দুইবারের জাতীয় পুরস্কারজয়ী সিনেমাটোগ্রাফার সুমন সরকার। গত ঈদে মুক্তি পাওয়া ‘সুড়ঙ্গ’ সিনেমায় তাঁর কাজ প্রশংসিত হয়েছে দেশে-বিদেশে। তাঁর শুরুর সংগ্রাম, চ্যালেঞ্জ ও এক দশকের ক্যারিয়ারে আলো ফেলা যাক।
‘আমার খুব গর্ব হচ্ছে,’ ফোনের ওপার থেকে বাবার এ কথা শুনে গায়ের লোম খাড়া হয়ে গিয়েছিল সুমন সরকারের। বাবার সঙ্গে তাঁর একধরনের অম্লমধুর সম্পর্ক। খুব একটা কথা হয় না তাঁদের। ছেলে সিনেমাটোগ্রাফার। কখনো বাধা না দিলেও উৎসাহ দিয়েছেন বলা যাবে না। সেই বাবাই যখন ছেলের জাতীয় পুরস্কার পাওয়ার পর ফোন করে ওপরের কথাটা বলেন, ছেলের তখন রোমাঞ্চিত না হয়ে উপায় কী! বাংলাদেশের বাস্তবতায় সিনেমাটোগ্রাফি নিয়ে সেভাবে পড়াশোনার সুযোগ নেই। দীর্ঘ এক দশক সংগ্রামের পর কীভাবে সুমন সরকার নিজের জায়গা করে নিলেন, সে গল্প জানতে একটু পেছনে ফিরে যেতে হবে।
স্বপ্ন নিয়ে খুলনা থেকে ঢাকায়
জন্ম ও বেড়ে ওঠা খুলনায়। জেলা স্কুল ও সুন্দরবন কলেজের পাট চুকিয়ে ভর্তি হলেন খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে। বিষয় জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে গিয়েই তাঁর সামনে খুলে গেল নতুন এক দুনিয়া। ক্যাম্পাসের ফিল্ম ক্লাব, থিয়েটার ক্লাব, ফটোগ্রাফি সোসাইটি, ক্রিকেট টিম, বিভাগের সাময়িকী সম্পাদনা—সবকিছুতেই যুক্ত হয়ে গেলেন। সঙ্গে চলল সিনেমা দেখা। ক্যাম্পাসজীবনে বেডমেট হিসেবে পেলেন সুপ্তকে (ইউটিউবে জনপ্রিয় গানের দল ‘দ্য রেহমান ডুয়ো’র রুসলান রহমান)। বন্ধুর গান-সিনেমার নেশা, সুমনেরও তা–ই। দুজন মিলে নিজেদের আবিষ্কার করলেন বিশ্ব সিনেমার অলিগলিতে। একটা সময় সুখের ক্যাম্পাসজীবন শেষ হলো। ঢাকায় এসে নির্মম বাস্তবতার মুখোমুখি হলেন সুমন, ‘তখন বন্ধুরা চাকরির চেষ্টা করছে। বাড়ি থেকে “কিছু একটা” করার চাপ আছে। অনিচ্ছা সত্ত্বেও একটা আইটি কোম্পানিতে ঢুকে গেলাম। বেতন ১৪ হাজার টাকা। এটা ২০১০ সালের ঘটনা। ওই টাকায় ঢাকায় থাকা-খাওয়া হয়ে যেত।’
ঢাকায় এসেই নির্মাতা তানভীর মোকাম্মেলের বাংলাদেশ ফিল্ম ইনস্টিটিউটে চলচ্চিত্র নিয়ে কোর্স করলেন। টিকে থাকতে চাকরি করলেও মন পড়ে ছিল নির্মাণে। ফেসবুকে নির্মাতাদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেন। কেউ সাড়া দেন, কেউ দেন না। এভাবে একদিন ডাক এল দীপংকর দীপনের কাছ থেকে। তাঁর টিমে ভিড়ে গেলেন চতুর্থ সহকারী পরিচালক হিসেবে। বেশ আগেই বাবাকে বলে–কয়ে ক্যামেরা কিনেছিলেন।
নিজের ক্যামেরা থাকায় সুবিধাই হলো। শুটিংয়ের স্টিল ছবি, বিহাইন্ড দ্য সিনের ভিডিও—এসবও করেন। সঙ্গে চলে মিউজিক ভিডিও নির্মাণসহ আরও কিছু কাজ। এর মধ্যেই রন ফ্রিকের তথ্যচিত্র ‘বারাকা’ ও ‘সামাসারা’ দেখার পর ভিজ্যুয়াল নিয়ে সুমনের সব ধারণা ওলটপালট হয়ে গেল। তাঁর ভাষ্য, ‘ভিজ্যুয়ালি কীভাবে গল্প বলা যায়, পরিচালক সেটিই দেখিয়েছেন। প্রথমবার দেখার পর সেভাবে বুঝিনি, কিন্তু ঢাকায় আসার পর ফিল্ম ইনস্টিটিউটে কোর্স করার পর এই দুই তথ্যচিত্র নিয়ে আমার ধারণা বদলে গেল। সঙ্গে আরও প্রচুর বিদেশি সিনেমা দেখা হয়েছে। বুঝলাম, চলচ্চিত্র কেবল দেখা নয়; দেখা শেষে অনেক বোঝাপড়ার ব্যাপার থাকে। সেগুলো ধীরে ধীরে আত্মস্থ করতে থাকলাম।’
অমিতাভ-যোগ
মোটা দাগে সুমন সরকারের জীবনটা বদলে গেল ২০১৩ সালে। সে বছর একটি মুঠোফোন কোম্পানি স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র প্রতিযোগিতার আয়োজন করে। সুমন, সুপ্ত ও সুপ্তর বড় ভাই রেদওয়ান মিলে একটি স্বল্পদৈর্ঘ্য সিনেমা বানান—‘সিন্স উই সেপারেটেড’। প্রায় কোনো প্রত্যাশা ছাড়াই সিনেমাটি বানিয়েছেন তাঁরা, কিন্তু শেষ পর্যন্ত প্রতিযোগিতায় প্রথম পুরস্কার জিতে নেয় সিনেমাটি। ওই প্রতিযোগিতার জুরিবোর্ডে ছিলেন অমিতাভ রেজা; পুরস্কার জেতার পর সুমনদের নিজের অফিসে ডেকে পাঠান নির্মাতা।
এরপর কী হলো শোনা যাক সুমনের মুখেই, ‘ওনার অফিসে আমরা কিছুদিন কাজ করেছি, তখন “আয়নাবাজি”র চিত্রনাট্য লেখা চলছিল; আমি আর সুপ্ত কিছুদিন গবেষক হিসেবে কাজ করলাম। এরপর একদিন হুট করেই অমিতাভ ভাই ওনার একটা টিভি ফিকশনে সিনেমাটোগ্রাফার হিসেবে কাজ করতে বলেন। এটা ছিল আমার জন্যও বড় চমক। কারণ, তখনো আমি কাজের জন্য পুরোপুরি তৈরি হইনি। তা ছাড়া অমিতাভ ভাইয়ের সব প্রজেক্টেই রাশেদ জামান ভাই কাজ করেন। সেখান থেকে আমাকে সুযোগ দেওয়ায় আশ্চর্য হয়েছিলাম।’ সুযোগটাকে কাজে লাগিয়ে ফিকশনের সিনেমাটোগ্রাফার হিসেবে যাত্রা শুরু হলো। টিভি ফিকশন করলেন, বিজ্ঞাপনচিত্র করলেন। ২০১৯ সালে করলেন ন ডরাই। প্রথম সিনেমায়ই মিলল জাতীয় পুরস্কার। এরপর দ্বিতীয়বার জাতীয় পুরস্কার পান লাল মোরগের ঝুঁটির জন্য। সর্বশেষ সুড়ঙ্গসহ প্রেক্ষাগৃহ ও ওটিটির জন্য করেছেন ‘অ্যাডভেঞ্চার অব সুন্দরবন’, ‘ক্যাফে ডিজায়ার’, ‘দামাল’, ‘ঊনলৌকিক’-এর মতো আলোচিত কাজ।
সমুদ্র থেকে সুড়ঙ্গে
এ পর্যন্ত করা কাজগুলোর মধ্যে সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং ছিল কোনটি? প্রশ্ন শুনে কিছুক্ষণ বিরতি। এরপর সুমন সরকার জানালেন, প্রতিটি কাজেরই আলাদা করে চ্যালেঞ্জ ছিল। বিষয়টি ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, ‘আমি যেসব বিষয়ে সিনেমা করেছি, সেগুলো সাধারণত আগে দেশে হয়নি। যেমন “ন ডরাই” সার্ফিং নিয়ে, পানির ওপর শুটিং ছিল বড় চ্যালেঞ্জ। হাতে ক্যামেরা বেঁধে, ওয়াটারপ্রুফ জ্যাকেট পরে শুটিং ছিল খুবই কঠিন। এরপর “দামাল” ছিল স্পোর্টস সিনেমা, এ ধরনের কাজও আগে করা হয়নি। শেষ “সুড়ঙ্গ”তে আবার মাটির নিচে শুটিংয়ের অভিজ্ঞতা হলো। প্রচণ্ড গরমে টানা ২২ দিন সুড়ঙ্গের ভেতর ঢুকে হাঁটুর ওপর ভর দিয়ে কাজ করা ভয়ের অভিজ্ঞতা ছিল।’
সামনে বেশ কয়েকটি সিনেমা ও ওটিটির কাজ আসবে। সুড়ঙ্গর সাফল্যের পর কলকাতার বেশ কয়েকটি সিনেমার প্রস্তাব পেয়েছেন। জানালেন, চিত্রনাট্য পড়ে তাঁর কাছে বিশ্বাসযোগ্য হলে তবেই তিনি রাজি হন। এখনকার প্রজন্মের অনেক দর্শক কেবল অভিনয়, গল্প নয়; সিনেমার কারিগরি দিক নিয়েও আলোচনা করেন। এটা তাঁকে খুব আশাবাদী করে বলেও জানান এই সিনেমাটোগ্রাফার।