এমন দর্শক আগে দেখা যায়নি স্টার সিনেপ্লেক্সে। সচরাচর যাঁরা সিনেমা দেখতে আসেন না, তাঁরা এসেছেন দল বেঁধে। উৎসাহ–উদ্দীপনা নিয়ে সিনেমা দেখলেন। আনন্দ উল্লাসে মেতে ছিলেন সারাক্ষণ।
টঙ্গীতে বেড়ে ওঠা তরুণ চলচ্চিত্র পরিচালক যুবরাজ শামীম একটু ফুরসত পেলেই টঙ্গী থেকে ট্রেনে চেপে নারায়ণগঞ্জে চলে যেতেন, সিনেমা নিয়ে আড্ডা দিতেন। আসা-যাওয়ার পথে নানা রকমের মানুষের সঙ্গে আলাপ হতো। এর মধ্যে কিছু চরিত্র তাঁর হৃদয়ে স্থায়ী ছাপ রেখে যায়। প্রথম সিনেমার চিত্রনাট্যে সেসব চরিত্রকেই তুলে আনলেন। টঙ্গীর এক বস্তিকে ঘিরে আবর্তিত হয়েছে সিনেমার গল্প।
২০১৭ সালে সিনেমাটি নির্মাণের প্রস্তুতি নিতে শুরু করেন তিনি। সিনেমার চরিত্রকে কাছে থেকে দেখতে দিনের পর দিন বস্তিতে কাটিয়েছেন তিনি। বস্তির বাসিন্দাদের থেকেই সিনেমার শিল্পী খুঁজে নিয়েছেন যুবরাজ। সিনেমার প্রধান চরিত্র ‘ল্যাংড়া’র ভূমিকায় অভিনয় করেছেন বাদশা। ৩৫ জনের মধ্য থেকে তাঁকে বাছাই করা হয়। সিনেমার বাকি চরিত্রের মধ্যে সোহাগী খাতুন, দুলাল মিয়া, সাদেককেও বস্তিতেই খুঁজে পেয়েছেন নির্মাতা।
বুধবার দুপুরে বসুন্ধরা সিটির স্টার সিনেপ্লেক্সে যে দর্শকেরা ছবি দেখতে এসেছিলেন, তাঁরা জীবনের প্রথম সিনেপ্লেক্সে ছবি দেখছেন। একসঙ্গে তাঁরা এসেছেন আদিম ছবিটি দেখতে। এসেছিলেন ছবির অভিনয়শিল্পী বাদশা, সোহাগী খাতুন, দুলাল মিয়া, সাদেক, হেলেনা, হবু, নাসিরসহ অনেকে। যুবরাজ শামীমের ‘আদিম’ ছবিটি দেখতেই এদিন তাঁরা টঙ্গী থেকে বসুন্ধরা সিনেপ্লেক্সে এসেছেন।
একজনকে দেখা গেল ক্রাচে ভর দিয়ে এসেছেন। তিনি জানান, তাঁর নাম সাদেক। টঙ্গী রেলস্টেশন–সংলগ্ন ব্যাংক মাঠ বস্তিতে তাঁর আশ্রয়। সাদেক জানান, আগে তাঁর দুই পা ঠিকই ছিল। ট্রাকের ড্রাইভার ছিলেন। একটা দুর্ঘটনায় পা কেটে ফেলতে হয়। এরপর থেকে ভিক্ষাই তাঁর পেশা। পরিচালকের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে তিনি জানান, আবার কখনো যদি সুযোগ হয়, কেউ যদি তাঁকে অভিনয়ে নিতে চান, তিনি সর্বোচ্চ চেষ্টা করবেন ভালো কাজ করার।
পরিচালক যুবরাজ শামীম বলেন, ‘ব্যাংক মাঠ বস্তির মানুষগুলোর কাছে আমি বরাবরই ঋণী। তাঁরা আমাকে সহযোগিতা না করলে আদিম নির্মাণ হয়তো আরও কঠিন হতো। সিনেমা হলে মুক্তির অন্যতম একটা উদ্দেশ্য হলো, সেই মানুষগুলোকে সঙ্গে নিয়ে বড়পর্দায় সিনেমাটি দেখা। সে জন্য বুধবার সবাইকে টঙ্গী থেকে নিয়ে এসেছি আদিম দেখাতে। ছবিটি দেখতে আসা নিয়ে ব্যাংক মাঠ বস্তির মানুষগুলোর মধ্যে যে উচ্ছ্বাস দেখেছি; মনে হয়েছে, আদিম নিয়ে আমার আর পাওয়ার কিছু নেই।’
কলাকুশলীদের নিয়ে এদিন স্টার সিনেপ্লেক্সে বেলা ২টা ২০ মিনিটের শো দেখেন নির্মাতা। সেখানে ছিলেন সাধারণ দর্শকও। সিনেমা শেষে কলাকুশলীদের পেয়ে সাধারণ দর্শক মাতেন সেলফিতে। ছবির প্রধান তিন কুশলী বাদশা, সোহাগী ও দুলালকে ছাড়াও সাদেকের অভিনয়ের প্রশংসা করেন অনেকে।
নির্মাতা জানান, বৃহস্পতিবার শেষবারের মতো রাজধানীতে দেখা যাবে আদিম। এই পুরো সপ্তাহ ছবিটি চলেছে বসুন্ধরা স্টার সিনেপ্লেক্স ও যমুনা ব্লকবাস্টার সিনেমাসে। তবে দ্বিতীয় সপ্তাহেও আদিম চলবে নারায়ণগঞ্জে সিনেস্কোপে ।
৪৪তম মস্কো আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে গত বছরের সেপ্টেম্বরে নেটপ্যাক জুরি পুরস্কার জিতেছে আদিম, এরপর আরও কয়েকটি চলচ্চিত্র উৎসবে সিনেমাটি পুরস্কৃত ও প্রশংসিত হয়েছে। ২০১৮ সালে নির্মাণকাজ শুরু করেন তিনি। শুটিংয়ে নানা বাধাবিপত্তি পেরোতে হয়েছে। অর্থাভাবে কখনো শুটিং বন্ধও থেকেছে। শেয়ার বিক্রি করে অর্থসংস্থান করে সিনেমার কাজ চালিয়ে গেছেন নির্মাতা। ৫৩ জন শেয়ার কিনে সিনেমার অর্থায়নে অবদান রেখেছেন।