কোথায় যাচ্ছে কোটি টাকার স্বল্পদৈর্ঘ্য সিনেমা

প্রদর্শনীর স্থায়ী প্ল্যাটফর্ম না থাকায় আড়ালেই থেকে যাচ্ছে সরকারি অনুদান পাওয়া স্বল্পদৈর্ঘ্য সিনেমাগুলো
কোলাজ

সরকারি অনুদানের স্বল্পদৈর্ঘ্য সিনেমার অনুদানের পরিমাণ বেড়েছে। নিয়ম করে প্রতিবছর এই স্বল্পদৈর্ঘ্য সিনেমায় কোটি টাকার বেশি অনুদান দেওয়া হচ্ছে। সিনেমাগুলোর নির্মাণ ও তত্ত্বাবধানে যুক্ত হয়েছেন গুণী পরিচালক, সমালোচকেরা। সরকারের পক্ষ থেকে সহায়তা পেলেও এই স্বল্পদৈর্ঘ্য সিনেমাগুলো কীভাবে কোথায় প্রদর্শিত হচ্ছে, তা আড়ালেই থাকছে। অন্তর্জালেও পাওয়া যাচ্ছে না। প্রশ্ন উঠছে, সরকারি অনুদানের কোটি টাকার স্বল্পদৈর্ঘ্য সিনেমা কোথায় যাচ্ছে?

২০১৯ সালে সরকারি অনুদান পায় ৯টি সিনেমা। এর মধ্যে ‘প্রাচীন বংশের নিঃস্ব সন্তান’, ‘পটুয়া’, ‘মুকুলের জাদুর ঘোড়া’, ‘অবিনশ্বর’—এই চার সিনেমাকে ২০ লাখ করে ৮০ লাখ টাকা দেওয়া হয়। এ ছাড়া ‘প্রথম রূপকথার বই’ অনুদান হিসেবে পায় ১৮ লাখ টাকা; ‘আগন্তুক’, ‘ধূসর দিগন্ত’ পায় ১৫ লাখ; ‘দূরে’ ও ‘মরিয়ম’ পায় সাড়ে ১২ লাখ ও ১২ লাখ টাকা। সব মিলিয়ে অনুদান ছিল ১ কোটি সাড়ে ৫২ লাখ টাকা।

স্বল্পদৈর্ঘ্য শাখায় অনুদান পায় তথ্যচিত্র ‘অবিনশ্বর’

২০২০-২১ অর্থবছরে স্বল্পদৈর্ঘ্য শাখায় অনুদানের সিনেমার সংখ্যা আরও একটি বাড়ে। ১০টি সিনেমা ও তথ্যচিত্রের এই তালিকায় থাকা ‘জল পাহাড় আর পাতাদের গল্প’, ‘রুপালি আঁশ’, ‘সোনার তরী’, ‘ঝিরি পথ পেরিয়ে’ ২০ লাখ টাকা করে অনুদান পায়। ১৮ লাখ টাকা করে পায় ‘যুদ্ধ জয়ের কিশোর নায়ক’, ‘হাওয়াই সিঁড়ি’। এ ছাড়া ‘স্বাধীনতার পোস্টার’ ও ‘আমার নানুর বাড়ি’ পায় ১৭ লাখ ও ১৪ লাখ টাকা করে। ‘বিন্দু থেকে বৃত্ত: একজন বকুলের আখ্যান’, ‘শিরিণের একাত্তর যাত্রা’ ১৫ লাখ টাকা করে অনুদান পায়। সব মিলিয়ে অনুদানের পরিমাণ ছিল ১ কোটি ৭৭ লাখ টাকা। এই সিনেমাগুলো ইউটিউব বা অন্যান্য অনলাইন প্ল্যাটফর্মে খুঁজে পাওয়া যায়নি।

২০১৯ সালে অনুদান পাওয়া ‘অবিনশ্বর’ স্বল্পদৈর্ঘ্য তথ্যচিত্রে উঠে এসেছে ভাষাসৈনিক ধীরেন্দ্রনাথ দত্তর সংগ্রামের গল্প। এটি নির্মাণ করছেন ফাখরুল আরেফীন খান। তিনি মনে করেন, স্বল্পদৈর্ঘ্য সিনেমা যাঁরা বানান, তাঁরা শুধু ভালোবাসা থেকেই কাজগুলো করেন। কারণ, এখানে সিনেমার মতো হল থেকে বাড়তি কোনো আয় বা প্রযোজক পাওয়া যায় না। এরপরও প্রতিবছর যাঁরা কষ্ট করে অনুদানের সিনেমা বানাচ্ছেন, সেগুলো নিয়ে তাঁরা দর্শকদের কাছেও পৌঁছাতে পারছেন না। তিনি বলেন, ‘এ বছরের ফেব্রুয়ারিতে আমরা জাতীয় জাদুঘরে আমার স্বল্পদৈর্ঘ্য সিনেমাটি প্রদর্শন করেছি। এরপর আর এটা দেখানোর কোনো ব্যবস্থা করা হয়নি। আমার কাছে মনে হয়, মন্ত্রণালয় চাইলে প্রতিবছর অনুদান পাওয়া স্বল্পদৈর্ঘ্যগুলো নিয়ে দেশের সব শিল্পকলায় উৎসব করতে পারে। তাহলে এগুলো বড় একটা দর্শকের কাছে পৌঁছাবে।’

অমিতাভ রেজা চৌধুরী। ছবি: সংগৃহীত

নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রায় অর্ধযুগ আগে অনুদান পাওয়া এক স্বল্পদৈর্ঘ্য সিনেমার পরিচালক বলেন, ‘অনুদানের এই সিনেমাগুলোর কাজ সবাই ঢিলেঢালাভাবে করে। কারণ, এর প্রদর্শনী থেকে বাড়তি কোনো আয়ের সুযোগ থাকে না। তা ছাড়া অনেক সময় বাজেটও বেশি হয়ে যায়। কেউ প্রযোজনা করতে চায় না। যার ফলে কেউ কেউ ফাঁকি দিয়ে কাজ শেষ করার চেষ্টা করে। পরে সেটা আর ফলাও করে প্রদর্শন করতে চায় না। সরকারকে দেখিয়ে টাকা নিয়ে নেয়।’

প্রসঙ্গটি নিয়ে স্বল্পদৈর্ঘ্য সিনেমার নির্মাণ ও তত্ত্বাবধানের জন্য মেন্টরের দায়িত্বে থাকা চলচ্চিত্র পরিচালক অমিতাভ রেজার সঙ্গে কথা হয়। কথার শুরুতেই তিনি বলেন, ‘সরকারি পর্যায় থেকে স্বল্পদৈর্ঘ্য সিনেমাগুলোর কোনো পরিবেশন করা হয় না। যে কারণে যাঁরা স্বল্পদৈর্ঘ্য সিনেমাগুলো নির্মাণ করেন, তাঁরাই ব্যক্তি উদ্যোগে প্রদর্শনী করার ব্যবস্থা করে থাকেন। একই প্ল্যাটফর্ম থেকে সিনেমাগুলো নিয়ে কীভাবে ডিস্ট্রিবিউট করে দর্শকদের কাছে পৌঁছানো যায়, এটা নিয়ে আমরা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলেছি। শিগগিরই এটা নিয়ে একটা লিখিত প্রস্তাব দেব।’

‘ঝিরি পথ পেরিয়ে’ স্বল্পদৈর্ঘ্য সিনেমার পোস্টার

তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের উপসচিব চলচ্চিত্র ১, ২ শাখার দায়িত্বে থাকা মো. সাইফুল ইসলামের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, এ জন্য সময় নিয়ে কথা বলতে হবে। তাঁরা নিয়মিত সিনেমাগুলোর দেখভাল করছেন। স্বল্পদৈর্ঘ্য সিনেমার ক্ষেত্রে এমন নজির খুবই কম রয়েছে, যেখানে অনুদানের অর্থ দেওয়ার পরও সিনেমা নির্মাণ করা হয়নি। সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘অনুদানের স্বল্পদৈর্ঘ্য সিনেমাগুলো আমরা দেখেছি। ঠিকমতো যেন কাজ হয়, সেগুলোও আমরা পর্যবেক্ষণ করি। এই সিনেমাগুলো আমাদের ফিল্ম আর্কাইভে সংগ্রহ করা আছে। কিছু সেন্সর বোর্ডে জমা আছে। এগুলো বিভিন্ন সময় প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করা হয়। এগুলো তো সিনেমা হলে চালানো যায় না। কেউ কেউ উৎসবে পাঠায়। এমন নয় যে সিনেমাগুলো আমাদের কাছেও নেই।’ অনুদান পাওয়া সিনেমাগুলো ইউটিউব বা অন্য কোনো প্ল্যাটফর্মে রাখা যায় কি না, এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘এটা হয়তো একটা ভালো পরামর্শ। কিন্তু এটা নিয়ে তো উচ্চপর্যায়ের সবার সঙ্গে বসে কথা বলতে হবে।’