শাবানা নামটি শুনলে আজও কয়েক প্রজন্মের চলচ্চিত্রপ্রেমীরা নস্টালজিক হন। কয়েক দশক ধরে অভিনয়ের সঙ্গে জড়িত থাকা নায়ক-নায়িকাদের কাছেও স্বপ্নের একটি নাম শাবানা। ৭২ বছর বয়সী শাবানা ৮ বছর বয়সে চলচ্চিত্রে নাম লেখান। টানা চার দশক অভিনয়ের সঙ্গে ছিলেন। দুই যুগ ধরে নেই অভিনয়ে। নেই চলচ্চিত্রসংশ্লিষ্ট কোনো আড্ডায়। অথচ তিনি এখনো আলোচনায় থাকেন। টেলিভিশন চ্যানেলে কোনো না কোনো ছবির সম্প্রচারের মাধ্যমে তিনি ভক্তদের মাঝে থাকেন।
যে শাবানা একসময় অভিনয় দিয়ে সবাইকে মাতিয়ে রাখতেন, তিনি ২৪ বছর ধরে দেশেই নেই। তাঁকে খুঁজে পান না চলচ্চিত্রসংশ্লিষ্ট হাতে গোনা দু-একজন ছাড়া। এখন তিনি স্থায়ীভাবে যুক্তরাষ্ট্রে থাকেন। সঙ্গে আছেন প্রযোজক স্বামী ওয়াহিদ সাদিক ও তিন সন্তান। হঠাৎ বাংলাদেশে আসেন, কয়েক দিন পরিবার ও স্বজনদের সঙ্গে কাটিয়ে আবার উড়াল দেন যুক্তরাষ্ট্রে। পরিবারের সবাইকে নিয়ে নিজের মতো করে থাকতেই যেন আনন্দ তাঁর। তাই তো সন্তান ও নাতি-নাতনিদের নিয়ে কাটে তাঁর সময়।
শাবানা যখন অভিনয় ছাড়েন, তখন ফেসবুক ছিল না। সামাজিক যোগাযোগের অন্য কোনো মাধ্যমও ছিল না। তবে অ্যানালগ যুগের শাবানা যেন ডিজিটাল যুগেও আলোচনায় থাকেন, তাঁর অসাধারণ সব কর্মের কারণে। নাতি-নাতনিরা এসবের খবর শাবানার কাছে পৌঁছেও দেন।
অভিনয়ের চূড়ান্ত ব্যস্ত সময়ে যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমানো শাবানাকে পরে একাধিকবার নতুন চলচ্চিত্রে দেখা যাবে, এমনটা শোনা গিয়েছিল। এর মধ্যে বেগম রোকেয়ার জীবনী নিয়ে তৈরি একটি চলচ্চিত্রের কথা বারবার শোনা গেছে। এখন আর অভিনয়ে ফেরার কোনো সম্ভাবনা নেই বলে জানালেন শাবানা।
বরেণ্য এই অভিনয়শিল্পী বলেন, ‘এই বয়সে আর কীভাবে? এখন তো অনেক বয়স হয়ে গেছে। আল্লাহর নাম নিয়ে পার করে দিচ্ছি সময়। মাঝেমধ্যে সুখময় স্মৃতিগুলো মনে করি। ছেলেমেয়ে, নাতি-নাতনিরা মাঝেমধ্যে আমার ছবি সম্পর্কে নানা কিছু জিজ্ঞাসা করে। আমিও তখন বলি, ওই ছবিটা দেখো। এখন পরিবারটাই আমার জগৎ। এ জগতে আমার অনেক ব্যস্ততা।’
অভিনয়জীবনের সেই সময়ের কথা এখন আর ভাবেন না শাবানা। ভাবতে চানও না। শাবানার মতে, ‘ওসব নিয়ে এখন আর সত্যিই ভাবি না। কারণ, আমি যখন অভিনয় করতাম, মনপ্রাণ দিয়ে তা-ই করতাম। অভিনয়ের সময় আমি সব কিছু ভুলে যেতাম, শুধু অভিনয় নিয়েই থাকতাম। আমি কখনোই আমার কাজে ফাঁকি দিইনি। ভালো-খারাপ যদি কিছু হয়ে থাকে, তা দর্শকেরাই বলবেন। একজন অভিনেত্রী, সংগীতশিল্পী, খেলোয়াড়, রন্ধনশিল্পী—সবাই কিন্তু চান তাঁর সেরাটা উপহার দিতে। আমিও তেমনটাই চেয়েছিলাম।’
২৪ বছর ধরে অভিনয়ে নেই শাবানা। তাতে কী? চার দশক ধরে এমন সব চরিত্রে অভিনয় করেছেন, যা মানুষের মনে গেঁথে গেছে। নিজেকে নিয়ে গেছেন অনন্য এক উচ্চতায়। তাই তো আজও এ দেশের মানুষের মনে তিনি ঠিকই জ্বলজ্বলে একটি নাম। বাংলা ছবিপ্রেমীরা শাবানার নাম শুনলে আবেগপ্রবণ হন, গর্ব বোধ করেন। ২৪ বছর আগে অভিনয়কে বিদায় জানানো শাবানা এখনো কোটি বাঙালির হৃদয়ে অভিনয়ের রানি হয়ে আছেন।
কী কারণে অভিনয় ছেড়েছিলেন সে প্রসঙ্গে শাবানা প্রথম আলোকে বলেন, ‘শৈশবে অভিনয়ের সঙ্গে যুক্ত হই। নিজেকে দেওয়ার মতো সময় পাইনি। কাজ, কাজ আর কাজ। এভাবেই কেটেছে একটানা ৪০ বছর। পরিবার ও সন্তানদের সময় দেওয়ার ব্যাপারটি একটা সময় জরুরি হয়ে পড়ে। দেশের বাইরে পড়াশোনার বিষয়ও ছিল। তাই সন্তানদের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে অভিনয়টা ছাড়তে হয়েছে।’
শাবানার আসল নাম আফরোজা সুলতানা রত্না। চলচ্চিত্রে অভিনয়ের আগে তাঁর নাম বদলে শাবানা রাখা হয়। ১৯৬৭ সালে পরিচালক এহতেশামের উর্দু ছবি ‘চকোরী’ দিয়ে পর্দায় আগমন। চার দশকে শাবানা অভিনীত ছবির সংখ্যা ৫০০-এর মতো। নায়িকা চরিত্রের বাইরেও ভাবি ও মায়ের চরিত্রে অভিনয় করে নিজের শ্রেষ্ঠত্বের জানান দিতে পারতেন তিনি। শাবানার স্বামীর নাম ওয়াহিদ সাদিক। তিনি একজন চলচ্চিত্র প্রযোজক। তাঁর প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানের নাম ছিল এসএস প্রোডাকশনস। অভিনয়ের জন্য শাবানা ১১ বার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করেন। তাঁর বাবার নাম ফয়েজ চৌধুরী, যিনি একজন টাইপিস্ট ছিলেন এবং মা ফজিলাতুন্নেসা ছিলেন গৃহিণী।
শাবানা অভিনীত সর্বশেষ চলচ্চিত্র ছিল ‘ঘরে ঘরে যুদ্ধ’। পৈতৃক বাড়ি চট্টগ্রামের রাউজান উপজেলার ডাবুয়া গ্রামে হলেও শাবানা জন্মগ্রহণ করেন ঢাকার গেণ্ডারিয়ায়।
ষাটের দশকের শুরুতে ‘নতুন সুর’ ছবিতে শিশুশিল্পী হিসেবে চলচ্চিত্রে অভিষেক ঘটে শাবানার। ১৯৬৭ সালের ‘চকোরী’ ছবিতে তাঁর বিপরীতে অভিনয় করেন নাদিম। এরপর একে একে ‘ভাত দে’, ‘দুই পয়সার আলতা’, ‘রাঙা ভাবি’, ‘মাটির ঘর’সহ অসংখ্য দর্শকনন্দিত চলচ্চিত্র উপহার দেন বাংলা চলচ্চিত্রের এই গুণী শিল্পী।