নির্বাচনে হেরে গেলেও মিশা-ডিপজলকে জয়ের মালা পরিয়ে দেন নিপুণ
নির্বাচনে হেরে গেলেও মিশা-ডিপজলকে জয়ের মালা পরিয়ে দেন নিপুণ

ফুলের মালা দিয়ে বরণের ২৫ দিন পর নিপুণের রিট, কিসের ইঙ্গিত

নির্বাচনে হেরে ফুলের মালা দিয়ে বিজয়ী প্রার্থীকে বরণ করে নিয়েছিলেন নিপুণ। বিজয়ী সভাপতি মিশা ও সাধারণ সম্পাদক ডিপজল বরণ করা সেই ফুলের মালা পরিয়ে দেন পরাজিত সাধারণ সম্পাদক নিপুণকে। হাসিমুখেই সেদিন সকালে সব শেষ হয়। একে অপরকে নিয়ে সুন্দর সুন্দর কথাও বলেছিলেন তাঁরা। কিন্তু হাসিমুখ বেশি দিন স্থায়ী হলো না। মনে মনে কী যেন পুষে রেখেছিলেন নিপুণ। যার ফলাফল দেখা গেল শিল্পী সমিতির নির্বাচনী আয়োজন শেষ হওয়ার চার সপ্তাহে এসে। জানা গেছে, ফুলের মালা দিয়ে যাঁদের বরণ করে নিয়েছিলেন, সেই সভাপতি, সাধারণ সম্পাদকসহ পুরো কমিটির কার্যক্রম স্থগিত চেয়ে গত বুধবার হাইকোর্টে রিট করেছেন নিপুণ।
১৯ এপ্রিল বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন করপোরেশনে অনুষ্ঠিত হয় চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির এবারের মেয়াদের নির্বাচন। এতে নিপুণ ও মাহমুদ কলি প্যানেলের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে মিশা-ডিপজল প্যানেল। সারা দিন ভোট গ্রহণ শেষে পরদিন ২০ এপ্রিল সকালে ঘোষিত ফলাফলে জানা যায়, নিপুণের প্যানেলের শোচনীয় পরাজয় হয়েছে। ভোটের ফলাফল ঘোষণার সময় উপস্থিতও ছিলেন নিপুণ। এরপর তিনি ডিপজল ও মিশাকে ফুলের মালা পরিয়ে দেন। মিশা ও ডিপজল তাঁদের পরিয়ে দেওয়া মালা নিপুণকে পরিয়ে দেন।

শিল্পী সমিতির নির্বাচনে হেরে সেদিন গণমাধ্যমের কাছে নিপুণ জানিয়েছিলেন, ‘ভেবেছিলাম ডিপজল সাহেবের বিপরীতে আমি যখন দাঁড়াব, ভোট পাব সর্বোচ্চ ৫০টি। সেখানে ভোট পেলাম ২০৯টি। হেরেছি মাত্র ১৬ ভোটে। এতেই প্রমাণিত হলো যে শিল্পী সমিতির ভাইবোনেরা আমাকে কতটা ভালোবাসেন। এত সম্মান দেওয়ার জন্য তাঁদের ধন্যবাদ জানাই।’ এমনকি সেদিন নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হওয়ার জন্য নিজেকেই কৃতিত্ব দেন নিপুণ।

নিপুণের প্রশংসা করে সেদিন মিশা সওদাগর বলেছিলেন, ‘আমরা জিতেছি, এটা বড় কথা নয়, নিপুণসহ তাঁর প্যানেলের সবাই আমাদের পাশে থাকবেন। আমরা সবাই এক।’ ডিপজলও বলেছিলেন, ‘নিপুণকে আমি এনেছিলাম চলচ্চিত্রে। তাতে হার-জিত বড় কথা নয়। ওকে আমি মেয়ের মতোই স্নেহ করি। আমরা সবাই মিলে একসঙ্গে থাকতে চাই। কোনো ভাগাভাগি চাই না।’

নিপুণের রিট এবং বর্তমান কমিটি নিয়ে তাঁর কটাক্ষেরও জবাব দিয়েছেন ডিপজল, মিশা সওদাগর

নির্বাচনের চার সপ্তাহে এসে সব সমীকরণ যেন পাল্টে গেল। নিপুণ করেছেন হাইকোর্টে রিট। আর সেই খবর শুনে মিশা সওদাগর হুংকার ছুড়েছেন। ডিপজল বলছেন, ‘কেস খেলবা আসো। যেটা খেলার মন চায়, সেটাই খেলো।’

রিট করা প্রসঙ্গে এত দিন পর এসে নিপুণ বলছেন, ‘ভোট শেষ হওয়ার পর সন্ধ্যা সাতটা থেকে নির্বাচন কমিশনের চেয়ারম্যান ও আপিল বোর্ডের চেয়ারম্যানের কথাবার্তা রহস্যজনক মনে হয়েছে। তা ছাড়া যতই রাত বাড়ছিল, ততই ভোটকেন্দ্র ও বাইরের পরিবেশ আমার কাছে হুমকিস্বরূপ মনে হচ্ছিল। সেদিনের এমন পরিবেশ আমি আগে কখনো দেখিনি এফডিসিতে। পুরো আঙিনা তারা দখলে নিয়েছিল। ভোটের গণনা শেষ হতে তখনো অনেক সময় বাকি ছিল, কিন্তু তাদের হাবভাবে মনে হচ্ছিল, তখনই তারা পুরো প্যানেল জিতে গেছে। আমি নিজেও নিরাপদ মনে করিনি ভোট গণনার পুরো রাত। তাই আমিসহ আমার প্যানেলের কয়েকজন ১ নম্বর স্টুডিওর মেকআপ রুমে তালা মেরে ভেতরে বসে ছিলাম ভোটের ফলাফল পর্যন্ত।’
রিট করার পেছনে অভিযোগ হিসেবে নিপুণ আরও বলেছেন, ‘নির্বাচন কমিশন বাতিল ভোটের সংখ্যা সঠিক দেননি। আমার জানামতে, ৮১টি ভোট বাতিল হয়েছে। কিন্তু তারা ৪০টি ভোট বাতিল দেখিয়েছে। এ নিয়ে স্পষ্ট করে কোনো কিছুই আমাদের প্যানেলকে জানায়নি নির্বাচন কমিশন।’ তাহলে অনিয়ম জেনেও কেন বিজয়ী সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের গলায় ফুলের মালা পরিয়ে দেন—এমন প্রশ্নে নিপুণের বক্তব্য এ রকম, ‘ওই সময় সেটি করা ছাড়া কোনো উপায় ছিল না। তা ছাড়া মিশা-ডিপজল প্যানেলের সঙ্গে নির্বাচন কমিশন, আপিল বোর্ডের যোগসাজশে ভেতরে-ভেতরে এত বড় অনিয়ম চলে আসছিল, সেটি ফলাফল প্রকাশের অনেক সময় পর স্পষ্ট হয়েছে।’

এদিকে গতকাল বৃহস্পতিবার শিল্পী সমিতির নতুন কমিটিকে সংবর্ধনা দিয়েছেন মিশা ও ডিপজল–সমর্থিত শিল্পীরা। এ সময়ে নিপুণের রিট এবং বর্তমান কমিটি নিয়ে তাঁর কটাক্ষের জবাব দিয়েছেন মিশা ও ডিপজল। মিশা সওদাগর কারও নাম উল্লেখ না করে দেওয়া ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়ায় বলেন, ‘যিনি সংবিধানকে ক্ষতবিক্ষত করেছেন, তাঁকে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বুঝিয়ে দেব শিল্পী সমিতির সংগঠন কী? এবার শিল্পী সমিতির সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক কে? এবার শিল্পী সমিতির ক্যাবিনেটটা কী?’

মিশা ও ডিপজল

নিপুণের রিট ঘিরে চলছে আলোচনা–সমালোচনা। চলচ্চিত্রাঙ্গনের অনেকের মধ্যে রয়েছে বিভক্তিও। কেউ নিপুণকে নীরবে সমর্থন দিচ্ছেন, কেউবা বলছেন, এমন কাজ করাটা মোটেও ঠিক হয়নি। নির্বাচনে হেরে যাওয়ার এত দিন পর রিট করার মতো এমন একটি কাজ খারাপ দৃষ্টান্ত হয়ে রইল। পরিচালক মালেক আফসারী তো এমন ইস্যুতে ইঙ্গিত করে বললেন, ‘আগে এফডিসি থেকে ছবি যেত সিনেমা হলে। এখন এফডিসি থেকে মামলা যায় আদালতে।’ তিনি এমনও বলেন, ‘এফডিসি থেকে রাজনীতি সরান। অটোমেটিক সব ঠিক হয়ে যাবে।’ চলচ্চিত্রের জ্যেষ্ঠ শিল্পীদের কেউ কেউ বলছেন, শিল্পী সমিতির নির্বাচন দুই বছরের, কেউ আসবে কেউ যাবে। অলাভজনক সংগঠনের জন্য নির্বাচন ঘিরে যেভাবে আদালতে যাওয়ার চর্চা শুরু হয়েছে, তাতে সুনাম নষ্ট হচ্ছে। প্রকৃত শিল্পীরা এতে বারবার অসম্মানিত হচ্ছেন।

চলচ্চিত্র–সংশ্লিষ্ট এসব খবর নিয়ে ফেসবুকে সাধারণ মানুষের বক্তব্য এমন, এখানে এখন সুশিল্পের থেকে কুশিল্পের চর্চা মনে হয় একটু বেশিই থাকে। রহমান, শবনম, রাজ্জাক, কবরী, সোহেল রানা, ববিতা, শাবানা, আলমগীরদের তৈরি এই ইন্ডাস্ট্রি এমন কর্মকাণ্ডে দিন দিন গৌরব হারাতে বসছে। যেখানে প্রকৃত শিল্পীরা কাজ করে দম ফেলার সময় পাচ্ছেন না, সেখানে একটা পক্ষ নির্বাচন ঘিরে নানা বিতর্কের জন্ম দিচ্ছে, যা মোটেও কাম্য নয়। চলচ্চিত্রের মানুষ চলচ্চিত্রের খবরে আলোচনায় থাকুক, এমনটাই তাদের চাওয়া।
এদিকে চলচ্চিত্র–সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের কারও মতে, নির্বাচনে এভাবে হেরে যাওয়াটা নিপুণ কোনোভাবেই মেনে নিতে পারেননি। শুরু থেকে তিনি আত্মবিশ্বাসী ছিলেন, জিতবেন। কিন্তু ফলাফল দেখলেন উল্টো। নিপুণের পরিচিতজনেরা কেউই এই হার মানতে চাইছেন না। তাই পরিচিতজনদের কারও কারও ইন্ধনে এমনটা করেছেন। তাঁর বিশ্বাস, যেসব তথ্য–উপাত্ত আছে, তাতে রিট নিয়ে আলোচনা কিছুদিন চলতে থাকবে। তবে এসব মোটেও ভালো কোনো ইঙ্গিত বহন করে না। আবার এসবকে ঘিরে প্রতিপক্ষের হুংকার, অসম্মান ও অশ্রদ্ধাপূর্ণ বক্তব্য যে শুরু হয়েছে, তা–ও মোটে গ্রহণযোগ্য নয়। নিপুণ এখন যুক্তরাষ্ট্রে রয়েছেন, রিটের পেছনে যদি অন্য কোনো উদ্দেশ্য থাকে, তা দেশে আসার পর হয়তো প্রকাশ্যে আসতে পারে।