শাকিব খান অভিনীত ‘দরদ’ ছবি দিয়ে যখন আবার বাজার চাঙা হওয়ার আশা প্রযোজক, হলমালিকদের; তখনই এল সিনেমাটি পাইরেসির খবর। গত কয়েক বছরে বড় বাজেটের আরও বেশি কয়েকটি সিনেমার পাইরেসির খবর পাওয়া গেছে। সিনেমা পাইরেসির কবলে পড়াটা ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’ মনে করছেন পরিচালক রায়হান রাফী। এই নির্মাতার সিনেমা ‘সুড়ঙ্গ’ ও ‘তুফান’ পাইরেসি হয়েছিল; তখন এ নিয়ে আইনানুগ ব্যবস্থাও নিয়েছিল ছবির প্রযোজনা সংস্থা।
প্রযোজক যদি সিনেমা বানিয়ে আর্থিকভাবে লাভবান না হন, তাহলে তিনি তো সিনেমা বানাবেন না। পাইরেসি আমাদের সিনেমাকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিয়েছিল। যখন সব ঠিক হচ্ছিল, সিনেমা আবার বেড়ে উঠছিল, তখন এভাবে পাইরেসি হানা দিয়েছে! যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এটা বন্ধ করতে হবে।রায়হান রাফী
গতকাল থেকে নতুন করে সংযুক্ত আরব আমিরাত, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা ও নিউজিল্যান্ডে মুক্তি পেয়েছে দরদ। মুক্তির দ্বিতীয় সপ্তাহ চলছে যুক্তরাষ্ট্রে। ২৯ নভেম্বর থেকে ছবিটি ভারতে মুক্তি পাবে—এর মধ্যে পাইরেসির খবর অশনিসংকেত বলে মনে করছেন সিনেমাটির নির্মাতা ও প্রযোজক। পরিচালক অনন্য মামুন জানালেন, তিনি অন্তর্জালে ছড়িয়ে পড়া ‘দরদ’-এর সব কপি সরাতে পেরেছেন। গতকাল বিকেল পর্যন্ত ২২ হাজার ৩৩ আইডি থেকে পাইরেসি হওয়া সিনেমাটি সরানো গেছে।
এক দশক আগের তুলনায় সিনেমা মুক্তি অর্ধেকে নেমে এসেছে। কমে এসেছে প্রেক্ষাগৃহের সংখ্যা। এখন বছরে ৫০টি বা তার কমসংখ্যক সিনেমা মুক্তি পায়। আলোচনায় থাকে হাতে গোনা কয়েকটি। বড় বাজেট ও বড় তারকার এসব ছবির ব্যবসায়িক সফলতায় আশায় বুক বাঁধেন প্রযোজক, পরিচালক ও হলমালিকেরাও।
পাঁচ মাস আগে মুক্তি পাওয়া আলোচিত সিনেমা ‘তুফান’ পাইরেসির কবলে পড়ে। ওটিটি প্ল্যাটফর্ম হইচই ও চরকিতে মুক্তির তিন দিনের মাথায় দ্বিতীয়বার পাইরেসি হয় সিনেমাটির। এর আগে ‘রাজকুমার’, ‘সুড়ঙ্গ’, ‘হাওয়া’, ‘হুব্বা’সহ কয়েকটি চলচ্চিত্র পাইরেসি হয়। সাধারণত যেসব সিনেমা নিয়ে দর্শকের আগ্রহ থাকে, সেগুলোর পাইরেসি হয়। রায়হান রাফী ‘দরদ’-এর পাইরেসির খবর শুনে মর্মাহত।
গতকাল বিকেলে মুঠোফোনে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের সিনেমার অবস্থা এমনিতে খুব একটা ভালো নয়। যে সিনেমাগুলো ব্যবসাসফল হতে থাকে, ভালো চলছে—এসব যদি পাইরেসি হয়, তা অনেক ক্ষতি।’
‘তুফান’ ও ‘সুড়ঙ্গ’–এর প্রসঙ্গ টেনে রাফী আরও বললেন, ‘এই দুটি ছবি মুক্তির সময় আওয়াজ উঠছিল, ভারতে পাইরেসি হয়েছে। দরদ ভারতে তো মুক্তি দেওয়া হয়নি, তাহলে পাইরেসি কোথায় হলো? খতিয়ে দেখা উচিত। মুঠোফোন, ক্যামেরায় ভিডিও করে ইউটিউব বা ফেসবুকে যেভাবে সিনেমা ছড়িয়ে দেওয়া হয়, প্রেক্ষাগৃহের মালিকের তা বের করা উচিত। নইলে আমাদের ইন্ডাস্ট্রির অবস্থা আরও খারাপের দিকে যাবে। প্রযোজক যদি সিনেমা বানিয়ে আর্থিকভাবে লাভবান না হন, তাহলে তিনি তো সিনেমা বানাবেন না। পাইরেসি আমাদের সিনেমাকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিয়েছিল। যখন সব ঠিক হচ্ছিল, সিনেমা আবার বেড়ে উঠছিল, তখন এভাবে পাইরেসি হানা দিয়েছে! যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এটা বন্ধ করতে হবে।’
পাইরেসি যেহেতু প্রেক্ষাগৃহ থেকে হয়, তাই সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে সতর্ক থাকা উচিত মনে করেন রাফী। এমনকি দায়ভারও নিতে হবে জানিয়ে বললেন, ‘প্রেক্ষাগৃহ কর্তৃপক্ষকে সার্বক্ষণিক সতর্ক থাকতে হবে, কেউ ফোন দিয়ে ভিডিও করছে কি না। ঢোকার সময় চেক করতে হবে, গোপন ক্যামেরা নিয়ে কেউ ঢুকছে কি না।’
দীর্ঘদিন পর উৎসব ছাড়া বড় বাজেটে ও দেশের সবচেয়ে বড় তারকার সিনেমা মুক্তি পেয়েছে উল্লেখ করে রাফী বললেন, ‘ঈদ ছাড়া মুক্তি পাওয়া ছবি যদি এভাবে পাইরেসি হয়ে যায়, তাহলে দর্শকের আগ্রহ কমে যায়। অনেকে ভাবেন পাইরেসি কপিটা দেখবেন। আমার অনুরোধ, যদি আপনারা সিনেমাপ্রেমী হন, পাইরেসি কপি দেখবেন না। এটা দেখা অন্যায়, দণ্ডনীয়। কেউ লিংকও শেয়ার করবেন না। যিনি শেয়ার করবেন, তিনিও আইনের আওতায় পড়বেন।’
যুক্তরাষ্ট্র থেকে দরদ পাইরেসি হয়েছে বলে জানালেন পরিচালক ও প্রযোজক অনন্য মামুন। কারণ, অন্তর্জালে দরদ-এর যেসব সংস্করণ পাওয়া গেছে, সব কটিতেই ইংরেজি সাবটাইটেল ছিল। তিনি বললেন, ‘সিনেমা এভাবে পাইরেসি হওয়া শুধু আমার একার জন্য নয়, পুরো ইন্ডাস্ট্রির জন্য কষ্টের। উৎসব ছাড়া এবং বিশ্বব্যাপী মুক্তি দিয়ে এমনটা হলো! পরে হয়তো কেউ আর বিশ্বব্যাপী মুক্তির সাহস পাবে না। কথা হচ্ছে, দেশ কিংবা দেশের বাইরে যেখান থেকেই হোক, পাইরেসি থেকে ছবিকে সুরক্ষিত রাখার দায়িত্ব আমাদের সবার। কারণ, এভাবে পাইরেসি হওয়া আমাদের এগিয়ে যাওয়া থামিয়ে দেবে। চলচ্চিত্র আমাদের আপকামিং গ্রোয়িং মার্কেট, পাইরেসি সেখানে বড় বাধা।’
দরদ সিনেমাটি যুক্তরাষ্ট্রে পরিবেশনার দায়িত্বে আছে বায়োস্কোপ ফিল্মস। প্রতিষ্ঠানটির কর্ণধার রাজ হামিদ গতকাল প্রথম আলোকে জানান, নিউইয়র্ক থেকে দরদ-এর পাইরেসি হয়েছে, খবরটি তিনিও শুনেছেন। হলমালিকদের সঙ্গে কথা বলে এ বিষয়ে পদক্ষেপ নেবেন বলেও তিনি জানান। রাজ হামিদ বলেন, ‘কাজটা কে বা কারা করেছে, সেটা বের করতে হবে। তাঁদের পরিচয় প্রকাশ্যে এলে অন্যরাও সতর্ক হয়ে যাবে। আমরা এ পর্যন্ত ৪৮টি ছবি উত্তর আমেরিকায় এনেছি। এ ধরনের কোনো সমস্যার মুখোমুখি হইনি। আমরা প্রযোজনা সংস্থার কাছ থেকে আরও তথ্য চেয়েছি। সাত বছরের চেষ্টায় বিদেশে বাংলা ছবির বাজার তৈরি করেছি। যেকোনো মূল্যে এটা রক্ষা করব।’
পাইরেসির পেছনে একটা শক্তিশালী চক্র কাজ করছে বলেও মনে করছেন অনন্য মামুন। উদাহরণ হিসেবে বললেন, ‘আমাদের ছবিটি পাইরেসি যে ধরনের হয়েছে, তাতে বুঝেছি, সাধারণ কোনো মানুষ করেনি, বড় চক্রই জড়িত। তারা এটা জানে, শাকিব খানের একটা ছবি ব্যাপক আলোচনা তৈরি করে। সামান্য কিছু টাকার জন্য এরা ইন্ডাস্ট্রিকে নষ্ট করতে চায়। এদের চিহ্নিত করার ক্ষেত্রে আমাদের দেশে সেই প্রযুক্তি আছে কি না, জানি না, তবে তাদের সবার বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়া উচিত।’
মধুমিতা প্রেক্ষাগৃহের স্বত্বাধিকারী ইফতেখার উদ্দিন নওশাদও মনে করেন, পাইরেসি হল থেকেই হয় এবং এর পেছনে বড় একটা চক্র আছে। প্রেক্ষাগৃহ কর্তৃপক্ষকে আরও বেশি সতর্ক থাকার আহ্বানও জানিয়েছেন তিনি। বললেন, ‘আমাদের প্রেক্ষাগৃহে যেকোনো ধরনের ব্যাগ নিয়ে ঢোকা নিষেধ। দেশের বাইরে যখন সিনেমা দেওয়া হবে, কর্তৃপক্ষকেও পাইরেসির বিষয়ে সতর্ক করতে হবে। পাইরেসিতে অনেক বড় ক্ষতি হয়। পাইরেসি যদি হয়, আমাদের হলেও তো লোক আসবে না। দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি একবার নেওয়া গেলে এসব বন্ধ হয়ে যাবে।’