‘রাজকুমার’–এর গানের দৃশ্য। ফেসবুক থেকে
‘রাজকুমার’–এর গানের দৃশ্য। ফেসবুক থেকে

শাকিব খানের ‘রাজকুমার’: শুরুতে চোখের শান্তি, শেষে বড় ধাক্কা

গল্পটা শুরু হয় তথাকথিত ঢালিউড ছাঁচেই। বাংলাদেশের কোনো গ্রামের শীতকালের নৈসর্গ। মেঠো পথ, চোখজুড়ানো শর্ষেখেত। গ্রামের এক তরুণ খেজুরের রস পান করার তাগিদে গাছে উঠেই বিপদে পড়েছে, রসের হাঁড়িতে সাপ! যথারীতি নায়ক এসে উদ্ধার করে। এসব দেখে শুরুতে মনে হয়েছে, এই গল্পের কাঠামোটা সেই পুরোনো। তবে গল্প যত এগোয়, সেই ভাবনাকেই ভুল প্রমাণ করে দেয় চিত্রনাট্য। শুরুতে চোখের শান্তি, শেষ দৃশ্যে তো বড়সড় ধাক্কা।

আমরা বসেছি তরুণ নির্মাতা হিমেল আশরাফের ‘রাজকুমার’ দেখতে। আদ্যন্ত মূলধারার বাণিজ্যিক একটি ছবি। সেদিন কেরানীগঞ্জের লায়ন সিনেমাসে রাতের শেষ শো ছিল প্রায় হাউসফুল। নিঃসন্দেহে এ সিনেমার বড় বিজ্ঞাপন ঢালিউডের জনপ্রিয় নায়ক শাকিব খান, সংগত কারণে পবিত্র ঈদুল ফিতরে মুক্তি পাওয়া ১১টি সিনেমার মধ্যে এগিয়ে আছে এ সিনেমা। সর্বাধিক ১২৬টি হলে মুক্তি পেয়েছিল এ সিনেমা। শাকিব খান ছাড়া ছবিটি আলোচনায় আসার আরেকটি কারণ, গান। বিশেষ করে ‘রাজকুমার’ ও ‘বরবাদ’ গান দুটি নিয়ে বেশ আলোচনা দেখেছি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে।

‘রাজকুমার’ সিনেমার পোস্টার। ফেসবুক থেকে

ঘটনাচক্রে এদিন সিনেমা হলে ছিলেন ‘রাজকুমার’ গানের সুরকার আকাশ সেন ও গীতিকার আসিফ ইকবাল। শহরের কোনো মাল্টিপ্লেক্সে টিকিট না পাওয়ায় তাঁরাও ছুটে গিয়েছিলেন বুড়িগঙ্গার ওপারে, লায়নে। সেদিন রাতের শেষ শোতে নারী দর্শকের উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো।

নাহ্‌, এক জোড়া নায়ক-নায়িকা থাকলেও এটি প্রেমের সিনেমা নয়। অপ্রেম, অ্যাকশন, রহস্য উন্মোচন, হত্যার প্রতিশোধ নেওয়ার ছবিও এটি নয়। এ ছবির নায়কের একটাই উদ্দেশ্য, সে যুক্তরাষ্ট্রে যাবে। প্রয়োজনে সব বিক্রি করে বাবার ত্যাজ্যপুত্র হয়েও যুক্তরাষ্ট্রে সে যাবেই। যায়ও। হাজার মাইল দূরে গিয়ে সে খুঁজতে থাকে প্রিয়জনকে। ঈদের এ ছবি আপনাকে এক লহমায় নিউইয়র্ক সফর করিয়ে দেবে। এমনকি, অনাবাসী বাঙালির জীবনকেও দেখিয়ে দেবে একই সঙ্গে। প্রথমে যেমন বলেছিলাম এই বাংলার কোনো গ্রামের নৈসর্গ চোখে আরাম দিয়েছে, ঝাঁ–চকচকে নিউইয়র্ক শহরটাকেও পরিচালক মন ভরে দেখিয়েছেন।

এক জোড়া নায়ক-নায়িকা থাকলেও এটি প্রেমের সিনেমা নয়। অপ্রেম, অ্যাকশন, রহস্য উন্মোচন, হত্যার প্রতিশোধ নেওয়ার ছবিও এটি নয়। এ ছবির নায়কের একটাই উদ্দেশ্য, সে যুক্তরাষ্ট্রে যাবে
‘রাজকুমার’–এ শাকিব খান। ফেসবুক থেকে

অভিনয়ের প্রসঙ্গে আসি। শাকিব খানের সর্বশেষ কিছু ছবি সিনেমা হলে দেখেছি। রাজকুমার দেখে মনে হয়েছে, দিনকে দিন ভালো করছেন এই অভিনেতা। নেহাত বাণিজ্যিক ছবির নায়ক থেকে তিনি হয়ে উঠছেন সিরিয়াস অভিনেতা। এ ছবি তারই প্রমাণ। যেখানে হারানো প্রিয়জনকে খুঁজে পাওয়ার যন্ত্রণা তাঁর চোখে। শরীরে। কণ্ঠে। ঘটনাচক্রে এক বিদেশির প্রেমে পড়েন। প্রেমিকার জন্য মারামারিও করেন। শাকিব এ ছবিতে শামসুল হক ওরফে স্যাম থেকে রাজকুমার হয়ে উঠতে পেরেছেন।

‘রাজকুমার’ সিনেমার দৃশ্যে আরশ খান ও মাহিয়া মাহি

ছবির অন্যান্য চরিত্রেও শক্তিশালী অভিনেতারা রয়েছেন, তাঁরা প্রত্যাশা পূরণ করেছেন। দাদির চরিত্রে দিলারা জামান, বাবার চরিত্রে তারিক আনাম খান আলাদা করে নজর কেড়েছেন। এককালের ব্যস্ত খল অভিনেতা আহমেদ শরিফ নামের প্রতি সুবিচার করেছেন। বিশেষ করে অভিমানী মুক্তিযোদ্ধার দেশের মাটিতে সাড়ে তিন হাত মাটি পাওয়ার বিনিময়ে সবকিছু দান করে যাওয়ার, বিদায় জানানোর প্রতীকী দৃশ্য মনে ধরেছে।

‘রাজকুমার’–এ শাকিব খান। ফেসবুক থেকে

মাহিয়া মাহি অতিথি চরিত্রে অভিনয় করলেও পর্দায় তাঁর উপস্থিতির সময় নেহাত কম ছিল না। সেই সময়ের মধ্যেই জোরদার অভিনয়ে হলের দর্শকের মনে জায়গা করে নিতে পেরেছেন বলে মনে হয় না। এ ক্ষেত্রে মনে হয়েছে, টিমওয়ার্কের খামতি ছিল। একইভাবে ছোটবেলার রাজকুমারের বাবার চরিত্রে আরশ খানকে মনে হয়েছে তিনি ‘অভিনয়’ই করতে এসেছেন। সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছেন অভিনয় করতে এবং এটাই দৃষ্টিকটু লেগেছে। মেকআপ দেখে মনে হয়েছে, ২০২৪ সালেও এমন মেকআপ হয়! হতে পারে, পরিচালক রূপসজ্জাকারীকে চরিত্রের বয়স বলে দেননি। কত বয়স—৭০, ৮০, নাকি ১০০? বেশি বয়স দেখাতে প্রস্থেটিকের বাড়াবাড়ি লাগবেই? বলিউডের রেখা, মনীষা কৈরালা, এমনকি দীপিকাকেও নায়কের মায়ের চরিত্রে দেখানো হয়েছে। মন্দ লেগেছে কি?

বাকি রইল কোর্টনি কফি, এ সিনেমার নায়িকা। লং আইল্যান্ডের হিকসভিলে জন্ম নেওয়া এই অভিনেত্রী নিউইয়র্কের দ্য নেইবারহুড প্লে হাউস স্কুল অব দ্য থিয়েটার থেকে গ্র্যাজুয়েশন করেছেন। শুনেছি, যুক্তরাষ্ট্রে বেশ কয়েকটি স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ও ফিচার ফিল্মে অভিনয় করেছেন তিনি। তবে ‘রাজকুমার’–এর জুলি চরিত্রে খুব বেশি মুনশিয়ানা দেখাতে পারেননি এই অভিনেত্রী।

আহমেদ শরিফ নামের প্রতি সুবিচার করেছেন। বিশেষ করে অভিমানী মুক্তিযোদ্ধার দেশের মাটিতে সাড়ে তিন হাত মাটি পাওয়ার বিনিময়ে সবকিছু দান করে যাওয়ার, বিদায় জানানোর প্রতীকী দৃশ্য মনে ধরেছে।
আহমেদ শরিফ নামের প্রতি সুবিচার করেছেন

আবহ সংগীত নিয়ে আরেকটু ভাবা যেত। বলা যায়, এ ছবির নায়ক যদি শাকিব খান হন, তাহলে ভিলেন আবহ সংগীত। পাশে বসা এক দর্শক তো বিরক্ত নিয়ে উচ্চারণ করলেন, ‘উফ্‌, বিজিএম, বিজিএম!’ তাঁর ভাষ্য, এত শব্দ কেন? মনঃসংযোগ তো বেশি বাড়ে যদি শব্দকে পরিমিতভাবে ব্যবহার করা যায়। আজকের আন্তর্জাতিক ছবি তো তা–ই বলছে। কোথাও মনে হয়েছে যে একদম দরকার নেই, তা–ও বাজছে। আবার কোথাও দরকার ছিল, নেই!

ঠিক বিপরীত ক্যামেরার কাজ। রাজিবুল ইসলামকে পরিচালক পূর্ণাঙ্গ স্বাধীনতা দিয়েছেন। কিংবা এই জায়গায় যথাযথ বাজেট রেখেছে প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান ভার্সেটাইল মিডিয়া। সমতল, পাহাড়, গ্রাম কিংবা বরফজমা নিউইয়র্ক মন ভরিয়ে দেখাতে পেরেছেন গল্পের ফাঁকে ফাঁকে।

এ ছবির নায়ক যদি শাকিব খান হন, তাহলে ভিলেন আবহ সংগীত। পাশে বসা এক দর্শক তো বিরক্ত নিয়ে উচ্চারণ করলেন, ‘উফ্‌, বিজিএম, বিজিএম!’ তাঁর ভাষ্য, এত শব্দ কেন? মনঃসংযোগ তো বেশি বাড়ে যদি শব্দকে পরিমিতভাবে ব্যবহার করা যায়।
হিমেল আশরাফ

পরিচালক হিমেল আশরাফ এর আগে শাকিব খানকে নিয়ে একই প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানের ব্যানারে বানিয়েছিলেন ‘প্রিয়তমা’। দুটি গান, মেকআপ আর কাস্টিংয়ের বদৌলতে সে ছবি বাণিজ্যিকভাবে সফল হয়েছে দেশে-বিদেশে। তবে পূর্ণাঙ্গ ছবি হিসেবে ‘প্রিয়তমা’র গাঁথুনি ছিল দুর্বল। সেবার মনে হয়েছিল, শক্তিশালী টিম নিয়ে কোচ গেছে ভিন্ন পরিবেশে, অপ্রচলিত মাঠে খেলতে। রাজকুমার–এর ক্ষেত্রে বিষয়টা অন্য রকম, মনে হয়েছে ঘরে মাঠে সেরা দলটাকে নিয়ে নেমেছেন কোচ। যার ফলে সফলও হয়েছেন। মূলধারার বাণিজ্যিক ছবি বললেই যেসব ছবি ফুটে ওঠে, ২ ঘণ্টা ২৫ মিনিটের ‘রাজকুমার’ও আদতে তার সঙ্গে মিলে যায়। এ ছবি দেখলেই আপনি বুঝবেন, গল্পই আসল চমক।

শাকিব খান ও কোর্টনি কফি