অভিনেতা শরিফুল রাজ
অভিনেতা শরিফুল রাজ

অর্থকষ্টে ঢাকা ছেড়েছিলেন, হঠাৎ পাল্টে যায় দিন


সময়ের আলোচিত অভিনেতা শরিফুল রাজ। বেশ কিছু সাড়াজাগানো সিনেমায় অভিনয় করে ইতিমধ্যে নিজেকে প্রমাণ করেছেন। প্রেমের এক সপ্তাহের মাথায় ঢাকাই চলচ্চিত্রের অভিনেত্রী পরীমনিকে বিয়ে করে নতুন করে আলোচনায় আসেন এই অভিনেতা। আজ এই অভিনেতার জন্মদিন। অভিনয়, ব্যক্তিজীবনসহ নানা কারণে আলোচনায় থাকা এই অভিনেতার বিনোদনজগতে আসার শুরুটা ছিল সংগ্রামের। আজ সেই গল্পই আবার জেনে নিই।

২০০৯ সালের কথা। রাজ তখন শিক্ষার্থী। মূলত পড়াশোনার জন্যই সিলেট থেকে ঢাকায় আসেন। এই শহরটা ভালো লেগে যায় এই তরুণের। কিন্ত ব্যস্ত এই শহরে জীবনযাপনের খরচও আছে। আর্থিক সংকট তাঁকে এক বছরও টিকতে দেয়নি এই শহরে। নারায়ণগঞ্জে মামার কাছে চলে যান। সেই সময় জীবনটা অন্য দিকে মোড় নিতে পারত। রাজ হারিয়ে যেতেন হয়তো হাজার তরুণ, যুবকের ভিড়ে। কিন্তু তা হয়নি। গল্পটা আবার শুরু হয়।
পরের বছরই আবার ঢাকায় ফিরে আসেন, ভর্তি হন একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে। দিনে ক্লাস, সন্ধ্যা হলেই ধানমন্ডি ৮ নম্বরে আড্ডা—এভাবেই কাটছিল  জীবন। একটা সময় আর্থিক সংকটে লেখাপড়া বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়। বন্ধু হাবিব তাঁর মেসে জায়গা দেন রাজকে। শুরু হয় এক ঘরে ১৫ জন ঠাসাঠাসি করে থাকা। রাজ বলেন, ‘সে এক কঠিন সময়। বন্ধুর কল্যাণে মেসে থাকার জায়গা হলো। ১৫ জন একসঙ্গে থাকি। পকেটে টাকা নেই। পড়ালেখা বন্ধ হয় হয় অবস্থা। কী করব বুঝে উঠতে পারছিলাম না। তখন পরিবারের ওপর নির্ভরশীল হওয়ার সুযোগটাও ছিল না। দিশাহারা অবস্থা আমার।’
ওই সময় ধানমন্ডির আড্ডাই কিছুটা আলোর পথ দেখায় রাজকে। সেখানে বিজ্ঞাপনচিত্র নির্মাণের সঙ্গে যুক্ত কিছু মানুষ আসতেন। তাঁদের সঙ্গে পরিচয় হয় রাজের। এই শহরে কিছু একটা করে টিকতে হবে, এই ভেবে মুঠোফোন সংযোগদাতা প্রতিষ্ঠান বাংলালিংকের ‘দেশ-৫’ বিজ্ঞাপনচিত্রে ‘সাইড আর্টিস্ট’ হিসেবে কাজ করেন রাজ।

সন্তান রাজ্যসহ শরিফুল রাজ ও পরীমনি

সেই সময় নিয়ে তিনি বলেন, ‘আড্ডায় পরিচয় হওয়া একজন নিয়ে গেলেন পরিচালক পিপলু আর খানের অফিসে। বিজ্ঞাপনচিত্রের মূল মডেল আরিফিন শুভ, সারিকা, নিলয়। বিজ্ঞাপনে আমার কাজ অনেকটা এক্সট্রার মতো। মূল মডেলের সঙ্গে ছড়ানো–ছিটানো ছেলেমেয়েদের দলে আমি। মহড়া হলো কয়েক দিন। এরপর শুটিং।

শরিফুল রাজ

প্রথমবারেই পেলাম ৮ হাজার টাকা। সেই আনন্দের কথা বলে বোঝানো যাবে না।’
ঢাকায় বাঁচতে আর চলতে এর পর থেকে প্রায়ই বিজ্ঞাপনচিত্রে বাড়তি শিল্পী হিসেবে কাজ করতে লাগলেন শরিফুল রাজ। এই সময়ের মধ্যে দুয়েক জায়গায় চাকরি ধরা এবং ছাড়াও হয়েছে। কিন্তু ধীরে ধীরে মডেলিংয়ের জগৎ ঘিরে আগ্রহ বাড়তে থাকে রাজের। ২০১১ সালে মডেল বুলবুল টুম্পার গ্রুমিং স্কুলে ভর্তি হন। ২০১২ সাল থেকে শুরু করেন মডেল হিসেবে র‌্যাম্পে হাঁটা। পরবর্তী সময়ে মডেল আজরা মাহমুদের সঙ্গে কাজের সুযোগ হয়। র‌্যাম্পের পাশাপাশি বিভিন্ন ব্র্যান্ডের ফটোশুটেও মডেল হতে থাকেন। রাজ বলেন, ‘তখন নিজেকে কিছুটা গুছিয়ে এনেছি। নিয়মিত ফটোশুট, র‌্যাম্পে কাজ করছি। এতে আর্থিক সংকট কিছুটা কাটে।’

শরিফুল রাজ ও বুবলী

পাল্টে যায় দিন
২০১৫ সালের কথা। হঠাৎ একদিন বুলবুল টুম্পা ফোনে রাজকে জানান, নির্মাতা রেদওয়ান রনি একটি সিনেমা বানাবেন। রাজের তলব এসেছে রনির অফিস থেকে। ‘আগে থেকেই রেদওয়ান রনির নাটকের ভক্ত আমি। টুম্পা আপার ফোন পেয়ে খানিকটা ভয়ে ভয়ে রনি ভাইয়ের অফিসে গেলাম। অডিশন হলো।

পরের দিন আবার ডাকলেন। তাঁর “আইসক্রিম” ছবিতে কাজের প্রস্তাব করলেন। এরপরই সব বদলে যেতে থাকল’—এভাবেই সিনেমার সঙ্গে জড়িয়ে পড়ার কথা বলতে থাকেন রাজ।
‘আইসক্রিম’–এর জন্য প্রস্তুতি নিতে র‌্যাম্প, ফটোশুট বন্ধ করে দেন রাজ। কিন্তু ছবি মুক্তির পর আবারও আর্থিক সংকট আঁকড়ে ধরে তাঁকে।

বিয়ের সাজে পরীমনি ও শরিফুল রাজ

রাজ বলেন, ‘“আইসক্রিম” ছবি মুক্তির আগপর্যন্ত অন্য কোনো কাজ করিনি। একটা সময় পকেটে এক টাকাও ছিল না। রনি ভাইয়ের অফিসেই থাকতে লাগলাম। খেয়ে–পরে বাঁচার জন্য পরে আবার মডেলিংয়ে ফেরার চেষ্টা করি। ২০১৭ ও ২০১৮ সালে আবার র‌্যাম্প আর ফটোশুট করে চলতে থাকি।’

রাজের পুরো পরিবারই সিনেমাপ্রেমী। সুযোগ পেলেই এখনো ‘রূপবান’ কিংবা ‘বেদের মেয়ে জোস্‌না’ দেখতে বসে যান রাজের মা। তাই সিনেমার ঝোঁক পরিবার থেকেই পেয়েছেন রাজ। এখন সিনেমাই একমাত্র লক্ষ্য তাঁর। আর্থিক সংকট থাকলেও একটি সিনেমা করার পর আরেকটির অপেক্ষায় থাকেন। তবু ঘাবড়ে গিয়ে হাল ছেড়ে দেন না। রাজ বলেন, ‘সিনেমাটা করতে চাই। “আইসক্রিম”ছবিতে কাজ করার পর সিনেমাই আমার একমাত্র লক্ষ্য হয়ে গেছে। একেই আঁকড়ে ধরে থাকতে চাই।’
এটা নিশ্চিত, ২০১৬ সালে রেদওয়ান রনির ‘আইসক্রিম’ ছবিতে অভিনয়ই রাজের জীবনের টার্নিং পয়েন্ট। মুক্তির পর প্রথম ছবিতেই খানিকটা আলোচনায় আসেন এই নবাগত। এর মধ্যে এক বছর অভিনয় করেননি। আবার র‌্যাম্প, স্থিরচিত্রের মডেলিংয়ে ফিরে যান তিনি। পরের বছর ২০১৭ সালে তানিম রহমানের ‘ন ডরাই’ ছবিতে অভিনয় করে নতুনভাবে সবার দৃষ্টি কাড়েন এই অভিনেতা।

মেধাবী পরিচালকেরাও তাঁর মধ্যে খুঁজে পান নতুন সম্ভাবনা। আর পেছনে ফিরতে হয়নি। পরপর পরিচালক রায়হান রাফির ‘পরাণ’, মেজবাউর রহমান সুমনের ‘হাওয়া’ সর্বশেষ গিয়াস উদ্দিন সেলিমের ‘গুণিন’ ছবিতে অভিনয়ের সুযোগ পান।

‘গুণিন’ সিনেমার মুখ্য দুই চরিত্রে অভিনয় করেছেন শরিফুল রাজ ও পরীমনি

চলতে থাকে রাজের জয়ের রথ। চলতি বছর মুক্তি পায় রাজ অভিনীত সিনেমা ‘কাজলরেখা’, ‘ওমর’ ও ‘দেয়ালের দেশ’। দুটি সিনেমায় রাজের অভিনয় প্রসংশিত হয়।
ব্যক্তিজীবনে টানাপোড়েন
মডেলিং, অভিনয়ে ব্যস্ততার পাশাপাশি ব্যক্তিজীবন নিয়ে বারবার আলোচনায় আসেন রাজ। বললে বাড়াবাড়ি হবে না, পরীমনির সঙ্গে বিয়ে তাঁর এযাবৎ ব্যক্তিজীবনের বড় ঘটনা। মাত্র সাত দিনের পরিচয়ে ২০২১ সালের ১৭ অক্টোবর গোপনে বিয়ে করেন রাজ-পরী। এরপর ২০২২ সালের জানুয়ারিতে পারিবারিকভাবে আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করেন তাঁরা। গত বছরের ১০ আগস্ট তাঁদের ঘর আলো করে আসে পুত্র শাহীম মুহাম্মদ রাজ্য। বছর না ঘুরতে বিচ্ছেদের সিদ্ধান্ত নেন দুই তারকা। বর্তমানে একাই আছেন রাজ। কাজ করছেন নিজের মতো। ২১ নভেম্বর থেকে ওটিটি প্ল্যাটফর্ম চরকিতে স্ট্রিমিং হবে ‘ওমর’। প্রেক্ষাগৃহের মতো টিকিট কেটে ওমর দেখতে পারবেন দর্শক। সামনে আরও সিনেমার খবর নিয়ে আসছেন এই অভিনেতা।
(এ প্রতিবেদনের বেশ কিছু অংশ প্রথম আলোতে প্রকাশিত রাজের সাক্ষাৎকার থেকে সংগৃহীত)