`বলী দ্য রেসলার' ও ‘সামথিং লাইক অ্যান অটোবায়োগ্রাফি’ ছবির দৃশ্য। ছবি: সংগৃহীত
`বলী দ্য রেসলার' ও ‘সামথিং লাইক অ্যান অটোবায়োগ্রাফি’ ছবির দৃশ্য। ছবি: সংগৃহীত

বলিউডের ছায়া থেকে বেরিয়ে বাংলাদেশের সিনেমার উত্থান

‘বলিউডের ছায়া থেকে বের হয়ে বাংলাদেশের সিনেমার উত্থান হচ্ছে। ‘বলী: দ্য রেসলার’ বুসানের মতো উৎসবে পুরস্কার অর্জন ও প্রশংসা সিনেমা অঙ্গনে নব্য ক্ষমতার আভাস দেয়,’—এভাবেই বাংলাদেশের সিনেমার এগিয়ে যাওয়া নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে জাপানের অন্যতম পত্রিকা নিক্কেই এশিয়া। এই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের সিনেমা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নিজস্বতার পরিচয় দিচ্ছে।

‘অটোবায়োগ্রাফি’ ছবির দৃশ্য। ছবি : চরকি

সম্প্রতি বুসান চলচ্চিত্র উৎসবে একসঙ্গে অংশ নেয় বাংলাদেশের তিন সিনেমা। যা নিয়ে উৎসবের মনোনয়ন ঘোষণার পর থেকেই শুরু হয় আলোচনা। ২৮তম বুসান আয়োজনে নিউ কারেন্টস বিভাগে প্রতিযোগিতা করে ইকবাল হোসাইন চৌধুরীর ‘বলী: দ্য রেসলার’ ও বিপ্লব সরকারের ‘আগন্তুক’ এবং কিম জিসুক শাখায় প্রতিযোগিতা করে মোস্তফা সরওয়ার ফারুকীর ‘সামথিং লাইক অ্যান অটোবায়োগ্রাফি’।

নিক্কেই–এর প্রতিবেদনে বুসানের নিউ কারেন্ট বিভাগে পুরস্কারজয়ী ‘বলী’ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের বঙ্গোপসাগরঘেঁষা বাঁশখালীর পরিচালক ইকবাল হোসাইন চৌধুরী। প্রজন্মের পর প্রজন্ম তাঁরা বেড়ে উঠেছেন সমুদ্র উপকূলীয় অঞ্চলে।

এই সময়ে ১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড় ও পরবর্তী সময়ে নিখোঁজ মানুষের আহাজারি শুনেছেন। এ জন্য প্রথম সিনেমা বানানোর সময় তাঁকে সবচেয়ে বেশি তাড়িত করেছে সমুদ্র ও তার শিকড়ের যোগসূত্র। যে কারণে লক্ষণীয়, বলীর দারুণ চরিত্রায়ণ, নিজস্ব সাংস্কৃতিক আবহে স্থানীয় সম্প্রদায়ের জীবনের গল্পটি আন্তর্জাতিক দর্শকদের কাছে সম্পূর্ণ নতুন ছিল।

‘বলী’র একটি দৃশ্য। পরিচালকের সৌজন্যে

ইকবালের হাত ধরেই বাংলাদেশের সিনেমাটি প্রথমবার বুসান উৎসবের নিউ কারেন্টস বিভাগে পুরস্কার জিতেছে। নিক্কেইকে ইকবাল হোসাইন চৌধুরী বলেন, ‘সমুদ্র খুব রহস্যময়, বিভ্রান্তিকর, খুবই রোমান্টিক; যা আমাকে খুব আকর্ষণ করে। এটা কখনো আনন্দ দেয়, কখনো ভীতিকর শৈশবে দেখা সাইক্লোনের ট্রমার মধ্যে নিয়ে যায়। আমার সিনেমার দিকে তাকালেই বুঝবেন, এটা খুবই কাল্পনিক কিন্তু এটির ভিত দাঁড়িয়ে আছে আমার জীবনের ওপর। যা অনেকটাই লোককথার মতো।’

বাংলাদেশের প্রতিবেশী দেশ ভারত। দেশটির বলিউড সিনেমার দাপটে বাংলাদেশের সিনেমা অনেক দিন ধরেই ঢাকা পড়েছিল। ভারতের বড় বড় প্রডাকশন হাউসের সিনেমা, তাদের সিনেমা দর্শকের কাছে খুব সহজেই পৌঁছে যায়। পেশাগত জায়গায় এগিয়ে রয়েছে বলিউড স্টুডিওর সিনেমা। দেশের তরুণ প্রজন্মের নির্মাতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, অনেক সময় ভারত ও বাংলাদেশি সিনেমাগুলো ভাষা ছাড়া আলাদা করাও কঠিন ছিল। সেখানে গল্পে, চরিত্রায়ণে, স্বকীয়তায় আলাদা হচ্ছে দেশের সিনেমা।

‘অটোবায়োগ্রাফি’ সিনেমার একটি দৃশ্যে পরিচালক মোস্তফা সরয়ার ফারুকী

‘আমাদের সিনেমা সব সময়ই আড়ালে ছিল,’ নিক্কেইকে বলিউড সিনেমার প্রভাব প্রসঙ্গে বলেন নির্মাতা মোস্তফা সরওয়ার ফারুকী। চলতি বছরের বুসান উৎসবে যাঁর নিজেরও সিনেমা ছিল। ফারুকী আরও বলেন, ‘মূলধারার হোক বা শৈল্পিক ঘরানার, আমরা সব সময়ই ছায়ার আড়ালে ছিলাম। কিন্তু প্রায় ২০ বছর ধরে ধীরে ধীরে আমরা নিজেদের পথ খুঁজে নেওয়ার চেষ্টা করছি। চেষ্টা করছি নিজেদের ছাপ রাখতে। এটা করতে গিয়ে আমরা নিজেদের গল্পগুলোই বলার জন্য বেছে নিচ্ছি।’

চলতি বছর মোস্তফা সরওয়ার ফারুকীর ‘সামথিং লাইক অ্যান অটোবায়োগ্রাফি’ বুসানে প্রতিযোগিতা করে। ফারুকীর সিনেমায় সব সময় সংবেদনশীল ঘরোয়া বিষয়গুলো উঠে আসে। তাঁর আত্মজৈবনিক এ সিনেমায়ও উঠে এসেছে দেশের সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট। ভিডিও স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্ম চরকিতে ৩০ নভেম্বর মুক্তি পাবে সিনেমাটি।

বিয়ের পরে কেন বাচ্চা নিচ্ছেন না, এমন ব্যক্তিগত বিষয়েও নানা সামাজিক চাপ মোকাবিলা করতে হয়েছে পরিচালককে। এসব বিষয়ও উঠে এসেছে পর্দায়। সিনেমায় ফারুকী ও তাঁর স্ত্রী নুসরাত ইমরোজ তিশা প্রথমবার একসঙ্গে অভিনয় করেছেন। মা ও বাবা হওয়ার পরেই ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা নিয়ে সিনেমাটির শুটিং করেন।

ফারুকীকে বাংলাদেশের স্বাধীনধারার শীর্ষ নির্মাতা উল্লেখ করে প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, তিনি দীর্ঘদিন ধরে সাফল্যের সঙ্গে বৈচিত্র্যপূর্ণ সব গল্প নিয়ে বুসান উৎসবে অংশ নিচ্ছেন। এর আগে তাঁর ‘থার্ড পারসন সিঙ্গুলার নাম্বার’, ‘টেলিভিশন’ ও ‘শনিবার বিকেল’ সিনেমাগুলো এই উৎসবে প্রশংসিত হয়। বুসান চলচ্চিত্র উৎসবে দৃষ্টি কাড়াটাই ফারুকীকে ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রের চলচ্চিত্র উৎসবগুলোর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে। এমনকি প্রযোজক হিসেবেও তিনি উদীয়মান তরুণ প্রজন্মের নির্মাতাদের নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন। তিনি ভিডিও স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্ম চরকির ১২টি সিনেমার প্রযোজক হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছেন। সেগুলোতে উঠে আসছে দেশের ঘরোয়া সমস্যাসহ নানা বিষয়।

দেশে ফিরেই ‘বলী’র শুটিং স্পট বাঁশখালী সমুদ্রসৈকতে ছুটে গিয়েছিলেন ইকবাল হোসাইন চৌধুরী

ইকবাল হোসাইন চৌধুরী আবার নির্মাণের প্রেরণা খুঁজে নেন প্রচলিত লোককথা থেকে। এ ক্ষেত্রে তিনি উল্লেখ করেন তাঁর মেন্টর স্টিভ লুকাসের কথা। যাঁর লেখা ও প্রযোজিত তথ্যচিত্র ‘আফটার দ্য এক্স’ ১৯৮২ সালে অস্কারে মনোনীত হয়েছিল। লুকাস বলতেন, এমন কিছু লেখো, যা তোমার শিকড়ের সঙ্গে সম্পর্কিত। এভাবেই তুমি নিজস্বতা তৈরি করতে পারবে। ইকবাল মনে করেন, বাংলাদেশের স্বাধীন ঘরানার সিনেমায় এখন এটিই হচ্ছে। এভাবেই বাংলাদেশের সিনেমা নিজস্বতা পাবে বলেও মনে করেন এই তরুণ নির্মাতা। আর এই সময়টাকে তিনি উল্লেখ করেন ‘স্বর্ণযুগ’ হিসেবে।