সারাহ বেগম কবরী
সারাহ বেগম কবরী

বাঙালি নায়িকা কেমন হবে, কবরী ছিলেন তার সংজ্ঞা...

রোমান্টিক, সামাজিকসহ সব ধরনের সিনেমায় অভিনয় করে কোটি মানুষের মন জয় করে নেন তিনি। ১৯৬৪ সালে ‘সুতরাং’ দিয়ে চলচ্চিত্রে তাঁর অভিষেক। তিনি বাংলাদেশি চলচ্চিত্রের মিষ্টি মেয়ে হিসেবে সবচেয়ে বেশি পরিচিত। পুরো নাম তাঁর সারাহ বেগম কবরী। সুভাষ দত্ত পরিচালিত ‘সুতরাং’ ছবির পরের বছর তিনি অভিনয় করেন ‘জলছবি’ ও  ‘বাহানা’য়। ১৯৬৮ সালে ‘সাত ভাই চম্পা’, ‘আবির্ভাব’, ‘বাঁশরী’, ‘যে আগুনে পুড়ি’। ১৯৭০ সালে ‘দীপ নেভে নাই’, ‘দর্পচূর্ণ, ‘ক খ গ ঘ ঙ’, ‘বিনিময়’ ছবিগুলো। কবরী অভিনীত ‘ময়নামতি’, ‘তিতাস একটি নদীর নাম’, ‘সারেং বৌ’, ‘নীল আকাশের নীচে’, ‘সুজন সখী’র মতো ছবির মাধ্যমে দর্শক অবাক বিস্ময়ে দেখেছেন কবরীর অসামান্য এক অভিনেত্রী হয়ে ওঠা। অভিনয়ে, প্রযোজনায়, পরিচালনায় সাত দশকের জীবনটা এক আশ্চর্য সফলতার গল্প।

বাংলাদেশি চলচ্চিত্রে ‘মিষ্টি মেয়ে’ কথাটি বললেই যে নায়িকার নামটি মাথায় আসে, তিনি একজনই—কবরী। চট্টগ্রামের মীনা পাল চলচ্চিত্রে নাম লিখিয়ে কবরী হয়ে ওঠেন। মিষ্টি হাসি ও ব্যতিক্রম অভিনয়ে জায়গা করে নেন দেশের কোটি মানুষের অন্তরে। এ দেশের সিনেমাকে যাঁরা সমৃদ্ধ করেছেন, তাঁদের মধ্য তিনি অন্যতম।
মাত্র ১৩ বছর বয়সে নৃত্যশিল্পী হিসেবে মঞ্চে উঠেছিলেন তিনি। তারপর টেলিভিশন ও সব শেষে সিনেমায়। শুরুর জীবনে কবরী বিয়ে করেন চিত্ত চৌধুরীকে। সম্পর্কচ্ছেদের পর ১৯৭৮ সালে তিনি বিয়ে করেন সফিউদ্দীন সরোয়ারকে। ২০০৮ সালে তাঁর সঙ্গেও বিচ্ছেদ হয়ে যায়। কবরী ছিলেন পাঁচ সন্তানের মা।

হালকা গয়না পছন্দ করতেন কবরী

মীনা পাল বা কবরীর প্রথম স্কুল ছিল আলকরণ। থাকতেন চট্টগ্রামের ফিরিঙ্গিবাজারে। আলকরণ স্কুলে চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করেন তিনি। এরপর কবরীর মা তাঁকে জেএম সেন হাইস্কুলে ভর্তি করে দেন। সেই সময়ের কথা মনে করে প্রথম আলোকে কবরী বলেছিলেন,  ‘আমরা রোজ রাতে ঘুমোতে যাওয়ার আগে কাপড় ভাঁজ করে মাথার বালিশের নিচে রেখে দিতাম। এভাবেই কাপড় ইস্তিরি হয়ে যেত। আর ওই কাপড় পরেই স্কুলে যেতাম।’

কবরীদের পুরো পরিবারই ছিল ভীষণ সংস্কৃতিমনা। বড় বোনদের মধ্যে দুই বোন নাচতেন। ছোট ভাই তবলা বাজাতেন। কবরী নাচ-গান একসঙ্গে করতেন। ৭০ বছরের জীবনে তিনি ৫৬ বছর কাটিয়ে দেন চলচ্চিত্রে। ১৯৫০ সালের ১৯ জুলাই চট্টগ্রামের বোয়ালখালীতে জন্মগ্রহণ করা কবরী ১৯৬৪ সালে ‘সুতরাং’ চলচ্চিত্র দিয়ে রুপালি পর্দায় যাত্রা শুরু করেন। কবরীর সিনেমার আবেদন ছবিপ্রেমীদের কাছে কখনো ফুরিয়ে যাওয়ার নয়। গ্রহণযোগ্যতা ও জনপ্রিয়তায় তিনি ছাড়িয়ে যান অনেককে। নিজেকেই নিজের তুলনা করে তোলেন কবরী।

‘সুতারাং’ ছবিতে কবরী ও সুভাষ দত্ত

এমন কথা শোনা যায়, তাঁর সমসাময়িক এবং অগ্রজ অভিনয়শিল্পীদের কণ্ঠে। কবরীকে নিয়ে বলতে গিয়ে চলচ্চিত্রের গুণী শিল্পী উজ্জ্বল প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাংলাদেশের একজন বাঙালি নায়িকা কেমন হবে, কবরী ছিলেন তার সংজ্ঞা। চেহারা, চলন, কথাবার্তা, ব্যক্তিত্ব—সব দিক থেকে কবরী ছিলেন আদর্শ। কবরী ছিলেন একেবারে স্বচ্ছন্দ, স্বাভাবিক। আমরা তাঁকে দেখে মুগ্ধ ছিলাম। আমি যখন কাজ শুরু করি, কবরী তখন দেশের তুমুল জনপ্রিয় নায়িকা। আমি মাত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডি পেরোনো যুবক। তিনি আমাকে সহজ করার জন্য কত কথা বললেন! তিনি ছিলেন বাকপটু আর মিশুক। সহকর্মীদের সঙ্গে মজা করতেন, খুনসুটি করতেন। তিনি যতই আমাকে সহজ করার চেষ্টা করছিলেন, আমি ততই আড়ষ্ট হয়ে যাচ্ছিলাম। পরে অবশ্য ভালোভাবে অভিনয় করেছি। তখনকার নারীর যে ইমেজ ছিল—যেমন লজ্জাবতী, আকর্ষণীয়, প্রেমিকা, সব দিক দিয়ে কবরী ছিলেন সেরা।’

‘ক খ গ ঘ ঙ’ ছবিতে রাজ্জাক ও কবরী

এদিকে বরেণ্য অভিনয়শিল্পী সুজাতা তো তাঁকে শক্তিশালী অভিনয়শিল্পী এবং একইসঙ্গে স্পষ্টবাদী একজন মানুষ মনে করতেন। কবরী প্রসঙ্গে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার কাছে কবরী ছিলেন একজন পাওয়ারফুল অভিনেত্রী। তিনি অনেক সুন্দরভাবে অভিনয় করতেন। ব্যক্তিগতভাবে তিনি স্পষ্টবাদী ছিলেন। যে কারণে হয়তো অনেকেই তাঁকে ভুল বুঝতেন। ভালো-খারাপ দুটিই তিনি সরাসরি বলে দিতেন। এটা আমার খুব ভালো লাগত। বাস্তব চরিত্রগুলো ফুটিয়ে তুলতে অভিনেত্রী হিসেবে তিনি ছিলেন অপ্রতিদ্বন্দ্বী। তিনি সহজেই যেকোনো চরিত্রের সঙ্গে মানিয়ে যেতেন। যে কারণে তিনি ছিলেন সফল অভিনেত্রীর নাম।’

‘সারেং বৌ’ ছবিতে কবরী ও ফারুক

অভিনয়ে তুমুল জনপ্রিয়তা পাওয়া কবরী নিজেকে শুধু অভিনয়ে আবদ্ধ রাখেননি। মুক্তিযুদ্ধের সময় মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত সৃষ্টি করতে তাঁর ভূমিকা ছিল চোখে পড়ার মতো। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে ঢাকা থেকে গ্রামের বাড়ি চলে যান তিনি। সেখান থেকে পাড়ি জমান ভারতে। কলকাতায় গিয়ে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত সৃষ্টি করতে বিভিন্ন সভা-সমিতি ও অনুষ্ঠানে বক্তৃতা এবং বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে যোগ দেন কবরী। তখনকার স্মৃতি স্মরণ করে একবার কবরী প্রথম আলোকে বলেছিলেন, ‘সেখানকার এক অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের অবস্থার কথা তুলে ধরেছিলাম। কীভাবে আমি মা-বাবা, ভাইবোন, আত্মীয়স্বজন সবাইকে ছেড়ে এক কাপড়ে পালিয়ে সেখানে পৌঁছেছি, সে কথা বলেছিলাম। সেখানে গিয়ে তাদের মাধ্যমে বিশ্ববাসীর কাছে আমাদের দেশকে সাহায্যের আবেদন করি।’

কবরী

দেশ স্বাধীন হওয়ার পর আবারও চলচ্চিত্রে অভিনয় শুরু করেন কবরী। শতাধিক ছবিতে অভিনয় করেন তিনি। ১৯৭৩ সালে ঋত্বিক ঘটক পরিচালিত ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ সেসবের মধ্যে উল্লেখযোগ্য। নায়ক রাজ্জাকের সঙ্গে ‘রংবাজ’ পায় বেশ জনপ্রিয়তা। ৫০ বছরের বেশি সময় চলচ্চিত্রে রাজ্জাক, ফারুক, সোহেল রানা, উজ্জ্বল, জাফর ইকবাল ও বুলবুল আহমেদের মতো অভিনেতাদের সঙ্গে কাজ করেছেন তিনি। ঢাকার চলচ্চিত্রের ইতিহাসের অন্যতম জনপ্রিয় জুটি ছিলেন রাজ্জাক-কবরী।

বই পড়ে সময় কাটাতেন কবরী

২০০৫ সালে এসে ‘আয়না’ নামের একটি ছবি নির্মাণের মাধ্যমে চলচ্চিত্র পরিচালক হিসেবে কাজ শুরু করেন কবরী। এমনকি ওই ছবির একটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে তিনি অভিনয়ও করেছিলেন। এরপর রাজনীতিতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন তিনি। ২০০৮ সালে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ থেকে জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। যুক্ত হয়েছেন অসংখ্য নারী অধিকার ও সমাজসেবামূলক সংগঠনের সঙ্গে। কবরীর বর্ণাঢ্য জীবনকে কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়েছে আরেক গুণী অভিনয়শিল্পী, প্রযোজক এবং পরিচালক সোহেল রানারও। তিনি বলেন, ‘কবরীকে “মিষ্টি মেয়ে” নামটা এ দেশের সাধারণ মানুষেরাই দিয়েছেন। সাধারণ লোকের দেওয়া নামটাই বোধ হয় একজন শিল্পীর বড় প্রাপ্য। একজন শিল্পী হিসেবে তাঁর বড় সার্থকতা। এরপর শিল্পী হিসেবে তাঁকে নিয়ে আর দ্বিতীয় কথা বলার নেই। সি ওয়াজ জাস্ট আন প্যারালাল। ওই মিষ্টি মুখ বা ওই মিষ্টি হাসি বা ওই মিষ্টি অভিনয়—বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে আসেনি এর আগে এক কবরী ছাড়া। আগামী ৫০ বছরে আসবে বলেও আমার ধারণা নেই। আমি বিশ্বাস করি, শত বছরে কবরী একটাই জন্মায়।’

বাংলা চলচ্চিত্রপ্রেমী অনেকের প্রিয় কবরী। তাঁর মিষ্টি অভিনয় ও মিষ্টি হাসি যেমন সবাইকে মুগ্ধ করত। তেমনি দেশ-বিদেশের অনেকেও তাঁর প্রিয় তালিকায় ছিল। অভিনয়শিল্পীদের মধ্যে সোফিয়া লরেন, এলিজাবেথ টেলর, অড্রে হেপবার্ন, গ্রেগরি পেক, উত্তম কুমার, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, বিকাশ রায় ও ছবি বিশ্বাস ছিলেন প্রিয়দের তালিকার সবার আগে। গান শুনতেও খুব পছন্দ করতেন কবরী। এর মধ্যে পপ ধারার গানই বেশি শুনতেন বলে প্রথম আলোর সঙ্গে আলাপে একাধিকবার জানিয়েছিলেন। তবে তাঁর সবচেয়ে প্রিয় সংগীতশিল্পীর তালিকায় দেশের বাইরে মান্না দে, হেমন্ত ও শ্রীকান্ত আচার্য। দেশের মধ্যে সুবীর নন্দী ও সাবিনা ইয়াসমীনের কণ্ঠ তাঁর খুব প্রিয়। তাঁর সমসাময়িক এমন কেউ নেই, যাঁর সঙ্গে চলচ্চিত্রে তিনি পর্দা ভাগাভাগি করেননি। কিন্তু মনে মনে একজনের সঙ্গে অভিনয়ের স্বপ্নটা দেখতেন। যা কখনোই পূরণ হয়নি, এমনকি সেই সুযোগও তৈরি হয়নি। কথা প্রসঙ্গে প্রথম আলোকে কবরী বলেছিলেন, ‘অমিতাভ বচ্চনের সঙ্গে কাজ করার খুব আগ্রহ ছিল। তাঁর অভিনয় ও কথাবার্তা মুগ্ধ করত। অমিতাভকে স্বপ্নেও দেখেছি বহুবার।’

‘এই তুমি সেই তুমি’ ছবির দৃশ্যধারণ কেমন হচ্ছে তা মনিটরে দেখছেন পরিচালক কবরী

‘এই তুমি সেই তুমি’ নামে একটি ছবির কাজ শুরু করেছিলেন কবরী। অভিনয়ের পাশাপাশি এই ছবির পরিচালক এবং প্রযোজকও তিনি। এই ছবিকে ঘিরে ছিল তাঁর অনেক স্বপ্ন। ছবির কাজ অসম্পূর্ণ রেখে, অনেক স্বপ্ন পূরণের আগেই ২০২১ সালের ১৭ এপ্রিল মারা যান বাংলার অন্যতম সেরা অভিনেত্রী কবরী। বাংলাদেশি সিনেমার ‘মিষ্টি মেয়ে’ কবরী মৃত্যুর আগ পর্যন্ত সক্রিয় ছিলেন সিনেমায়। ক্যামেরার সামনে থেকে চলে গিয়েছিলেন পেছনে, পরিচালকের আসনে। করোনায় আক্রান্ত হয়ে ১৩ দিনের মাথায় ৭১ বছর বয়সে তিনি মারা যান। আজ তাঁর তৃতীয় মৃত্যুবার্ষিকী।