আলাপটা আগেও ছিল। তবে ঘরোয়া আসরে। বছর দুই হলো আলোচনাটা প্রকাশ্যে এসেছে, এখন তো বড় তারকাকে সামনে পেলে অবধারিতভাবেই করা হয় প্রশ্নটা, ‘ঈদ ছাড়া কি আপনার সিনেমা আসবে না?’ দেশি সিনেমার হালহকিকত বুঝতে এর চেয়ে মোক্ষম প্রশ্ন আর কি আছে?
২০২২ সালে পবিত্র ঈদুল আজহা এবং পরপরই আসে দুই সিনেমা—‘পরাণ’ ও ‘হাওয়া’। পরের বছরগুলোয় আসে ‘প্রিয়তমা’, ‘সুড়ঙ্গ’, ‘রাজকুমার’, ‘কাজলরেখা’, ‘তুফান’। ঈদের মতো বড় উৎসবে তারকাবহুল একাধিক সিনেমা মুক্তি পাবে এ আর আশ্চর্য কী! কিন্তু মোটাদাগে বড় সিনেমাগুলো যদি কেবল ঈদেই আসে, পুরো ইন্ডাস্ট্রির সুস্থ-স্বাভাবিক বিকাশের জন্য কি সেটা ভালো?
গত মাসেই দুর্গাপূজা উপলক্ষে পশ্চিমবঙ্গে মুক্তি পেয়েছে তিনটি সিনেমা: ‘টেক্কা’, ‘বহুরূপী’, ‘শাস্ত্রী’। তিন সিনেমাই কমবেশি ব্যবসা করেছে। তবে শিকড়ের গল্প, দুর্দান্ত অভিনয় আর টান টান নির্মাণ মিলিয়ে বাজিমাত করেছে শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় ও নন্দিতা রায়ের ‘বহুরূপী’। ১০ কোটি রুপির বেশি ব্যবসা করেছে ছবিটি! সামনে বড়দিন, ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে দীর্ঘ ছুটিতে কলকাতার মিঠুন অভিনীত ‘সন্তান’, দেব অভিনীত ‘খাদান’-এর মুক্তি চূড়ান্ত। আর ‘বেবি জন’, ‘পুষ্পা ২’-এর মতো হিন্দি যে আসবে; সেটা তো অনেক আগেই জানা গেছে।
ডিসেম্বর আমাদের দেশেও ছুটির মৌসুম। স্কুল-কলেজের পরীক্ষা শেষ হলে ঘোরাঘুরির নানা লোভনীয় প্যাকেজ ঘোষণা করেন ট্যুর অপারেটররা। কিন্তু এই ছুটির মৌসুমকে কাজে লাগানোর কথা কি ভেবেছেন প্রযোজকেরা? বলিউড তারকা অক্ষয় কুমারের ক্যারিয়ার গ্রাফ অনুসরণ করলেই বোঝা যাবে কীভাবে উৎসবকে কেন্দ্র করে বছরে চারটি করে সুপারহিট ছবি দিয়েছেন এই তারকা। প্রতিবছর ভারতের প্রজাতন্ত্র দিবস ২৬ জানুয়ারিতে সিনেমা মুক্তি দিতেন তিনি, আর মুক্তির জন্য বেছে নেওয়া হতো এমন ছবি, যাতে দেশপ্রেমের বার্তা আছে। সেগুলোর বেশির ভাগই বক্স অফিসে সাফল্য পেয়েছে।
একইভাবে হলিউডের কথাও বলা যায়। পশ্চিমে বড় বাজেটের বেশির ভাগ ছবিই আসে গ্রীষ্মে। এর মধ্যেই যেমন ২০২৫ সালের মে, জুন ও জুলাইতে মুক্তির জন্য ‘থান্ডারবোল্টস’, ‘মিশন: ইমপসিবল’-এর নতুন কিস্তি, ‘ক্যারাটে কিড: লিজেন্ডস’, ‘ব্যালেরিনা’, ‘জুরাসিক ওয়ার্ল্ড রিবার্থ’, ‘সুপারম্যান’ ইত্যাদি সিনেমা চূড়ান্ত হয়ে আছে।
বাংলা ছবির খবর কী? অনেকেই হয়তো রায়হান রাফীর লায়নসহ কয়েকটি ছবির নাম বলবেন। যেগুলোর সবই ঈদের ছবি। অথচ আমাদেরও উপলক্ষের অভাব নেই। বাংলা নববর্ষ, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস—এ রকম উৎসব ধরে বাংলা সিনেমার ক্যালেন্ডার তৈরির কথা কি কেউ ভেবেছেন?
অন্য দেশগুলোয় বিভিন্ন উৎসবের সিনেমাগুলো অনেক আগেই চূড়ান্ত হয়। পোস্টার, টিজার, ট্রেলার ধরে প্রচারও চলে অনেক আগে থেকে। সিনেমা নিয়ে ধীরে ধীরে দর্শকের আগ্রহ তৈরি হয়। কিন্তু ঈদ ছাড়া অন্য উৎসবগুলো ধরে দেশি সিনেমার তেমন কোনো পরিকল্পনাই দেখা যায় না।
অন্য সময়ের সিনেমা মুক্তি নিয়ে আরেক মুশকিল বাণিজ্যিক সিনেমার নির্মাতার অভাব। গত কয়েক বছরে কেবল রায়হান রাফী, হিমেল আশরাফদের মতো হাতে গোনা দু-একজন নির্মাতার সিনেমা আলোচনায় এসেছে। রাফী নতুন বেশ কয়েকটি সিনেমার কাজ করছেন, হিমেল আছেন বিরতিতে।
কিন্তু এক রাফী আর কত সিনেমা করবেন। এই সময়ের দর্শকের চাহিদা বুঝে বুদ্ধিদীপ্ত বাণিজ্যিক সিনেমা বানানোর মতো আরও নির্মাতার অপেক্ষায় ঢাকাই সিনেমা।
দেশের চলমান অবস্থার কারণে অনেক দিন নতুন সিনেমা মুক্তি পায়নি। পরে যেগুলো এসেছে, নানা কারণে সেগুলোও সেভাবে আলোচনায় আসতে পারেনি।
ঈদের যে দর্শকেরা এত ভিড় করেন, তাঁরা তাহলে গেলেন কোথায়? ঈদ উৎসবে যেমন নতুন দর্শক আসেন, এটা যেমন সত্যি, তেমনি সারা বছরই হলে গিয়ে ছবি দেখতে চান এমন দর্শকও আছেন, সেটাও সত্যি। গত শুক্রবার প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পেয়েছে ‘৩৬-২৪-৩৬’।
চরকি অরিজিনাল এই ফিল্মটি বানিয়েছেন রেজাউর রহমান। ১৫ নভেম্বর শাকিব খান অভিনীত দরদ মুক্তির ঘোষণা দিয়েছেন অনন্য মামুন। অন্য অনেক কিছুর মতোই সিনেমার ক্ষেত্রেও অনেক সময় মোমেন্টাম কাজ করে; যদি ‘৩৬-২৪-৩৬’, ‘দরদ’ দর্শকপ্রিয়তা পায়, সেই পথ ধরে হয়তো ঈদ ছাড়াও সিনেমা মুক্তির কথা ভাববেন প্রযোজকেরা।