামেরার সামনে দাঁড়ান। সহকারী পরিচালক হিসেবে কাজ করেছেন জহির রায়হানের সঙ্গে।
শুধু কি তাই? স্বাধীনতা আন্দোলনে যে সিনেমা গণজোয়ার এনেছিল, সেই ‘জীবন থেকে নেয়া’র কাহিনিকার, সংলাপ রচয়িতাও তিনি। সিনেমাটিতে ‘মধু’ চরিত্রে অভিনয়ও করেছিলেন। জহির রায়হানের ‘বেহুলা’ ও ‘আনোয়ারা’ সিনেমা দুটির সংলাপও তাঁর লেখা। সংলাপ রচনার পাশাপাশি সিনেমা দুটিতে অভিনয়ও করেছেন। গ্রামবাংলার ভালোবাসার ছবি হিসেবে পরিচিত, ‘সুজন সখী’র সংলাপ রচনাও তাঁর। নিজের লেখা ‘ধারাপাত’ নাটকে নায়ক হিসেবে অভিনয়ও করেছেন আমজাদ হোসেন। পরে এ নাটক থেকে একই নামে সিনেমা বানিয়েছিলেন সালাউদ্দিন।
তখনকার দিনের ঈদ বিনোদনের অন্যতম অনুষঙ্গ জনপ্রিয় টিভি সিরিজ ‘জব্বর আলী’র নামভূমিকায়ও তিনি অভিনয় করেছেন।
পরিচালক হিসেবে আমজাদ হোসেনের প্রথম নির্মাণ ‘জুলেখা’। তাঁর শ্রেষ্ঠ নির্মাণের একটি ‘গোলাপী এখন ট্রেনে’। ১৯৭৮ সালে নিজের লেখা ‘ধ্রুপদী এখন ট্রেনে’ উপন্যাস অবলম্বনে সিনেমাটি বানিয়েছিলেন তিনি। ববিতা, ফারুক, আনোয়ারা, রওশন জামিল, আনোয়ার হোসেন, আব্দুল্লাহ আল–মামুন, তারানা হালিম, রোজী আফসারী, এ টি এম শামসুজ্জামান অভিনীত ছবিটি দারুণ ব্যবসাসফল হয়। সঙ্গে কালজয়ী ছবি হিসেবেও স্থান করে নেয় চলচ্চিত্রের ইতিহাসে। ‘গোলাপী এখন ট্রেনে’ ১১টি শাখায় পুরস্কার পেয়ে ভীষণ আলোচিত হয়, পরিচালক নিজেই পাঁচটি পুরস্কার পেয়ে চমকে দেন।
আমজাদ হোসেনের সিনেমায় প্রাণ পেয়েছে রূপসী বাংলা। জীবন্ত হয়ে উঠেছে মাটি ও মানুষের যাপিত জীবনের কথকতা। তাঁর দেখার ভঙ্গিটা ছিল আলাদা, ছবিগুলোতেও তাঁর এই ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গির ছাপ স্পষ্ট। তাঁর অনেক ছবিতে লোকজ সংগীতকে ভেঙে আধুনিক করা হয়েছে, যা অনেক বড় কাজ বলে মনে করেন অনেকে। তিনি দেশজ গানগুলোকে আধুনিকায়ন করে জনপ্রিয় করে তুলেছিলেন, যেগুলো আজও গাওয়া হয়। তাঁর লেখা গানেও মেতেছেন শ্রোতারা। গীতিকার হিসেবেও ভীষণ সফল তিনি। ‘গোলাপী এখন ট্রেনে’ ও ‘ভাত দে’ চলচ্চিত্রের জন্য শ্রেষ্ঠ পরিচালক হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পাওয়ার পাশাপাশি শিল্পকলায় অবদানের জন্য একুশে পদক ও বাংলা একাডেমি পুরস্কারসহ অসংখ্য পদক ও পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন কিংবদন্তি এই নির্মাতা।