চলচ্চিত্র অঙ্গনে তারকা, পরিচালক, প্রযোজক কলাকুশলীরা একে অন্যের বিরুদ্ধে মামলা বা অভিযোগ এখন স্বাভাবিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। চলচ্চিত্রের চেয়ে এসব ঘটনাই বছরের বেশি ভাগ সময় আলোচনায় থাকছে। প্রতি মাসেই দু-একটি মামলা, সাধারণ ডায়েরি বা অভিযোগের ঘটনা খবরে আসছে। কেউ বাধ্য হয়ে মামলার হুমকি দিয়েছেন। চলচ্চিত্রসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, ঢালিউডে এত মামলা বা অভিযোগের ঘটনা আগে শোনা যায়নি। জানা যায়, চলতি বছরের ৮ মাসেই ৮ থেকে ১০টি ঘটনা গণমাধ্যমে এসেছে। গণমাধ্যমে উঠে আসা আলোচিত মামলা-সম্পর্কিত ঘটনাগুলো ধারাবাহিকভাবে তুলে ধরা হলো।
মিশা-জায়েদের নামে আলমগীরের মামলার ঘোষণা
চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির নির্বাচনের আগেই মিশা-জায়েদ প্যানেলের সঙ্গে ইলিয়াস কাঞ্চন-নিপুণ পরিষদের দ্বন্দ্ব চরমে ওঠে। এর মধ্যে কাঞ্চন-নিপুণ পরিষদ থেকে অভিযোগ করা হয়, মিশা ও জায়েদ নির্বাচিত হয়ে চলচ্চিত্রশিল্পী সমিতি থেকে ১৮৪ শিল্পীকে বাদ দিয়েছেন। এর জবাবে মিশা-জায়েদ খানদের প্যানেল থেকে বলা হয়, যখন বাদ দেওয়া হয়, সেখানে আলমগীরের স্বাক্ষর ছিল। এ ঘটনায় আলমগীর চটে যান। তিনি কাঞ্চন-নিপুণ পরিষদে পরিচিতি সভায় এসে রাগান্বিত হয়ে বক্তব্যে বলেন, ‘তাঁরা বারবার বলছেন, শিল্পীদের বাদ দেওয়ার তালিকায় নাকি আমার স্বাক্ষর আছে। ওই ফাইল আমি একটু দেখতে চাই। তাঁরা হয়তো ফটোকপির মতো কিছু একটা করেছেন, আমি এখনো জানি না তাঁরা কী করেছেন। আর আমি এটার জন্য তাঁদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি আইনে মামলা করব।’ চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতি ঘিরে এটাই ছিল প্রথম মামলার ঘোষণা, যদিও শেষ পর্যন্ত মামলা পর্যন্ত গড়ায়নি ঘটনাটি।
জায়েদ-নিপুণের পাল্টাপাল্টি মামলার হুমকি
২৮ জানুয়ারি চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির নির্বাচন হয়। সভাপতি পদে জয়ী হন ইলিয়াস কাঞ্চন ও সাধারণ সম্পাদক পদে জায়েদ খান। তবে সেই নির্বাচনে সাধারণ সম্পাদকের ফলাফল মেনে নেননি সাধারণ সম্পাদক পদপ্রার্থী নিপুণ আক্তার। পরে পদটি নিয়ে তৈরি হয় জটিলতা। সাধারণ সম্পাদক পদে জয়ী জায়েদ খানের বিরুদ্ধে অনিয়ম ও নির্বাচনে প্রভাব বিস্তারের অভিযোগ এনে সংবাদ সম্মেলন করেন নিপুণ। সেই সময় এই অভিনেত্রী প্রমাণস্বরূপ জায়েদ খানের সঙ্গে এক ব্যক্তির মেসেঞ্জার কথোপকথনের স্ক্রিনশট ফাঁস করেন। এগুলো মিথ্যা কথোপকথন উল্লেখ করে তথ্যপ্রযুক্তি আইনে মামলার কথা জানান জায়েদ খান। সেই সময় নিপুণ গণমাধ্যমে জানান, ‘আমিও ১০০টি মামলা করব জায়েদ খানের নামে।’ মাসজুড়ে চলচ্চিত্র অঙ্গন সমালোচনায় ছিল এ মামলা। পরে অবশ্য মামলার কথা শোনা যায়নি।
মালেক আফসারীর বিরুদ্ধে মামলার ঘোষণা
মার্চ মাসের প্রথম দিকের ঘটনা। হঠাৎই পরিচালক মালেক আফসারীর প্রকাশিত একটি ভিডিও নিয়ে ক্ষেপে যান অভিনেত্রী অরুণা বিশ্বাস। সেই ভিডিওতে মালেক আফসারী অরুণা বিশ্বাসকে ব্যক্তিগতভাবে আক্রমণ করেন। তাঁকে দ্বিতীয় সারির অভিনেত্রী বলেও ছোট করেন। ভিডিওতে মালেক আফসারী আরও কিছু ইঙ্গিতপূর্ণ কথা বলেন, যা অরুণার ব্যক্তিগত ইমেজ ও পারিবারিক সম্মান নষ্ট করেছে। এমনটাই গণমাধ্যমে জানিয়েছিলেন অরুণা বিশ্বাস। সে সময় ক্ষিপ্ত হয়ে এই অভিনেত্রী তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানায় জিডি করেন। তিনি ঘটনাটি নিয়ে জানিয়েছিলেন, জিডি করেছেন। মালেক আফসারীর বিরুদ্ধে ডিজিটাল অ্যাক্টে মানহানির মামলা করবেন। ঘটনাটি সে সময় আলোচনায় থাকলেও পরে মামলা সম্পর্কে কিছু জানা যায়নি। মালেক আফসারী ভিডিওটি সরিয়ে ফেলেন।
জায়েদ বনাম ওমর সানী দ্বন্দ্ব ও মামলা
মিডিয়া অঙ্গনে গত জুন মাসের আলোচিত ঘটনা এটি। খল অভিনেতা ও চলচ্চিত্র প্রযোজক ডিপজলের ছেলের বিয়ের আসরে গিয়ে জায়েদ খানকে থাপ্পড় মারেন আরেক চিত্রনায়ক ওমর সানী। জানা গিয়েছিল, স্ত্রী চিত্রনায়িকা মৌসুমীর সঙ্গে খারাপ আচরণের জেরে ওমর সানী জায়েদকে চড় মেরে বসেন। এই সময় পিস্তল বের করে ওমর সানীকে মারার হুমকি দেন জায়েদ। পরে অবশ্য জায়েদ জানান, পিস্তল বের করার মতো ঘটনা ঘটেনি। সানী ছিলেন মদ্যপ। সানীর দাবি, তিনি স্বাভাবিক ছিলেন। এ ঘটনার জের বাড়তে থাকে। হুমকির ঘটনায় জায়েদ খানের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতি বরাবর লিখিত অভিযোগ দেন ওমর সানী। তখন জানিয়েছিলেন থানায় জিডি করার কথাও। এমন ঘটনায় জায়েদ খানও ঘোষণা দিয়েছিলেন, পরিস্থিতি বুঝে তিনিও মানহানির মামলা করবেন। সপ্তাহজুড়ে ঘটনাটি আলোচনায় ছিল। পরে অবশ্য কেউই মামলার পথে হাঁটেননি।
পরীমনির বিরুদ্ধে মামলা
গত বছরের ৮ জুন সাভারের বিরুলিয়ায় ঢাকা বোট ক্লাবে ধর্ষণ ও হত্যাচেষ্টার অভিযোগ এনে চিত্রনায়িকা পরীমনি ব্যবসায়ী নাসির ইউ মাহমুদসহ ছয়জনের বিরুদ্ধে সাভার থানায় মামলা করেন। সেই সময় পরীমনি মামলা ঘিরে নতুন করে আলোচনায় আসেন। মামলা চলমান অবস্থায় চলতি বছর জুলাইয়ে পরীমনির মারধর ও হত্যাচেষ্টার অভিযোগে ব্যবসায়ী নাসির ইউ মাহমুদ পরীমনির বিরুদ্ধে মামলা করেন। ব্যবসায়ী নাসির ইউ মাহমুদ মামলায় অভিযোগ করেন, সেদিন পরীমনি ও তাঁর সহযোগীরা সাভারের বোট ক্লাবে ঢুকে ওয়াশরুম ব্যবহার করেন। পরে ক্লাবের ভেতরে বসে অ্যালকোহল পান করেন। রাত ১টা ১৫ মিনিটের দিকে ক্লাব ত্যাগ করার সময় পরীমনি তাঁকে ডাক দেন। তাঁকে একটি বিশেষ ব্র্যান্ডের অ্যালকোহলের বোতল বিনা মূল্যে দেওয়ার জন্য চাপ দেন। এতে রাজি না হওয়ায় পরীমনি তাঁকে গালমন্দ করেন। একপর্যায়ে পরীমনি হত্যাচেষ্টার জন্য একটি গ্লাস ছুড়ে মারেন, যা তাঁর মাথায় ও বুকে লাগে বলে মামলায় অভিযোগ করেন নাসির ইউ মাহামুদ। এ মামলায় বর্তমানে জামিনের রয়েছেন পরীমনি।
দুই দেশে অনন্ত জলিলের বিরুদ্ধে মামলা ঘোষণা
অনন্ত জলিল অভিনীত ও প্রযোজিত ‘দিন: দ্য ডে’ সিনেমাটির বাজেট, অভিনয়, ভিএফএক্সসহ বেশ কিছু বিষয় নিয়ে মুক্তির আগেই শুরু হয় আলোচনা-সমালোচনা। মুক্তির আগে অনন্ত জানান, শরীফুলসহ ‘পরাণ’ সিনেমার অনেককেই তিনি চেনেন না। তাঁদের তিনি প্রতিযোগী মনে করেন না। অন্যদিকে একই সঙ্গে মুক্তি পাওয়া ‘সাইকো’ সিনেমাটির পরিচালক অনন্য মামুনকেও ছোট করেন অনন্ত জলিল। শুরু হয় ত্রিমুখী দ্বন্দ্ব। সেগুলো নিয়ে একাধিক খবর প্রকাশিত হয়। এরপর হঠাৎই সিনেমাটির পরিচালক মুর্তজা অতাশ জমজম গত সপ্তাহে অভিযোগ করেন। তাঁর অভিযোগ, অনন্ত জলিল সিনেমার চুক্তি ও শর্ত ভঙ্গ করেছেন। সিনেমার প্রধান প্রযোজক হওয়া সত্ত্বেও অর্ধেক নির্মিত সিনেমা তাঁর কাছ থেকে হাতিয়ে নিয়েছেন অনন্ত। এ ঘটনা অস্বীকার করেন অনন্ত জলিল। পরে মুর্তজা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ঘোষণা করেন, অনন্ত জলিলের বিরুদ্ধে তেহরানে মামলার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। বাংলাদেশের আদালতেও মামলা করবেন।
‘হাওয়া’ সিনেমা ঘিরে মামলার আবেদন
‘হাওয়া’ সিনেমা দিয়ে ঈদের পর দেশের চলচ্চিত্র অঙ্গনে সুদিনের আভাস পাওয়া যাচ্ছিল। সিনেমাটি দর্শকদের মধ্যে সাড়া ফেলেছিল। প্রশংসায় ভাসছিল হাওয়া টিম। এমন অবস্থায় এল দুঃসংবাদ। ‘হাওয়া’ সিনেমায় একটি পাখি খাঁচায় আটকে রাখার দৃশ্যায়ন করার অভিযোগে সিনেমাটির পরিচালকের বিরুদ্ধে মামলা নেওয়ার আবেদন করেছেন বন বিভাগের বন্য প্রাণী অপরাধ দমন ইউনিট। ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালতে এ আবেদন করেছেন বন্য প্রাণী অপরাধ দমন ইউনিটের পরিদর্শক নার্গিস সুলতানা। এমন ঘটনায় থেমে নেই। ‘হাওয়া’ সিনেমার প্রদর্শন বন্ধে আইনি নোটিশ দেওয়া হয়েছে। এ ঘটনায় হতবাক চলচ্চিত্র অঙ্গনের মোস্তফা সরয়ার ফারুকী, অমিতাভ রেজাসহ একাধিক পরিচালক, অভিনয়শিল্পী ও কলাকুশলী। বিষয়টি নিয়ে এখনো নানা কথা হচ্ছে।
প্রযোজকের মামলার হুমকি, মাহিয়া মাহির পাল্টা জবাব
২৬ আগস্ট মাহিয়া মাহি ও রোশান অভিনীত ‘আশীর্বাদ’ সিনেমাটি মুক্তি পাচ্ছে। এর আগেই সিনেমাটির প্রচারণা ঘিরে সিনেমার অভিনয়শিল্পী ও প্রযোজকের মধ্যে দ্বন্দ্ব শুরু হয়। নায়ক জিয়াউল রোশান ও নায়িকা মাহিয়া মাহিকে ছাড়াই সংবাদ সম্মেলনে সিনেমাটি মুক্তির ঘোষণা দেন প্রযোজক তাহেরা জেনিফার। সংবাদ সম্মেলনে কেন নায়ক-নায়িকা নেই, এমন প্রশ্নে জেনিফার জানান, তাঁরা ‘আশীর্বাদ’ সিনেমাটির পোস্টার শেয়ার দেননি। এ ছাড়া সিনেমাটি নিয়ে অসহযোগিতা করেছেন। প্রযোজকের এমন মন্তব্যে পাল্টা অভিযোগে সংবাদ সম্মেলন করেন মাহি ও রোশান। তখন প্রকাশ্যে আসে সিনেমাটি নির্মাণে সরকারি অর্থের যথাযথ ব্যবহার হয়নি, সিনেমা নির্মাণের অসংগতিসহ নানা প্রসঙ্গে। এ ঘটনার পর মাহির বিরুদ্ধে প্রযোজক মিথ্যা মামলার হুমকি দিচ্ছেন বলে অভিযোগ ওঠে। মাহির মত, প্রযোজকের মিথ্যা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বক্তব্য ও কর্মকাণ্ডে তিনি বিব্রত। এতে তাঁর মানহানি হচ্ছে। এমন ঘটনায় সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য গত মঙ্গলবার শিল্পী সমিতি বরাবর লিখিত আবেদন করেন এই চিত্রনায়িকা।
মামলাসংক্রান্ত ঘটনা নিয়ে চলচ্চিত্র পরিচালক ও বিশ্লেষক মতিন রহমান বলেন, ‘এত মামলার কথা আগে শুনিনি। এখনো এফডিসির দিকে তাকালেই মামলা অভিযোগের কথাই বেশি শুনি। এর কারণ এখন অনেকেরই ধৈর্য কমে গেছে। সবাই শুধু ভাইরাল হয়ে ফেমাস হতে চাচ্ছেন। তাঁরা মনে এটাকে কৌশল মনে করছেন। অনেকের কাজ নেই। এ ছাড়া কেউ কারও কথা শুনছেন না। এতে শিল্পী-কলাকুশলীরাই নিজেদের সস্তা করছেন। এর সুযোগ নিচ্ছেন কিছু ইউটিউব চ্যানেলের ব্যবসায়ীরা। চলচ্চিত্রের পড়ন্ত বিকেলটা নষ্ট করে দিচ্ছেন তাঁরা। এ ঘটনাগুলো আমাদের দেখে কষ্ট নিয়ে চুপ থাকতে হচ্ছে।’