সাম্প্রতিক সময়ের বেশ কিছু আলোচিত চরিত্রের অভিনেতা নাসির উদ্দিন খান
সাম্প্রতিক সময়ের বেশ কিছু আলোচিত চরিত্রের অভিনেতা নাসির উদ্দিন খান

চট্টগ্রাম টু বুসান, নাসিরের ‘বলী’–যাত্রা

ছুটির দিন শুক্রবার সকালেই বুসান চলচ্চিত্র উৎসবের নিউ কারেন্টস বিভাগে বাংলাদেশের ‘বলী: দ্য রেসলার’ সিনেমার পুরস্কার অর্জনের খবর ছড়িয়ে পড়ে। এরপর ছবির কেন্দ্রীয় চরিত্রের অভিনেতা নাসির উদ্দিন খানের সঙ্গে কথা হয়। ঘড়ির কাঁটায় স্থানীয় সময় রাত ১০টায় জানান, মাত্রই হোটেলে ফিরেছেন। অর্জনের অনুভূতির কথা বলতে গিয়ে হাউমাউ করে কাঁদছিলেন। কাঁদতে কাঁদতে অবস্থাটা এমন, কথা বলতেও কষ্ট হচ্ছিল তাঁর। সামলে নিয়ে পরক্ষণে আবার কথা চলতে থাকে। শোনা যাক চট্টগ্রাম থেকে বুসানযাত্রার গল্প

আমি একজন চাটগাঁইয়া
নব্বই দশকের মাঝামাঝি চট্টগ্রামে নাসির উদ্দিন খানের থিয়েটারচর্চা শুরু। অভিনয়ের নানা অলিগলি পেরিয়ে ২০১৬ সালে ঢাকায় আসা। মেলে ধরেন অভিনয়ের আঙিনায়। বাড়তে থাকে পরিচিতি। ‘তাকদীর’, ‘মাইশেলফ অ্যালেন স্বপন’ দিয়ে নিজেকে ছাড়িয়ে যান। এবার তো ঢাকা থেকে তাঁর যাত্রা দক্ষিণ কোরিয়ার বুসানে। ইকবাল হোসাইন চৌধুরী পরিচালিত ‘বলী: দ্য রেসলার’ সিনেমা দিয়ে নিজেকে মেলে ধরলেন ২৮তম বুসান আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে। অনুভূতি জানাতে গিয়ে বললেন, ‘অনুভূতি চোখের পানি হয়ে ঝরছে।

নাসির উদ্দিন খান

সত্যিকার অর্থে বলতে চাই, এর প্রধান কারণ হচ্ছে, এটা চাটগাঁইয়া ফিল্ম, আমি একজন চাটগাঁইয়া, পরিচালকও চাটগাঁইয়া। আমার চাটগাঁইয়া একটা ফিল্ম বাংলাদেশের হয়ে বুসান ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে প্রচারিত হয়েছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মানুষ দেখছেন। ফিল্মে আমার দেশের মানুষের একটা আন্তর্জাতিক অর্জন হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মানুষ কথা বলছেন। আমার তো এখনই উড়ি চলি যাইতে ইচ্ছে হচ্ছে।’

কৃতজ্ঞতা প্রকাশ

নিজের ছবির পুরস্কার অর্জনের অনুভূতি প্রকাশ করতে গিয়ে শুটিং–সময়ে ফিরে গেলেন নাসির উদ্দিন খান। বললেন, ‘আমার খুব মনে পড়ছে ছবির ডিওপির কথা। আমার চিনি ছাড়া আদা–চা খাওয়ার অভ্যাস। শুটিং–সময়ে একটা শর্ট দেওয়ার পর প্রোডাকশন বয় চা হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকত। সবাইকে এই সময়টায় খুব খুব মিস করতেছি। মনে হচ্ছে, ওদের সবাইকে জড়িয়ে ধরতে পারতাম।’ ‘বলী’ সিনেমার শুটিং সময় শাহীনুর সরোয়ার নামের এক সহশিল্পী মারা যান। তাঁর প্রতিও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলেন নাসির। বললেন, ‘তাঁদের সবার কারণে আমি চরিত্রটি হয়ে উঠতে পেরেছি।’ এসব বলতে বলতে আবারও কাঁদতে থাকলেন নাসির।

পুরস্কারের খবর শুনে ছটফট

দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে সময়ের পার্থক্যে বাংলাদেশ তিন ঘণ্টা পিছিয়ে। নিজের অভিনীত ‘বলী’ ছবির পুরস্কার প্রাপ্তির খবর শোনার পর বড় ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলতে খুব মন ছটফট করছিল। কিন্তু কোনোভাবেই পারছিলেন না। যখন কথা হয়, তখন বাংলাদেশ সময় সন্ধ্যা সাতটা। নাসির উদ্দিন খানরা ছয় ভাইবোন। কিন্তু বড় ভাই আমানুল্লাহ খানের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কটা বেশি ভালো। পিতৃতুল্য বড় ভাইকে নিজের ছবির সাফল্যের খবরটা শোনানোর জন্য মনটা খুব ব্যাকুল হয়েছিল তাঁর। পরে আমানুল্লাহ খানের পুত্রবধূর মাধ্যমে ভিডিও কলে কথা বলেন নাসির।

‘বলী’র একটি দৃশ্য। পরিচালকের সৌজন্যে

বললেন, ‘বুসানের এই পুরস্কার যে এত বড়, তারা বুঝতে পারেনি। তবে আমার খুশি দেখে তারা বুঝছে অনেক বড় কিছু। পত্রপত্রিকায় লেখালেখি ও ফেসবুকে এটা নিয়ে সারা দিন কথা হয়েছে ভেবে তারা বুঝছিল, দেশের সিনেমার জন্য এটি বড় বিষয়। ভাইকে জানাতে পেরেছি, আমার আত্মা শান্তি পেয়েছে।’

সহকর্মীদের স্বপ্ন

পরিবারের পাশাপাশি নাসির উদ্দিন খানকে নিয়ে তাঁর থিয়েটারের সহকর্মীরাও স্বপ্ন দেখতেন। তাঁরা চাইতেন, এই নাসির যেন নিজেকে বড় পরিসরে মেলে ধরেন। ঢাকায় যেহেতু সুযোগ-সুবিধা বেশি, তাই ঢাকা যাওয়ার পরামর্শ দেন। ‘বলী’ সিনেমার মর্যাদাপূর্ণ উৎসবে পুরস্কার অর্জনে সেই সহকর্মীদের কথাও মনে করলেন। বললেন, ‘১৯৯৫ থেকে থিয়েটার করি। এই লম্বা সময়ে অনেকে পাশে ছিল। নানাভাবে এগিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দিত। কীভাবে আরও ভালো করতে পারি, তার জন্য নানা কিছু করার কথাও বলত। আজ মনে হচ্ছে, সবার মধুর ষড়যন্ত্রের ফল “বলী”র এই অর্জন। আমি ফেসবুকে একবার ঢুঁ মেরে দেখলাম, সবাই খুব খুশি। খুবই খুশি।’

স্ত্রীর কষ্ট সার্থক

চট্টগ্রামের রক্ষণশীল পরিবারে বেড়ে ওঠা নাসির উদ্দিন খানের অভিনয়ের ব্যাপারটি আত্মীয়–পরিজনদের অনেকেই বাঁকা চোখে দেখতেন। অনেকেই ভাবতেন, তিনি বিপথে চলে গেছেন। এসব কথা তাঁর স্ত্রীকেও বলতেন। নাসিরের ভাষায়, ‘আমার কারণে সবচেয়ে বেশি খোঁচা মারা কথা শুনতে হয়েছে আমার স্ত্রীকে। তিনি মুখ বুঝে সহ্য করতেন। তবে অভিনয়ের প্রতি স্বামীর তীব্র আগ্রহকে সমর্থন করে গেছেন।’ স্ত্রীর স্যাক্রিফাইসের কথা বলতে গিয়ে কাঁদতে থাকলেন। বললেন, ‘আমার কারণে স্ত্রীকে সবাই এসে বলত, “তোমার স্বামী এমন একটা জায়গায় গেছে, এই জায়গা তো ভালো না।” হাসিখুশি ভাব নিয়ে বলত, “তোমার হাজব্যান্ডের কাজ তো দেখি। যদিও ভালো অভিনয় করে, কিন্তু জায়গাটা তো ভালো না। কেন ঢাকা চলে গেল!” আমার বাচ্চা দুটোকেও কথা শুনতে হয়। তবে আমার স্ত্রী–সন্তানেরা যদি প্রতিবন্ধকতা তৈরি করত, তাহলে কখনোই এত দূর আসতে পারতাম না। ঠান্ডা মাথায় কাজ করতে পারতাম না। তারা আমাকে কমফোর্ট দিয়েছে। আমার সন্তানেরা তো আমার সবচেয়ে বড় ফ্যান। ওরাই আমার অনেক বড় শক্তি ও সাহস।’

‘বলী’ ছবির প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেছেন নাসির উদ্দিন খান। সংগৃহীত

বাবা, তুমিই আমার হিরো

বুসানের উৎসবে প্রশ্নোত্তর পর্ব ছিল। সেখানে চট্টগ্রামের ভাষায় সবার সেই প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন নাসির উদ্দিন খান। সেই গল্প শুনিয়েছেন উচ্চমাধ্যমিক পড়ুয়া মেয়েকে। চট্টগ্রামের ভাষায় কথা বলার কারণে মেয়ে তাঁর বাবাকে বলেছে, ‘বাবা, তুমিই সেরা। তুমিই আমার হিরো।’

সেই প্রসঙ্গ উঠতেই নাসির বললেন, ‘বুসান উৎসবে আমাদের ছবির তিনটা প্রদর্শনী হয়েছে। দুটোতে ছিলাম। একটিতে থাকা সম্ভব হয়নি। শো শেষে দর্শকের সামনের প্রশ্নোত্তর ছিল। আমি চট্টগ্রামের ভাষায় উত্তর দিয়েছি। অনুবাদ করে দিয়েছেন পিপুল আর খান। এই গল্প মেয়েকে বলার পর সে তো মহাখুশি।’

স্বপ্ন ডানা মেলেছে

চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা, এরপর বুসান। ‘বলী’ নিয়ে বুসানে গিয়ে বাজিমাত। বাংলাদেশি প্রথম চলচ্চিত্রের সাফল্যের অংশীদার হলেন। ‘বলী’র এই অর্জন অভিনেতা হিসেবে নাসিরের স্বপ্ন ডানা মেলেছে। বিষয়টা এভাবেই বললেন, ‘সাধারণত, প্রত্যাশা ও চাহিদার দিকটা আমার খুব সামান্য। উষ্ণ ভালোবাসা পাচ্ছি, এটাই অনেক পাওয়া। আমি ব্যাখ্যা করতে পারব না। আমাকে চূড়ান্ত জায়গায় এগিয়ে দিয়েছে। বুসানে ছবিটি এত বড় অর্জন হবে ভাবিনি। সবচেয়ে বড় ভালো লাগা হলো চট্টগ্রামের একটা ফিল্ম, বাংলাদেশের একটা ফিল্ম প্রতিনিধিত্ব করেছে।’

বুসানে অটোগ্রাফ দিচ্ছেন নাসির উদ্দিন খান। ভিডিও থেকে নেওয়া

প্রথম বিদেশযাত্রা, প্রথম ছবি দেখা

নাটক, ওয়েব সিরিজ, ওয়েব ফিল্মের পাশাপাশি চলচ্চিত্রেও কাজ করেছেন নাসির উদ্দিন খান। ডাবিংয়ের সময় সাধারণত এসব ছবি দেখা হয় অভিনয়শিল্পীদের। কিন্তু ‘বলী’ ছবিটির আলাদা করে ডাবিং করেননি নাসির। বুসান উৎসবে প্রথম ছবিটি দেখার সুযোগ হয় তাঁর। আর এর মধ্য দিয়ে প্রথমবার দেশের বাইরের বিমানে চড়লেন তিনি।

পর্দায় নিজেকে দেখে কেমন লেগেছিল? ‘নিজেকে প্রথম দেখে ভালো লেগেছিল। প্রথম বিদেশযাত্রা। আমার মূল উদ্দেশ্য ছিল ছবিটা দেখা। মন ভরে গেছে। এই দেশে সবাই চুপচাপ ছবি দেখে। আমাদের ওখানে তো পপকর্ন খায়, মোবাইল ছবি তোলে, আরও কত–কী করে। কিন্তু এখানে দেখলাম, যতক্ষণ ছবি শেষ না হয়, প্রেক্ষাগৃহের লাইট না জ্বলে, ততক্ষণ দর্শক নড়েচড়েও না।’ ছবি দেখা শেষে গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় একটা পার্টিতে অংশ নেন নাসির। সেখানে কেউ তাঁর সঙ্গে ছবি তুলেছে। কেউ অটোগ্রাফ নিয়েছে। কেউ এসে বলেছে, ‘আপনি রেসলারের সেই অ্যাক্টর না?’

নাসির বললেন, ‘প্রথম বিদেশযাত্রা, তা–ও সিনেমা নিয়ে। আমার স্বপ্ন নিয়ে। দেশে না হয় কেউ না কেউ চেনে। কিন্তু দেশের বাইরে এভাবে ছবি তোলা, অটোগ্রাফ চাওয়া—এসবে অবাকের পর অবাক হয়েছি।’

‘মাইশেলফ অ্যালেন স্বপন’–এ নাসির উদ্দিন খান

পরিচালকের কথা

একঝাঁক তরুণমুখ নিয়ে গত বছর শুরুর দিকে ‘বলী’র শুটিং শুরু হয়। সিনেমার প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেছেন নাসির উদ্দিন খান। তাঁর ওপর কেন ভরসা করলেন—এমন প্রশ্নে ইকবাল হোসাইন চৌধুরী বলেন, ‘কারণ, তাঁর চেয়ে ভালো কোনো বিকল্প আমার হাতে ছিল না। ২০২২ সালে যখন ওনাকে ছবিতে নিই, তিনি তখন “অ্যালেন স্বপন” হয়ে ওঠেননি। নাসির উদ্দিন অন্তত আমার কাছে যেকোনো বিচারে বিশ্বের বড় মাপের অভিনেতাদের একজন।’

নাসির উদ্দিন খান