মাধবী মুখোপাধ্যায় ও সত্যজিৎ রায়। কোলাজ
মাধবী মুখোপাধ্যায় ও সত্যজিৎ রায়। কোলাজ

নতুন অভিনয়শিল্পীরা ভুল করলে কী করতেন সত্যজিৎ?

আজ সত্যজিৎ রায়ের ১০৩তম জন্মবার্ষিকী। নির্মাতা ও লেখক হিসেবে সারা দুনিয়াতেই সমীহ জাগানিয়া এক নাম তিনি। তাঁর নির্মিত সিনেমার মধ্যে অন্যতম ‘চারুলতা’। সত্যজিৎ নিজেও বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে ‘চারুলতা’কে তাঁর অন্যতম প্রিয় সিনেমা হিসেবে অবহিত করেছেন। সত্যজিতের জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে কলকাতার দৈনিক ‘এই সময়’-এ কলাম লিখেছেন ‘চারুলতা’ অভিনেত্রী মাধবী মুখোপাধ্যায়। তাঁর লেখায় উঠে এসেছে অস্কারজয়ী এ বাঙালি নির্মাতা সম্পর্কে অনেক তথ্য।

নিজের লেখায় মাধবী জানিয়েছেন, ‘চারুলতা’ সিনেমায় তাঁর যুক্ত হওয়ার গল্প। তাঁর ভাষ্যে, ‘একদিন এক অনুষ্ঠানে দেখা। একগাল হেসে জিজ্ঞেস করলেন, “আবার কবে তোমার সঙ্গে কাজ করব?” এ কথা শুনে তো আমি অবাক! বলে কী। এ তো আমার বলার কথা। আমি খানিকক্ষণ চুপ করে গিয়েছিলাম। কিছুদিন পর আমার কাছে ফোন এল একদিন। বললেন, “তুমি একটু রবি ঠাকুরের “নষ্টনীড়”টা পারলে পড়ো।” আমি বললাম, ও মা, সে তো আমার পড়া। বললেন, “না আবার পড়ো।” সঙ্গে সঙ্গে বই পাঠিয়ে দিলেন।’

এর কিছুদিন পরই ডাকে আসে মাধবীর। তিনি হাজির হন সত্যজিতের বাড়িতে। নির্মাতা চিত্রনাট্য শোনালেন। যে দৃশ্যে মাধবী অভিনয় করবেন, সে দৃশ্য পুরোপুরি লেখা ছিল না। তখন সত্যজিৎ বলেন, ‘ওটা পুরোপুরি লেখা নেই। কিন্তু, আমি শুরু করে দিয়েছি। লিখছি।’ সেই স্মৃতি মনে করে নিজের কলামে মাধবী লিখেছেন, ‘তাঁর সঙ্গে কাজ করার সুবিধা হলো, সবটাই ছবির মতো থাকত। পুরো চিত্রনাট্য দিয়ে দিতেন, তাও আবার নিজের হাতে লিখে। এখন যেমন ফটোকপির ব্যবহার করা হয়, সেটা ছিল না। ফলে নিজে হাতে লিখে সবটা দিয়ে দিতেন। তখন অবশ্য সব পরিচালকই তা–ই করতেন। নিজের হাতে লিখে দিতেন চিত্রনাট্য।’

সত্যজিতের সিনেমায় মাধবী মুখোপাধ্যায়। আইএমডিবি

তবে সত্যজিতের হাতে লেখা চিত্রনাট্য এখন আর মাধবী মুখোপাধ্যায়ের কাছে নেই। এ নিয়ে দুঃখ করে তিনি লিখেছেন, ‘পরবর্তীকালে বিয়ে হয়ে গেল। তখন এত মূল্যবান সব জিনিসের গুরুত্ব কেউ বুঝতে পারেনি। মনে হয়েছে, এ তো কাগজপত্র, কী আর হবে। পূর্ণেন্দু পত্রী থেকে শুরু করে তপন সিনহা, সকলের স্ক্রিপ্ট সযত্ন রাখা ছিল। কিন্তু ওই যে সময়ের ফেরে আজ সব চলে গিয়েছে।’

সত্যজিতের সঙ্গে কাজের অভিজ্ঞতা নিয়ে মাধবী আরও লিখেছেন, ‘সত্যজিৎ রায়ের কাজ হলো সবচেয়ে সহজ। এত সুন্দর করে তিনি সবটা সাজিয়ে রাখতেন। কিছু নতুন করে, কষ্ট করে ভাবতে হয় না। প্রশ্ন করার আলাদা করে জায়গাও থাকে না। আসলে “চারুলতা” তো একেবারে অন্য রকম একটা গল্প। সেই সময় স্বামীর সঙ্গে স্ত্রীর সম্পর্ক ছিল গুরু-শিষ্যার সম্পর্ক। পরবর্তীকালে যখন চারুর জীবনে অমল আসল, তখন খানিক বন্ধুত্ব তৈরি হলো।

সত্যজিতের সিনেমায় মাধবী মুখোপাধ্যায়। আইএমডিবি

চারু বুঝতে শিখল, কাকে বলে আসল বন্ধু। এবার আমার ক্ষেত্রে যেহেতু “নষ্টনীড়” পড়া ছিল, তাই চরিত্রটা ফুটিয়ে তুলতে অনেক সুবিধা হয়েছে। তবে সব বিষয়টাই খানিক গুরুগম্ভীর। সকলেই নিজেদের মতো করে কাজ নিয়ে ব্যস্ত। শিল্পীরা যে যার নিজেদের চরিত্র নিয়ে ব্যস্ত। পরিচালক ছবির দৃশ্য, শুটিং থেকে শুরু করে কী হবে না হবে, গানের কম্পোজিশন, এডিটিং সেই বিষয়টা নিয়ে ব্যস্ত। ফলে আলাদা করে আর খুব একটা গল্প করার সময় থাকত না।’

নিজের লেখায় প্রখ্যাত এই অভিনেত্রী আরও জানান, সত্যজিতের সময়জ্ঞান নিয়ে প্রশ্ন তোলার সুযোগ নেই। একেবারে নির্দিষ্ট সময়ে চলে আসতেন। অন্য কেউ দেরি করলেও তিনি সঠিক সময়ে উপস্থিত হতেন।

সত্যজিৎ রায়। আইএমডিবি

‘চারুলতা’ কি রবীন্দ্রনাথের নাকি সত্যজিতের? এই প্রশ্ন নতুন নয়। মাধবী এ নিয়ে লিখেছেন, ‘যে যেভাবে পুরো বিষয়ের বিশ্লেষণ করে আরকি! এটা তো একেবারে সত্যি, মানুষ চরিত্রটাকে ভালোবেসেছে। আর সেই জন্যই তো এতটা সফল হয়েছে।’
দীর্ঘ লেখায় পরিচালক বা মানুষ হিসেবে সত্যজিৎ রায়কে ১০০ দিয়েছেন মাধবী। এর কারণও ব্যাখ্যা করেছেন তিনি। মাধবী লিখেছেন, ‘তিনি শুটিং করেন, তখন তো নতুনদের নিয়েও কাজ করেছেন। সেখানে অনেকেই এক টেকে সবটা ঠিকঠাক করতে পারেন না। তাদের বোঝানোর একটা অনবদ্য কৌশল বরাবর অবলম্বন করেছেন তিনি। বলতেন, “আমার মনে হয় এরপর যে শটটা নেব, সেটা আরও ভালো হবে। চলুন দেখা যাক।” এই কথা একজন অভিনেতার মনে জোর দেয় অনেকটা।’

মাধবী আরও লিখেছেন, কখনোই সত্যজিৎ রায়কে মেজাজ হারাতে দেখেননি তিনি। অভিনেত্রী জানান, নির্মাতা এতটাই গুছিয়ে কাজ করতেন যে তাঁর এসবের প্রয়োজনই হতো না কখনো। ফুরফুরে মেজাজ নিয়ে সর্বদা কাজ করতেন।

সত্যজিতের সিনেমায় মাধবী মুখোপাধ্যায়। আইএমডিবি

দীর্ঘ লেখাটা মাধবী মুখোপাধ্যায় শেষ করেছেন এভাবে, ‘আসলে তাঁর কর্মটাই সবচেয়ে বড়। কর্মের দ্বারাই তো মানুষ একটা বড় জায়গায় পৌঁছে যায়, তা–ই না? তাঁর কাজকে তিনি সাধনার জায়গায় নিয়ে গিয়েছেন, যা তিনি নিজেই তৈরি করেছেন। তাই সমস্ত সম্মান-ভালো তো সত্যজিৎ রায়ের প্রাপ্য।’