চলমান অস্থিরতার প্রভাব পড়েছে চলচ্চিত্রশিল্পেও। উদ্ভূত পরিস্থিতির কারণে প্রেক্ষাগৃহগুলোতে যেমন দর্শক-খরা তৈরি হয়েছে, তেমনি এর প্রভাব পড়েছে নতুন সিনেমা মুক্তিতেও। একের পর এক নতুন সিনেমা মুক্তি পিছিয়ে যাচ্ছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ডজনখানেক ছবির মুক্তি পিছিয়েছে।
গত পবিত্র ঈদুল আজহার সময় থেকে বাংলা সিনেমা দেখতে একক হল ও মাল্টিপ্লেক্সগুলোতে দর্শকের জোয়ার তৈরি হয়েছিল। দর্শকের চাপে কোনো কোনো মাল্টিপ্লেক্সে শোর সংখ্যার রেকর্ডও গড়েছে। প্রথমে কোটা সংস্কার আন্দোলন, পরে কারফিউ জারির পর সিনেমা হলে দর্শকের উপস্থিতির চিত্র পাল্টে যায়। থেমে গেছে নতুন নতুন ছবির মুক্তিও। এতে পরবর্তী সময় ছবি মুক্তির একটা জটও লাগতে পারে।
চলচ্চিত্র–সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, বর্তমান পরিস্থিতির কারণে নতুন করে দর্শকের হলমুখী হতে সময় লাগবে। এ অবস্থায় নতুন নতুন ছবি মুক্তি দিয়ে লোকসান গুনতে চাইবেন না প্রযোজকেরা।
ঈদের পরপরই আরিফিন শুভ ও মন্দিরা চক্রবর্তী অভিনীত নীল চক্র সিনেমাটি মুক্তির পরিকল্পনা ছিল। আগস্টে মুক্তির কথা ভাবছিলেন ছবির প্রযোজক। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে দর্শকের কথা মাথায় রেখে আরও এক মাস পিছিয়ে যাচ্ছে ছবিটির মুক্তি।
ছবিটির পরিচালক মিঠু খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘পরিস্থিতির কারণে দেশের সব সেক্টরেই ক্ষতি হয়েছে ও হচ্ছে। সিনেমারও বড় ক্ষতি হলো। এসব ক্ষত মাথায় নিয়ে নিয়মিত দর্শকেরাও এখন হলমুখী হতে চাইবেন না। দর্শক ফিরতে কিছুটা সময় লাগবে। এ জন্য আগামী সেপ্টেম্বরের শুরু বা শেষে মুক্তির পরিকল্পনা করছি।’ তবে মিঠু খান এ-ও বলেন, ‘এত দিনেও যদি প্রেক্ষাগৃহে দর্শকের আগমন স্বাভাবিক না হয়, তাহলে এ বছর আর মুক্তিই দেব না ছবিটি। আগামী বছরের মার্চে মুক্তির কথা ভাবব।’
একইভাবে জংলি ছবিটি সেপ্টেম্বরে মুক্তির কথা ছিল। সেটিও অনির্দিষ্টকালের জন্য পিছিয়ে গেছে। ছবিটির পরিচালক এম রাহিম বলেন, ‘কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে দেশের মানুষের মনে যে ক্ষত তৈরি হয়েছে, এই ক্ষত, এই দুশ্চিন্তা কত দিনে শেষ হবে, তা আমরা জানি না। এ অবস্থার মধ্যে মানুষ সব ভুলে সিনেমা হলমুখী হবেন না। যেটা আমরা বর্তমান হলে থাকা তুফান ও আজব কারখানা ছবি দুটিতে লক্ষ করছি। এ অবস্থার মধ্যে সেপ্টেম্বরে মুক্তির যে চিন্তা করেছিলাম, সেখান থেকে সরে এসেছি।’
এম রাহিম আরও বলেন, ‘সেপ্টেম্বরে মুক্তি দিতে হলে আগস্ট থেকে প্রচারণা চালাতে হবে। কিন্তু মানুষ এ মুহূর্তে এসবের প্রচারণা দেখতে চাইবে না। আপাতত ছবির মুক্তি নিয়ে ভাবছি না। আগে দেশের অবস্থা স্বাভাবিক হোক।’
প্রযোজক ও পরিবেশক প্রতিষ্ঠানের ছবি মুক্তির খাতা থেকে জানা গেছে, গত জুলাই ও আগস্টজুড়ে নন্দিনী, অমানুষ হলো মানুষ, ৫৭০, বান্ধব, কিশোর গ্যাং, বিয়ে আমি করব না, ডাইরেক্ট অ্যাকশন, জিম্মি, যেমন জামাই তেমন বউসহ বেশ কয়েকটি মুক্তির তারিখ পিছিয়ে গেছে। একমাত্র ডাইরেক্ট অ্যাকশন ছাড়া বাকিগুলোর নতুন মুক্তির তারিখ চূড়ান্ত হয়নি।
একের পর এক ছবি মুক্তি পেছানোতে সামনে ‘সিনেমা-জট’ তৈরির আশঙ্কা করেছেন অনেকে। অমানুষ হলো মানুষ, জিম্মি ও যেমন জামাই তেমন বউ ছবি তিনটির পরিচালক মনতাজুর রহমান আকবর।
তিনি প্রথম আলোকে এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘একেবারেই দর্শক কমে গেছে। এমন পরিস্থিতিতে কে হলে সিনেমা দেখতে আসবে? এমন অবস্থায় সিনেমা মুক্তি দিয়ে তো প্রযোজক আত্মাহুতি দেবে না। এখন যেসব সিনেমা মুক্তি পিছিয়ে যাচ্ছে, এসব সিনেমা হয়তো দুই বা তিন মাস পর মুক্তি পাবে। কিন্তু তখন তো অন্য সিনেমা মুক্তিরও পূর্বনির্ধারিত তারিখ আছে। তখন সিনেমা মুক্তির জট তৈরি হবে। প্রতি সপ্তাহেই নতুন সিনেমা মুক্তির হিড়িক পড়বে। এতে খুব ভালো সিনেমা না হলে কোনো ছবিই এক সপ্তাহের বেশি হল পাবে না। প্রযোজকেরা বড় লোকসানের মুখে পড়তে পারেন।’
চলতি বছরের শেষের দিকে ‘সিনেমা-জট’ তৈরি হওয়া ছাড়াও ব্যবসায়িক ক্ষতির আশঙ্কা করছেন প্রযোজক সমিতির জ্যেষ্ঠ সদস্য কামাল মোহাম্মদ কিবরিয়াও। তিনি বলেন, ‘আগামী দিনে ছবি মুক্তির হিড়িক পড়বে। এতে ছবিগুলোর হল থেকে আয় কমে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিতে পারে। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে কিছুই তো করার নেই।’