সংসার সুখের হয় রমণীর গুণে—কথাটি শতভাগ সত্যি নায়করাজ রাজ্জাকের বেলায়। তাঁর স্ত্রী খায়রুন্নেসা লক্ষ্মী প্রথম কোনো পত্রিকার কাছে বললেন তাঁর জীবনের ‘হিরো’ সম্পর্কে। ব্যতিক্রমী এই সাক্ষাৎকার নিয়েছেন কবির বকুল। ২০০৬ সালের ৫ জানুয়ারি ‘আনন্দ’তে ছাপা হয়েছিল সেই সাক্ষাৎকার। আজ ২৩ জানুয়ারি রাজ্জাকের জন্মদিন উপলক্ষে সেই সাক্ষাৎকার পুনঃপ্রকাশ করা হলো।
যত দূর আমরা জানি, আপনারা যখন কলকাতা ছেড়ে এ দেশে আসেন, তখন বাপ্পা একদম ছোট। একটা অনিশ্চয়তা আপনাদের চোখে-মুখে। রাজ্জাক ভাই তখন সাধারণ একজন মানুষ। এরপর রাজ্জাক ভাইয়ের অভিনেতা হিসেবে উত্তরণ এবং নায়করাজ হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাওয়া। জীবনসঙ্গী হিসেবে শুরু থেকেই আপনি তাঁর সঙ্গে ছায়ার মতো ছিলেন, আছেন। নায়করাজ রাজ্জাকের এই উত্তরণ সম্পর্কে আপনার কাছ থেকে কিছু শুনতে চাই।
আমরা কলকাতা থেকে এ দেশে আসি সম্ভবত ’৬৪ সালে। বাপ্পা তখন আট মাসের। আমরা ঢাকায় এসে উঠেছিলাম কমলাপুর ঠাকুরপাড়ায়। নতুন জায়গা, নতুন পরিবেশ। শুরুতে এ জন্য অনেক সমস্যা হয়েছিল। অবশ্য আস্তে আস্তে সব ঠিকও হয়ে যায়। কিছুদিন পর ও আমাকে ঢাকায় রেখে কলকাতা চলে যায়। গিয়েছিল কলকাতায় আমাদের কিছু জমি বিক্রি করতে। তারপর কমলাপুর থেকে আমরা চলে আসি নয়াটোলায়। তখন সে সিনেমায় সবে অভিনয় শুরু করেছে, তা–ও ছোট চরিত্রে। আবদুল জাব্বার খানের ‘আখেরী স্টেশন’ ছবিতে। আমিও মনে-প্রাণে চাইতাম, ও যেন চলচ্চিত্রে প্রতিষ্ঠা পায়। ছবিতে অভিনয় করার আগে ও আমাকে প্রায়ই বলত, চলচ্চিত্রে কাজ করতে গেলে অনেক মেয়ের সঙ্গে মিশতে হবে, অভিনয় করতে হবে, তখন তুমি কিছু মনে করবে না তো? আমি বলেছিলাম, না, কিছুই মনে করব না। তুমি কাজ শুরু করো।’ সে বলল, সংসারের এত ঝামেলা, আমি ব্যস্ত হয়ে গেলে তুমি এসব কীভাবে সামলাবে? আমি বললাম, এসব নিয়ে তুমি কিছু ভেবো না।’
তারপর কত সময় গেল। ও আস্তে আস্তে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। আর আমি বাচ্চা ও ঘরসংসার সামলাতে লাগলাম। অনেকেই তখন আমাকে এসে ওর সম্পর্কে নানা গালগল্প করত, আপনার হিরোকে (ও যখন থেকে ছবির হিরো হলো, তখন থেকে এখন পর্যন্ত আমি ওকে ‘হিরো’ বলেই ডাকি) আজ অমুকের সঙ্গে ওমুক জায়গায় দেখেছি। আর আপনি ঘর সামলাচ্ছেন। এসব কি দেখেন না? আমি ওদের এসব মুখরোচক কথা কখনোই কানে নিতাম না। কারণ, আমার হিরো ছবিতে বিভিন্ন নায়িকার সঙ্গে কাজ করে, সিনেমার নায়ক-নায়িকাদের নিয়ে গুঞ্জন হতেই পারে। যখন ফার্মগেটে হলিক্রসের সামনে আমরা থাকতাম। তখন অনেক মেয়ে বাড়িতে আসত ওর সঙ্গে দেখা করতে, অটোগ্রাফ নিতে। দেখতাম, ভক্তরা ওর কাপড় ছুঁয়ে দেখছে, জুতা ছুঁয়ে দেখছে। তাকে জড়িয়ে ধরছে। দেখতাম, কিন্তু কিছুই বলতাম না। আমি কখনোই তার কোনো কিছুতেই বাধা দিতাম না; বরং তাকে সাহস দিতাম। তারপর স্বাধীনতার আগে নিজেরা গুলশানের এই জায়গা কিনলাম। নিজেদের বাড়িতে (লক্ষ্মীকুঞ্জ) উঠলাম। এখনো এই বাড়িতে আছি।
রাজ্জাক ভাইয়ের সঙ্গে আপনার প্রথম কবে দেখা হয়েছিল?
না, ওইভাবে আমাদের মধ্যে দেখা বা জানাশোনা হয়নি। কলকাতায় টালিগঞ্জে আমরা যে বাড়িতে থাকতাম, ঠিক সেই বাড়ির পাশে ওর এক আত্মীয় থাকতেন। একদিন বাড়ির গেটের সামনে আমি দাঁড়িয়ে ছিলাম, তখন নাকি তাঁদের কেউ আমাকে দেখে ফেলে। তারপরই ও বাড়ি থেকে আমাদের বাড়িতে বিয়ের প্রস্তাব আসে। এরপর তারা আমাকে দেখতে আসে এবং সেদিনই আংটি বদল হয়ে যায়। তখন আমার বয়স ছিল ১২ বছর। তার দুই বছর পর আমাদের বিয়ে হয়।
প্রেক্ষাগৃহে গিয়ে রাজ্জাক অভিনীত প্রথম কোন ছবিটি দেখেন?
আমি ওর অনেক ছবিই হলে গিয়ে দেখেছি। প্রথম দেখেছি ‘আগুন নিয়ে খেলা’। ছবি দেখার সময় কোথাও ভালো না লাগলে সমালোচনাও করতাম। বলতাম, এই জায়গায় তুমি আরও ভালো করতে পারতে। কিন্তু কখনোই তার নায়িকাদের নিয়ে কিছু বলতাম না। মাঝে অবশ্য একবার কবরীকে জড়িয়ে হিরোকে নিয়ে অনেক কথা শুনেছিলাম। পরে শুনি তারা আর একসঙ্গে ছবি করছে না। তখন একদিন আমি জিজ্ঞাসা করেছিলাম, কবরীর সঙ্গে তোমার এমন কী হয়েছে যে একসঙ্গে কাজ করছ না। হিরো তখন বলেছিল, ‘এসবের মধ্যে তোমার আসা দরকার নেই।’ দীর্ঘদিন পর তারা আবার একসঙ্গে কাজ করল। কিন্তু এসব নিয়ে আমি কখনোই তাকে আর কিছু জিজ্ঞেস করিনি।’
আপনার দেখা রাজ্জাক অভিনীত সেরা ছবি কোনটি?
হিরোর অনেক ছবিই আমি দেখেছি। ‘নীল আকাশের নীচে’, ‘আগুন নিয়ে খেলা’, ‘রংবাজ’, ‘মালামতি’, ‘অনন্ত প্রেম’, ‘নাচের পুতুল’, ‘ময়নামতি’ ইত্যাদি। সর্বশেষ ‘বাবা কেন চাকর’ ছবিটা দেখেছিলাম। সব ছবিই দেখে ভালো লেগেছে।
তাঁর কোন দিকটা আপনার কাছে ভালো লাগে?
হিরো যখন সারা দিন খাটাখাটনি করে ঘরে ঢুকেই ‘লক্ষ্মী’ বলে ডাকে, খুব ভালো লাগে। আমি তখন তার পিছু নিই। জিজ্ঞাসা করি নাশতা-টাশতা কিছু খাবে কি না? কখনো রেগে কথা বললেও সে খুবই শান্তভাবে জিজ্ঞাসা করে। এসব ভালো লাগে।
আপনাদের মধ্যে কখনো মান-অভিমান কি হয় না?
না, তেমন খুব একটা হয় না। হয়তো অন্য কোনো কারণে হয়। কিন্তু নিজেদের মধ্যে মান-অভিমান হয় না। এখন ছেলের বউ, নাতি-নাতনিদের নিয়ে আছি। সব মিলে আল্লাহর রহমতে সুখে-শান্তিতে আছি। ছেলে ও ছেলেদের বউরা যথেষ্ট শ্রদ্ধা করে আমাদের।
ছেলেমেয়ের ব্যাপারে রাজ্জাক ভাই কতটুকু ভূমিকা রাখেন?
এই যে সামনে (২৬ জানুয়ারি) আমাদের ছোট ছেলে সম্রাটের বিয়ে। এ সম্পর্কেই বলি। প্রতিদিন ভোরেই ও যায় পার্কে হাঁটতে। দিনকয়েক আগের কথা। বাড়ি এসে হিরো বলল, সে নাকি গুলশান পার্কে হাঁটতে গিয়ে একটি মেয়েকে দেখেছে। ভারি সুন্দর! নিজে হাতে মেয়ের ছবিও তুলে এনেছে। সেই ছবি আমাকে সে দেখাল। ময়মনসিংহের মেয়ে। মামার বাড়ি বেড়াতে এসেছে। হিরোর ইচ্ছা, মেয়েটিকে সম্রাটের বউ করবে। তারপর মিষ্টি নিয়ে গেলাম মেয়ের মামার বাড়ি। আমারও পছন্দ হলো। তবে এ বাড়িতে একটা রেওয়াজ আছে, হিরোর পছন্দ মানে আমাদের পছন্দ; যদিও বড় ছেলে বাপ্পা আর মেজ ছেলে বাপ্পী নিজেরাই পছন্দ করে বিয়ে করেছে। শুধু ছোট ছেলের বিয়েটাই সে পছন্দ করে দিচ্ছে। হিরো এতে খুবই খুশি।
বাইরের লোকজন রাজ্জাক ভাইয়ের সঙ্গে আপনাকে কোথাও তেমন একটা দেখেননি। কারণ কী?
সে আমাকে বাইরে নিয়ে যেতে চায়, কিন্তু আমিই যাই না। আমার ভালো লাগে না। তার ওপর এমনিতেই আমি বাড়ির বাইরে খুব একটা যাই না। ঘরে থাকতেই পছন্দ করি। আত্মীয়স্বজনের বাড়িতেও তেমন যাই না। কলকাতায় বাবার বাড়ি। সেখানেও নিয়মিত যাওয়া হয় না। কয়েক বছর পরপর যাই। একসময় ওর সঙ্গে মার্কেটে যেতাম, তখন ওর জনপ্রিয়তা তুঙ্গে। মার্কেটে গেলে দেখতাম ওর অসংখ্য ভক্ত ওকে ঘিরে ধরেছে। আমি ছেলেমেয়ে নিয়ে তখন দীর্ঘ সময় দূরে দাঁড়িয়ে থাকতাম। তখন ছেলেমেয়েরা প্রায়ই বলত, আব্বুর সঙ্গে আর মার্কেটে যাব না। আগেও যেমন হিরোকে ভক্তরা ঘিরে ধরত, এখনো দেখি তেমনই সবাই ঘিরে ধরে।
সাদা-কালো ছবিতে রাজ্জাক, তারপর রঙিন রাজ্জাক। বাস্তবের রাজ্জাককে আপনার কাছে কেমন মনে হয়ে?
সে খুবই ভালো।
রাগ কেমন?
রাগ তেমন নেই। তবে ইদানীং ছেলেদের ওপরে রাগটা একটু চড়ে। ছেলেরা যখন না বলে বাসা থেকে বের হয়, তখন রেগে যায়। আমি অবশ্য তখন বোঝাই যে ওরা বড় হয়েছে। এখন কি সব সময় তোমাকে বলে যেতে হবে? তখন ঠান্ডা হয়।
রাজ্জাক ভাই কী ধরনের খাবার খেতে পছন্দ করেন?
আমার হাতের গুঁড়ো মাছ, করল্লা, গরুর ভুনা মাংস খেতে পছন্দ করে।
রাজ্জাক ভাইয়ের প্রিয় কোনো সংলাপ আছে কি না।
না, তেমন কোনো সংলাপ নেই, তবে ‘সন্তানদের মানুষ করতে হবে। তাদের বিয়ে দিতে হবে। আমরা তো বুড়ো হয়ে গেলাম। এখন ছোট ছেলের বিয়ে দিলেই আমাদের কর্তব্য শেষ হয়ে যাবে।’ এসব কথাই তার মুখে বেশি শুনি।
আপনাদের এই বাড়ির নাম ‘লক্ষ্মীকুঞ্জ’, মার্কেটের নাম ‘রাজলক্ষ্মী কমপ্লেক্স’, প্রোডাকশনের নামও ‘রাজলক্ষ্মী প্রোডাকশন’—এই নামগুলো তিনি কি কখনো আপনার সঙ্গে পরামর্শ করে দিয়েছেন?
আসলে এই বাড়ি যখন ও করে, তখন অনেক নাম ঠিক করা হয়েছিল। লটারির মাধ্যমে লক্ষ্মীকুঞ্জ নামটা চূড়ান্ত হয়। এ প্রসঙ্গে একটা তথ্য জানিয়ে দিতে চাই। অনেকেই আমাকে হিন্দু মনে করেন। আমার পুরো নাম খায়রুন্নেসা। আমার আব্বা আমাকে আদর করে ডাকতেন ‘লক্ষ্মী’। শুনেছি, আমি যখন জন্মেছিলাম, তখন নাকি বাবার অনেক উন্নতি হয়েছিল।
পর্দায় তো রাজ্জাক ভাই অনেক সংলাপই আওড়ান। সেই সংলাপ কি আপনাকেও কখনো ঘরে বসে শুনতে হয়?
(হেসে বলেন) ইয়ার্কি মেরে মাঝেসাজে বলে। এসব কি আর এখন বলা যায়!