১৩ বছর বয়সে ‘আম–কাঁঠালের ছুটি’ সিনেমায় ‘মইন্না’ চরিত্রে অভিনয় করে পরিচিতি পান লিয়ন আহমেদ
১৩ বছর বয়সে ‘আম–কাঁঠালের ছুটি’ সিনেমায় ‘মইন্না’ চরিত্রে অভিনয় করে পরিচিতি পান লিয়ন আহমেদ

লিয়নের জীবনই এক সিনেমা

‘আম–কাঁঠালের ছুটি’ সিনেমায় অভিনয়ের জন্য ‘মেরিল–প্রথম আলো পুরস্কার ২০২৩’ পান লিয়ন আহমেদ।

টানাটানির সংসারের হাল ধরতে গাজীপুরের বোর্ডবাজারে আসেন। ভেবেছিলেন পোশাক কারখানায় কাজ পাবেন। তবে জাতীয় পরিচয়পত্র না থাকায় কাজ মেলেনি। কারখানার ফটক থেকে ফিরে আসেন লিয়ন আহমেদ।

ছোট কাঁধে বড় দায়িত্ব নিয়ে এসেছেন ময়মনসিংহের চরপাড়ার ছেলে লিয়ন। বোর্ডবাজারেই থেকে গেছেন। ঘুরতে ঘুরতে রাজমিস্ত্রির জোগালির কাজ জুটিয়ে ফেলেছেন।

লিয়নের বাবা আবদুল খলিলও পেশায় রাজমিস্ত্রি। ‘হেড মিস্ত্রি’ বাবার কাছেই জোগালির পাঠ পেয়েছেন। কংক্রিট মিক্সার মেশিনে কতটুকু পাথর ও সিমেন্টের সঙ্গে কতটুকু বালু ঢালতে হবে, সেই সূত্র রপ্ত করে ফেলেছেন।

রাজমিস্ত্রির জোগালির কাজে লিয়ন আহমেদ। গাজীপুরের বোর্ডবাজারে

লিয়নের বয়স আর কতই হবে, বড়জোর ২১। বছরখানেক ধরে বোর্ডবাজারে জোগালির কাজ করছেন। তিনি এখনো হেড মিস্ত্রি হতে পারেননি। উদয়াস্ত মাথার ঘাম পায়ে ফেলে সিমেন্টের বস্তা টানেন তিনি। কড়াইভর্তি পাথর ও সিমেন্টের মিশ্রণ (মিক্সার), ইট মাথায় নিয়ে সিঁড়ি ভেঙে তিন–চারতলায় ওঠেন। কোনো মাসে ১০ দিন, কোনো মাসে আবার ১৫ দিন কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করছেন। মেসে গাদাগাদি করে থাকেন। নিজের থাকা-খাওয়ার খরচ মিটিয়ে বাকি টাকা বাড়িতে পাঠান।

কাজের ফাঁকে মাসখানেক আগে একটি ফোনকল পান তিনি। ফোনের অপর প্রান্ত থেকে বলা হয়, ‘আম–কাঁঠালের ছুটি’ সিনেমায় অভিনয়ের জন্য আপনি মেরিল–প্রথম আলো পুরস্কার ২০২৩ –এ মনোনয়ন পেয়েছেন।

প্রায় আট বছর আগে সিনেমাটিতে অভিনয় করেছিলেন লিয়ন। জীবনের নানান চড়াই–উতরাইয়ে ছবিটির কথা প্রায় ভুলেই গিয়েছিলেন। ফোনকলটা তাঁকে একলহমায় অভিনয়জীবনের স্মৃতিতে ফেরাল।

প্রায় আট বছর আগে সিনেমাটিতে অভিনয় করেছিলেন লিয়ন। জীবনের নানান চড়াই–উতরাইয়ে ছবিটির কথা প্রায় ভুলেই গিয়েছিলেন। ফোনকলটা তাঁকে একলহমায় অভিনয়জীবনের স্মৃতিতে ফেরাল।

তখন মা–বাবার সঙ্গে টঙ্গীর পাগাড় এলাকায় থাকতেন লিয়ন। ২০১৬ সালে নির্মাতা মোহাম্মদ নূরুজ্জামানের ‘আম-কাঁঠালের ছুটি’ চলচ্চিত্রের মূল চরিত্রে অভিনয়ের সুযোগ পেয়েছিলেন তিনি। এতে ডানপিটে কিশোর ‘মইন্না’ চরিত্রে অভিনয় করে দর্শকদের হৃদয়ে জায়গা করে নেন তিনি।

১৩ বছর বয়সে জীবনের প্রথম সিনেমায় অভিনয়ের জন্য মেরিল-প্রথম আলো পুরস্কারের সমালোচক পুরস্কার শাখায় চলচ্চিত্র ও ওয়েব চলচ্চিত্র বিভাগে সেরা অভিনেতা হিসেবে মনোনয়ন পেয়েছেন লিয়ন।

মইন্নাকে প্রায় ভুলে গেলেও মইন্না লিয়নকে ভোলেনি। মইন্না চরিত্রে প্রাণ দিয়ে প্রদীপের আলোয় এলেন লিয়ন। জীবনে কখনো সিনেমায় অভিনয়ের কথাই ভাবেননি; সেখানে পুরস্কার পাওয়ার কথা ছিল কল্পনার অতীত।

গত ২৪ মে ঢাকার ইউনাইটেড কনভেনশন সেন্টারের দ্য গ্রেস মিলনায়তনে আয়োজিত মেরিল-প্রথম আলো পুরস্কার–২০২৩–এ হাজির হয়েছিলেন তিনি। তবে তখনো জানতেন না, তাঁর জন্য কী অপেক্ষা করছে। শহীদুজ্জামান সেলিম ও নাসির উদ্দিন খানের মতো শিল্পীদের পেছনে ফেলে বিচারকদের রায়ে সেরা অভিনেতার পুরস্কার পেয়েছেন লিয়ন। মিলনায়তনভর্তি দর্শক মুহুর্মুহু করতালিতে অভিবাদন জানান এই শিল্পীকে। তাঁর হাতে পুরস্কার তুলে দেন রুবানা হক।

লিয়নের হাতে পুরস্কার তুলে দেন রুবানা হক

এ সময় উপস্থাপক হানিফ সংকেত বলেন, ‘আমাদের দেশে অনেকে আছেন, যাঁরা পুরস্কার পাওয়ার জন্য লবিং করেন, কেউ আবার লবিস্টও নিয়োগ করেন। আবার কেউ কেউ আছেন যাঁদের পুরস্কারই খুঁজে বেড়ায়। লিয়ন আহমেদ মাটি থেকে উঠে আসা একজন শিল্পী; তাঁকে পুরস্কারই খুঁজে পেয়েছে। গাজীপুরের বোর্ডবাজার এলাকায় তিনি নির্মাণশ্রমিক হিসেবে কাজ করছিলেন।

স্বপ্নের কথা জানতে চাইলে লিয়ন জানান, মানুষের জন্য কিছু করার স্বপ্ন দেখেন তিনি।

যেভাবে সিনেমায় এলেন

ময়মনসিংহ শহরের চরপাড়া থেকে মা–বাবার সঙ্গে শৈশবে গাজীপুরের টঙ্গীর পাগাড় এলাকায় চলে আসেন লিয়ন। বাবা আবদুল খলিল পেশায় রাজমিস্ত্রি; মা মোসাম্মৎ লিলি পোশাক কারখানায় কাজ করতেন। নিজের শৈশব পেরোনোর আগেই ছোট ভাইকে দিনভর দেখাশোনার দায়িত্ব লিয়নের কাঁধে আসে।

নিজের শৈশব পেরোনোর আগেই ছোট ভাইকে দিনভর দেখাশোনার দায়িত্ব লিয়নের কাঁধে আসে। দায়িত্বের ভারে লিয়নের পড়াশোনা হয়নি।

দায়িত্বের ভারে লিয়নের পড়াশোনা হয়নি। ২০১৪ সালে বাড়ির পাশে একটি নৈশ বিদ্যালয় করেন ‘আদিম’ সিনেমার পরিচালক যুবরাজ শামীম। কাজ শেষে মা–বাবা বাড়িতে ফিরলে রাতে বই–খাতা নিয়ে স্কুলে যেতেন লিয়ন; তবে দ্বিতীয় শ্রেণির বেশি পড়াশোনা করতে পারেননি।

এর মধ্যে নির্মাতা মোহাম্মদ নূরুজ্জামান ‘আম-কাঁঠালের ছুটি’ সিনেমার মইন্না চরিত্রের জন্য শিশু শিল্পী খুঁজছেন। এই চরিত্রে দুজনকে ভাবা হয়েছিল, একজনকে নিয়ে শুটিংও শুরু হয়েছিল। তবে শেষ পর্যন্ত তাঁদের নিয়ে কাজটা আর হয়নি। ছবির প্রধান সহকারী পরিচালক ও কাস্টিং ডিরেক্টর যুবরাজ শামীমের মাধ্যমে ‘আম–কাঁঠালের ছুটি’ সিনেমায় অভিনয়ের সুযোগ পান লিয়ন। জীবনে প্রথমবার ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে খুব ভয় পেয়েছিলেন, জড়তাও ছিল তাঁর। ধীরে ধীরে জড়তা ও ভয় দুই-ই জয় করেন তিনি।

‘আম কাঁঠালের ছুটি’ সিনেমার দৃশ্যে লিয়ন; চার বছর ধরে খোঁজ ছিল না তাঁর

২০১৭ সালের জানুয়ারিতে ছবির শুটিং শেষ হয়। ২০১৮ সালে ডাবিংয়ের কাজে হাত দেন পরিচালক। ডাবিং করতে নারায়ণগঞ্জে এসেছিলেন লিয়ন। তবে বয়ঃসন্ধিকালে কণ্ঠস্বর বদলে যাওয়ায় লিয়নের ডাবিং আরেকজনকে দিয়ে করানো হয়।

এরই মধ্যে অভাবের সংসারে ঋণের জালে আটকা পড়েছিলেন মা–বাবা। ২০১৯ সালের শেষ দিকে প্রায় দেউলিয়া অবস্থায় লিয়নের পরিবার টঙ্গী ছেড়ে চলে যায়। ২০২০ সালে লিয়নের সঙ্গে শেষবারের মতো কথা হয়েছিল পরিচালকের। এরপর তাঁর কোনো হদিস পাননি পরিচালক মোহাম্মদ নূরুজ্জামান।

আম-কাঁঠালের ছুটির কাজ শেষ হওয়ার পরপরই যুবরাজ শামীমের স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র কনট্রাস্ট-এর মূল চরিত্রে অভিনয় করেন লিয়ন। এর বাইরে আর কোনো কাজ করেননি তিনি।

পুরস্কার হাতে লিয়ন আহমেদ। ঢাকার ইউনাইটেড কনভেনশন সেন্টারে গত ২৪ মে

পুরস্কারই তাঁকে খুঁজে নিয়েছে

২০২৩ সালের ১৮ আগস্ট মুক্তি পায় ‘আম–কাঁঠালের ছুটি’। ছবির প্রিমিয়ারে বাকি শিল্পীরা উপস্থিত থাকলেও ছিলেন না শুধু লিয়ন। তখন পরিচালক বলছিলেন, অনেক খোঁজাখুঁজি করেও সন্ধান পাননি তাঁর।

এ বছর মেরিল-প্রথম আলো পুরস্কারে লিয়নের মনোনয়নের খবরটি পরিচালক মোহাম্মদ নূরুজ্জামানকে অবহিত করা হয়। মনোনয়নের খবরে লিয়নকে হন্যে হয়ে খুঁজতে থাকেন পরিচালক। লিয়নের পরিবারের ব্যবহৃত মুঠোফোন নম্বরটি কয়েক বছর ধরেই অচল, ঠিকানাও জানা নেই। লিয়নের সন্ধান চেয়ে ফেসবুকে পোস্টও করেন তিনি।

লিয়নের পুরোনো বন্ধুদের কাছে খোঁজ করছিলেন টঙ্গীর বাসিন্দা যুবরাজ শামীম। এর মধ্যে পরিচালক নূরুজ্জামানের ফেসবুক পোস্টটি লিয়নের এক ফুফুর নজরে আসে। ফুফু লিয়নের মা লিলিকে জানান। মায়ের কাছ থেকে খবর পেয়ে যুবরাজ শামীমের সঙ্গে যোগাযোগ করেন লিয়ন।

সিনেমার শুটিংয়ের ফাঁকে লিয়ন

লিয়নের সঙ্গে ফোনে কথা বলেন পরিচালক মোহাম্মদ নূরুজ্জামান। তাঁর সঙ্গে দেখা করতে বোর্ডবাজারে ছুটে যান তিনি। প্রায় চার বছর পর লিয়নের দেখা মেলে। চার বছর কোথায় ছিলেন? এমন প্রশ্নের জবাবে লিয়ন জানান, টঙ্গী থেকে পরিবারের সঙ্গে ময়মনসিংহের চরপাড়ার বাড়িতে চলে যান। বছর তিনেক চরপাড়ায় ছিলেন। এরপর ২০২৩ সালে গাজীপুরের বোর্ডবাজারে এসেছেন।

বোর্ডবাজার থেকেই মেরিল–প্রথম আলো পুরস্কারের মঞ্চে এসেছিলেন লিয়ন। তিনি বলেন, ‘এত মানুষের ভালোবাসা পেয়েছি, আমি খুবই কৃতজ্ঞ। আমার খুবই ভালো লাগছে। আমার জন্য জামান মামা (মোহাম্মদ নূরুজ্জামান) ও শামীম মামা (যুবরাজ শামীম) অনেক কষ্ট করেছেন।’

মোহাম্মদ নূরুজ্জামান বলেন, ‘লিয়নের পুরস্কার প্রাপ্তি খুব ভালো লাগছে।’

সেরা অভিনেতা ছাড়াও সমালোচক শাখায় সেরা চলচ্চিত্রের পুরস্কার পেয়েছে ‘আম–কাঁঠালের ছুটি’; সেরা পরিচালকের পুরস্কার পেয়েছেন মোহাম্মদ নূরুজ্জামান।

লিয়নের সঙ্গে পরিচালক মোহাম্মদ নূরুজ্জামান

পড়াশোনা করতে চান লিয়ন

মেরিল–প্রথম আলো পুরস্কারের মঞ্চ থেকে পুরস্কার নিয়ে বোর্ডবাজারে জোগালির কাজে ফিরেছেন লিয়ন। পাশাপাশি পড়াশোনাও করতে চান তিনি।

‘বন্ধুরা আমাকে ইংরেজি ও বাংলায় মেসেজ করে, আমি পড়তে পারি না বলে খুব খারাপ লাগে।’—প্রথম আলোকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলছিলেন লিয়ন। টঙ্গীর নৈশ বিদ্যালয়ে দ্বিতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছেন। আগে একটু–আধটু বাংলা পড়তে পারতেন, দীর্ঘদিন পড়াশোনার বাইরে থাকায় এখন আর পড়তে পারেন না বলে জানান তিনি।

ঈদুল আজহার পর বোর্ডবাজার থেকে টঙ্গীতে ফিরবেন লিয়ন। তাঁর পড়াশোনার ব্যাপারে উদ্যোগী হয়েছেন পরিচালক মোহাম্মদ নূরুজ্জামান ও যুবরাজ শামীম। আপাতত কাজের পাশাপাশি নৈশ বিদ্যালয়ে পড়বেন তিনি।